সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে রাস্তায় কিছু পাখির পড়ে থাকার একটি ছবি পোস্ট করে বলা হচ্ছে, মদপান করে মাতাল হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে ওয়াক্স উইং পাখি। এরকম কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে ও এখানে।
গত ১৭ ডিসেম্বর ‘Jhuma Debnath Purnima’ নামক একটি অ্যাকাউন্ট থেকে ফেসবুকের একটি গ্রুপে ছবিটি পোস্ট করা হয়। পোস্টে উল্লেখ করা হয়, “এইগুলো মরা পাখি নয়। মদপানে মাতাল হওয়া ওয়াক্স উইং পাখি। কিছু কিছু ফল আছে যেগুলো পচে গেলে তাতে এলকোহল জমে। এই পাখিগুলো সেই এলকোহলওয়ালা ফল খেয়ে টাল হয়ে মাটিতে পড়ে থাকে। পার্কে হাঁটার সময় পথচারীরা পাখিগুলোকে কুড়িয়ে নিরাপদ স্থানে রেখে দেন যাতে নেশা কেটে গেলে পাখিগুলো উড়ে যেতে পারে।” পোস্টটির স্ক্রিনশট দেখুন--
ফ্যাক্ট চেক:
বুম বাংলাদেশ যাচাই করে দেখেছে, দাবিটি সঠিক নয়। পাখিগুলো মাতাল হয়ে নয় বরং আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে ইউক্রেনের একটি রাস্তায় পড়ে ছিল। ঘটনাটি ঘটে ২০২৩ সালে।
আলোচ্য ছবিটি রিভার্স ইমেজ সার্চ এর মাধ্যমে ২০২৩ সালের ০৮ জানুয়ারি ইউক্রেনের একটি ফেসবুক পেজে প্রকাশিত প্রথম দিকের একটি পোস্ট পাওয়া যায়। এতে-ও পাখিগুলোকে মাতাল বলে উল্লেখ করা হলেও পোস্টটির কমেন্টে একজন ব্যবহারকারীকে এই ঘটনা সংক্রান্ত একটি লিংক শেয়ার করতে দেখা যায়। দেখুন--
লিংকটিতে প্রবেশ করে দেখা যায় পশু-পাখি ভিত্তিক কন্টেন্ট নিয়ে আলোচনা বিষয়ক একটি ফেসবুক গ্রুপে 'Tina Lytvynenko' নামের একজন ব্যবহারকারী রাস্তায় পড়ে থাকা কয়েকটি পাখির ছবি ও একটি জীবিত পাখির ছবির পোস্ট করেছেন। পোস্টে তিনি উল্লেখ করেছেন- 'আলোচ্য রাস্তায় পড়ে থাকা পাখিগুলোকে তিনি বাসায় নিয়ে গেছেন। এর মধ্যে ১৪ টি মৃত; আর একটি পাখি জীবিত ছিল। এদের সবগুলোই ইউক্রেনের চেরনিহিভের হেরোইভ চর্নোবিলিয়া স্ট্রিটে একটি কাঁচের তৈরি বাস স্টপের কাছে পাওয়া গিয়েছিল (অনূদিত ও সংক্ষেপিত)।'
পোস্টকারীর প্রোফাইলের তথ্য অনুযায়ী, তিনি প্রকৃতির ছবি তোলেন এবং ইউক্রেনের চেরনিহিভ মেডিকেল সেন্টারে একজন প্যারামেডিক হিসেবেও কাজ করেন। পোস্টটির স্ক্রিনশট কোলাজ দেখুন--
পোস্টটিতে তিনি আরো উল্লেখ করেন, তিনি প্রথমে ভেবেছিলেন, কেবল পাকা রোয়ান (রোয়ান বেরি) খাওয়ার কারণে এমন হয়েছে। পরে তিনি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের খুঁজে পান, যারা পুরো বিষয়টি দেখেছেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, পাখিগুলো (৭ জানুয়ারি) বাস থামার স্থানের কাঁচের শেল্টারে (দেয়াল) আঘাত পাওয়ার কারণে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ফুটপাতে পড়ে ছিল।
