সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকের একাধিক পেজ, আইডি ও গ্রুপে কয়েকটি ছবি পোস্ট করে দাবি করা হচ্ছে, প্রিম্যাচিউর বেবি হওয়ায় জন্মের পর থেকে শ্বাসকষ্টে ভুগছিল নবজাতক। এজন্য ডাক্তারের পরামর্শে পিতা তাঁর বুক ছিদ্র করে ফুসফুস থেকে সরাসরি অক্সিজেন সরবরাহ করে সন্তানকে বাঁচিয়ে তুলেছিল। এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
গত ৯ জুলাই 'Rudro – রুদ্র' নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে কয়েকটি ছবি পোস্ট করে লেখা হয়, "আল্লাহ পাক চাইলে সবই সম্ভব। তিনিই সর্বশক্তিমান ও পরম দয়ালু। নির্ধারিত সময়ের পূর্বে ভূমিষ্ট হওয়া সন্তানের শ্বাসকষ্ট! ডাক্তার বললেন অক্সিজেন নয়, সরাসরি ফুসফুসের কানেকশন লাগবে! কাউকে খুঁজে বের করুন।“বাবা” বললেন খুঁজতে হবেনা আমার বুক চিড়ে ব্যবস্থা করুন! সন্তানকে একমাস বুকের সাথে আগলে রেখে এখন উভয়ে’ই সুস্থ্য। কিছু কিছু সময় মায়েদের ও হার মানিয়ে যায় বাবার ভালোবাসা। ভালো থাকুক পৃথিবীর সকল মা-বাবা আর সন্তানরা।" ফেসবুক পোস্টটির স্ক্রিনশট দেখুন--
ফ্যাক্ট চেক:
বুম বাংলাদেশ যাচাই করে দেখেছে, ছবিটির ক্যাপশনে করা দাবিটি সঠিক নয়। যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো রাজ্যের ডেনভার শহরের এক দম্পতির মাত্র ২৩ সপ্তাহের প্রিম্যাচিউর বেবি জন্ম নেয়। পরে এই নবজাতককে সুস্থ করে তুলতে আইসিউতে পিতার দেয়া স্কিন-টু-স্কিন থেরাপির ছবি এটি। নবজাতকের শ্বাসকষ্ট দূর করতে পিতার বুক ছিদ্র করে ফুসফুস থেকে অক্সিজেন দেয়ার দাবিটি বানোয়াট।
কি-ওয়ার্ড সার্স করে ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর ডেইলি মিরর পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। "Premature baby born at 5 months doctors warned had no chance of survival brushes mum's hand away in amazing footage" শিরোনামের এই প্রতিবেদনে বলা হয়, ফন্টেইন ডিকি নামের ওই শিশু মায়ের গর্ভে আসার মাত্র পাঁচ মাস বয়সে ভূমিষ্ট হয়। তখন তার ওজন ছিল মাত্র প্রায় সাড়ে চারশ গ্রাম। জন্মের পর তাকে চার মাস হাসপাতালে রাখা হয়েছিল। সেসময়ের মধ্যে তার হার্ট সার্জারি, চারটি রক্ত সঞ্চালন ও সাপ্তাহিক চোখের পরীক্ষা করানো হয়। এই প্রতিবেদনে ডিকি ও তার চিকিৎসা নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে, তবে পিতার বুক ছিদ্র করে ফুসফুস থেকে ডিকিকে অক্সিজেন দেয়ার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। স্ক্রিনশর্ট দেখুন--
এর সুত্র ধরে ডিকি'র মা জেনি সানচেজের নামে একটি ইনস্টগ্রাম আইডি খুজে পাওয়া যায়। সেই আইডি থেকে ২০১৭ সালের ৩০ এপ্রিল তাদের পরিবারের একটি ছবি পোস্ট করা হয়। সেই পোস্টে দেখা যায়, তার বাবার বুকে সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুটি শুয়ে আছে। ওই ছবিতে সানচেজ সবাইকে ধন্যবাদ দেন এবং হ্যাশট্যাগ দিয়ে 'স্কিন-টু-স্কিন' থেরাপির বিষয়টি উল্লেখ করা হয়।
২০১৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর একই একাউন্ট থেকে তিনি আরেকটি পোস্ট করেন। যেখানে তিনি উল্লেখ করেন, "What I really love is how you all stand up for us and him without ever meeting us! People have taken my photo and created there own stories about my family and son that have no truth!" (আমি সত্যিই ভালোবাসি যেভাবে আপনারা সবাই আমাদের না দেখেই আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন! লোকজন আমার ছবি সংগ্রহ করেছে এবং আমার পরিবার ও সন্তানকে নিয়ে নিজেদের মতো করে গল্প বানিয়েছে, যা সত্য নয়!)” স্ক্রিনশর্ট দেখুন--
এর প্রায় তিন বছর পর ১০ অক্টোবর ২০২০ সালে একই ইন্সটাগ্রাম আইডি থেকে সানচেজ তার সন্তান ও পরিবারের ছবি নিয়ে টুইটারের প্রচারণার জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তার কোনো টুইটার আইডি নেই। টুইটারে সানচেজের স্বামীর সাথে তার সন্তানের দুই সময়ে তোলা দুটি ছবির কোলাজের একটি পোস্টের স্ক্রিনশট এই ইন্সটাগ্রাম পোস্টে যুক্ত করেন তিনি। এখানে দুটি ছবির প্রথম ছবিটি আলোচ্য পোস্টের প্রথম ছবিটি হুবহু একই রকম। দেখুন--
উল্লেখ্য, প্রিম্যাচিউর বেবির ক্ষেত্রে পিতা-মাতার স্কিন টু স্কিন কেয়ার (যা ক্যাঙ্গারু কেয়ার হিসেবেও পরিচিত) চিকিৎসা পদ্ধতি বেশ উপকারী ও বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। "How skin-to-skin care can help your preterm baby" শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে সন্তানের সাথে পিতা-মাতার স্কিন টু স্কিন কেয়ার প্রিম্যাচিউর বেবির বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে কিভাবে সাহায্য করে তা বর্ণনা করা হয়েছে। এছাড়া "Skin-to-Skin Care" এই প্রতিবেদন থেকেও সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পর সন্তান ও পিতা-মাতার স্কিন টু স্কিন চিকিৎসা পদ্ধতি ও এর উপকারিতা সম্পর্কে জানা যায়। এ নিয়ে ইউনিসেফেরও একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন রয়েছে।
অর্থাৎ আমেরিকান দম্পতির প্রিম্যাচিউর বেবি ডিকির জন্ম নেয়া ও হাসপাতালে তাকে তার পিতার স্কিন থেরাপি দেয়ার ছবিকে বানোয়াট গল্প জুড়ে দিয়ে প্রচার করা হচ্ছে।
সুতারাং প্রিম্যাচিউর বেবিকে স্কিন থেরাপি দেয়ার ছবিকে পিতার বুক ছিদ্র করে ফুসফুস থেকে অক্সিজেন দেয়ার ভিত্তিহীন দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে ফেসবুকে, যা বানোয়াট ও বিভ্রান্তিকর।