পরবর্তীতে তার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বুম বাংলাদেশকে জানান, কয়েক দশক ধরে পাখির ঝাঁক (বোহেমিয়ান ওয়াক্সউইং) রোয়ানবেরি গাছে বেরি খেতে উড়ে আসে। কিন্তু এই গাছটি ছিল কাঁচের বাস স্টপের পাশে। আর যখন পাখিরা যানবাহন বা পথচারীদের ভয় পেত, তখন তারা উড়ে চলে যেতে গিয়ে কাঁচে আঘাত পেত। এর ফলে তাদের মধ্যে কিছু আহত হয়, কিছু বেঁচে থাকে এবং কিছু মারা যায়।
তিনি আরো জানান, 'কিছু লোক যেমন বলেছিল পাখিগুলো মাতাল ছিল। আমিও শুরুতে তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু মাতাল থাকার এই ধারনাটি ভুল। আমাদের শহরে পাখিদের আসল সমস্যা হলো কাঁচ। উঁচু ভবন এবং বাস স্টপের কাঁচের জানালা। অনেক পাখি কাঁচে আঘাতপ্রাপ্ত হয় (শনাক্ত না করতে পেরে)।' এছাড়াও তিনি সেই জায়গাটির গুগল ম্যাপ লিংকও আমাদের সাথে শেয়ার করেছেন।
'Tina Lytvynenko' ঐদিনের বিষয়ে আরো বলেন, 'সেখানে ফুটপাতে ১৫ টি পাখি ছিলো যা তিনি বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন। এর মধ্যে একটি পাখি জীবিত ছিল তবে সেটি উড়তে পারত না। এছাড়াও সেখানে গাছে থাকা আরো একটি পাখি জীবিত ছিল।' তাই পাখিগুলো মাতাল হয়ে ফুটপাতে পড়ে আছে এই ধারণাটি সত্য নয় বলে তিনি জানান।
পোল্যান্ডের সাইলেসিয়ান অর্নিথোলজিক্যাল সোসাইটি-ও নিজেদের ফেসবুক পেজের এক পোস্টে আলোচ্য ঘটনার কারণ হিসেবে কাঁচের বাস শেল্টারে আঘাত পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছে। পোস্টে তারা লিখেছে, ভাইরাল ছবিতে থাকা পাখিরা সম্ভবত কোনও বাধার কারণে আঘাতের শিকার হয়েছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে পাখিরা একে অপরের কাছাকাছি পড়ে আছে। সাধারণত যখন একটি উড়ন্ত পাখির ঝাঁক একসাথে উড়তে থাকা অবস্থায় কোথাও আঘাতপ্রাপ্ত হয় তখন এমনটা হতে পারে (অনূদিত ও সংক্ষেপিত)।
এতে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, পাখিরা অ্যালকোহল যুক্ত খাবার খেয়ে থাকতে পারে। একইসাথে তারা তা বিপাক তথা হজমও করতে পারে এবং অ্যালকোহলের ফলে তারা 'মারা যায় না' বা এতখানি মাতাল হয় না যাতে তারা রাস্তায় পড়ে থাকে। সামান্য ভারসাম্যহীন না হয়েও আতশবাজি, ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ সহ বিভিন্ন কারণে পাখিরা বিভিন্ন দেয়াল বা বাঁধার সাথে আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে (অনূদিত ও সংক্ষেপিত)।
একই রকম ব্যাখ্যা ও গবেষণার তথ্য পাওয়া যায় আরো দুইটি পাখি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও বিশেষজ্ঞের (১, ২) পোস্টে। এতেও উল্লেখ করা হয়েছে, কোনো কিছুর সাথে সংঘর্ষের আগে পাখিরা রোয়ানবেরি ফল খেতেও পারে না-ও খেতে পারে। কিন্তু এতে পাখিদের মাটিতে পড়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেনা। যদি পাখিগুলি এত মাত্রায় মাতাল থাকতো তবে তারা একে অপরের কাছাকাছি বা সরলরেখায় উড়তে পারত না। অ্যালকোহলের প্রভাবের কারণে তারা খুব বেশি সমন্বয়হীন থাকতো। কিন্তু ছবিতে দেখা গেছে তারা কাছাকাছিই ছিল (অনূদিত ও সংক্ষেপিত)।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সার্চ করে, ইউক্রেনের একটি সংবাদ মাধ্যমের ভেরিফাইড ফেসবুকে পেজে আলোচ্য ছবিটি সহ পরবর্তীতে পাখিগুলোকে উদ্ধার করা ও একটি পাখির জীবিত থাকার বিষয়ে ২০২৩ এর ৯ জানুয়ারি একটি ভিডিও প্রতিবেদন পাওয়া যায়। এতেও পাখিগুলোর ক্ষেত্রে কাঁচের বাস শেল্টারে আঘাত পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। স্বচ্ছতার কারণে পাখিরা কাঁচের দেয়ালকে শনাক্ত করতে না পেরে সেখানে থেকে উড়ে যেতে গিয়ে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। প্রতিবেদনটির স্ক্রিনশটের কোলাজ দেখুন--
অর্থাৎ, পাখিগুলো মাতাল হওয়ার কারণে নয় বরং আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে ইউক্রেনের একটি রাস্তায় পড়ে ছিল।
উল্লেখ্য, আলোচ্য ছবি ও দাবিটি নিয়ে ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে পোল্যান্ডের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিষ্ঠান 'ডেমাগগ'। প্রতিবেদনে 'Adam Zbyryt' নামক পোল্যান্ডের বিয়ালিস্টক বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদের সাথে সংশ্লিষ্ট একজন পক্ষীবিদ যিনি পাখিদের বিষয়ে অধ্যয়ন ও সুরক্ষা নিয়ে কাজ করেন; তার মন্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে।
পাখিদের অ্যালকোহল সেবনের বিষয়ে তিনি জানিয়েছেন- 'যেসব পাখি নিয়মিতভাবে পাকা ফল খায় তারা দ্রুত তাদের শরীরে, বিশেষ করে তাদের লিভার খুব দক্ষতার সাথে অ্যালকোহল প্রক্রিয়াজাত এবং হজম করতে পারে। পাখিদের মধ্যে এই ক্ষমতা মানুষের তুলনায় প্রায় ১৪ গুণ দ্রুত। এর অর্থ হল; পাখিরা অ্যালকোহল পান করতে পারে, তবে অ্যালকোহলের কারণে তাদের মৃত্যুর সম্ভাবনা কম। ভিন্ন কোনো কিছু তাদের মৃত্যুর কারণ হতে পারে, যেমন জানালায় আঘাত পাওয়া (অনূদিত ও সংক্ষেপিত)।'
'Tina Lytvynenko' আলোচ্য ওয়াক্সউইং পাখিগুলো সংগ্রহ করেছিল এবং পাখিগুলোর ঠোঁট-পা ভাঙা ছিল। অভ্যন্তরীণ অঙ্গও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তিনি পোল্যান্ডের একটি ফ্যাক্ট-চেকিং সাইটকেও নিশ্চিত করেছেন যে ইউক্রেনের চেরনিহিভে হেরোইভ চর্নোবিলিয়া সেন্ট (বোইওভা) বাস স্টপে পাখিগুলি পাওয়া গেছে, যার পিছনে একটি রোয়ান গাছ রয়েছে। কয়েকটি কাঁচের বাস থামার জায়গা (স্টপিজ) এর ছবি দেখুন--
সুতরাং সামাজিক মাধ্যমে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মাটিতে পড়ে থাকা পাখির ছবিকে মাতাল অবস্থায় পড়ে থাকা পাখি বলে প্রচার করা হয়েছে; যা বিভ্রান্তিকর।