সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকের একাধিক আইডি ও পেজ থেকে একটি ভিডিও পোস্ট করে দাবি করা হচ্ছে, রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বটেরতল মাঝিপাড়া গ্রামে মন্দিরে ভাংচুর ও আগুন দেয়ার ভিডিও এটি। ভিডিওটিতে মন্দির সদৃশ এক অবকাঠামোতে জ্বলতে থাকা আগুন দমকল বাহিনীর কর্মীদের নেভানোর চেষ্টা করতে দেখা যাচ্ছে। এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
আজ ১৮ অক্টোবর 'Mah Ir' নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে ভিডিওটি পোস্ট করে লেখা হয়, "কিছুক্ষণ আগের খবর, রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার বটেরতল মাঝিপাড়া গ্রামের মন্দিরে ভাংচুর ও আগুন দিয়েছে মুসলিমরা। সবাই বেশি বেশি শেয়ার করেন"। অর্থাৎ দাবি করা হচ্ছে ভিডিওটি বাংলাদেশের রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার। ভিডিওটির স্ক্রিনশট দেখুন--
ফেসবুকের পাশাপাশি একই দাবিতে ভিডিওটি টুইটারেও ব্যাপক ভাবে ভাইরাল হয়েছে। 'Bangladesh Hindu Unity Council' নামের ভেরিফাইড টুইটার হ্যান্ডেল থেকে আজ (১৮ অক্টোবর) ভিডিওটি রংপুর জেলার পীরগঞ্জের দাবি করে পোস্ট করতে দেখা যায়। স্ক্রিনশট দেখুন--
ফ্যাক্ট চেক
বুম বাংলাদেশ দেখেছে, ভিডিওর বর্ণনায় করা দাবিটি সঠিক নয়। মূলত গত ১২ অক্টোবর রাতে ভারতের ত্রিপুরার কমলপুর থানাধীন মরাছড়া বাজার এলাকায় একটি পূজামণ্ডপ ও বেশ কিছু দোকানপাটে অগ্নি দুর্ঘটনার ভিডিওটি এটি।
ভিডিওটির কি-ফ্রেম দিয়ে রিভার্স সার্চ করে কোনো উল্লেখযোগ্য ফলাফল না পাওয়ার পর, বুম বাংলাদেশ ভাইরাল ভিডিওটি আরও পর্যবেক্ষণ করে দেখার সিদ্ধান্ত নেয়। ভিডিওটিতে দেখতে পাওয়া মানুষ ও অবকাঠামো নিবিড়ভাবে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দৃশ্যমান আগুন নেভানোর চেষ্টারত দমকল কর্মীদের ইউনিফর্মের সাথে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্মীদের ইউনিফর্মের কোনো মিল নেই। বরং ভাইরাল ভিডিওর দমকল কর্মীদের ইউনিফর্ম ইন্ডিয়ান ফায়ার সার্ভিসের ইউনিফর্মের অনুরূপ। দমকল কর্মীদের ইউনিফর্মের একটি তুলনা দেখুন--
পরে এই সূত্র ধরে বুম বাংলাদেশ ফেসবুকে একাধিক কিওয়ার্ড সার্চ করার পর, গত ১৩ অক্টোবর 'Today Tripura 24X7' পোস্ট করা ভাইরাল ভিডিওর হুবহু একটি ভার্সন খুঁজে পায়। 'Today Tripura 24X7' পেজে পোস্ট করা উক্ত ভিডিওটির বর্ণনায় হ্যাশট্যাগ ব্যাবহার করে লেখা হয়েছে, " #সপ্তমীর রাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে #ভষ্মীভূত হল মরা ছড়া বাজারের দুর্গা #পুজোর প্যান্ডেল সহ #আশেপাশের কিছু দোকান #দমকলের দীর্ঘ চেষ্টার পর #আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।" ওই পোস্টের স্ক্রিনশট দেখুন--
উক্ত ভিডিওটিতে কোনো স্থানের নাম উল্লেখ করা না হলেও, এই পোস্টের সূত্র ধরে বুম বাংলাদেশ উক্ত ভিডিওটি আরো বেশ কিছু ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলে খুঁজে পায়। তন্মধ্যে, 'Social Tripura Network' নামের একটি ফেসবুক পেজে গত ১৩ অক্টোবর একই ভিডিওটি পোস্ট করে লেখা হয়েছে, "সপ্তমীর রাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে ছাই মরাছড়া বাজারে দুর্গোমন্ডপসহ একাংশ দোকানপাট।।।।" রংপুরের পীরগঞ্জের দাবিতে ভাইরাল ভিডিও এবং 'Social Tripura Network' পেজে পোস্টকৃত ভিডিওর পাশাপাশি স্ক্রিনশট দেখুন--
পাশাপাশি ভুয়া দাবিতে ভাইরাল ভিডিওটির আরেকটি পুরোনো ভার্সন দেখুন, যা গত ১৩ অক্টোবর ইউটিউবে আপলোড করা হয়েছে--
এছাড়া, আরো বিস্তারিত সার্চ করে দেখা যায় মরাছড়া বাজার ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় ত্রিপুরা রাজ্যের কমলপুর মহাকুমার একটি এলাকা। মরাছড়া বাজার এলাকায় দূর্গাপূজার মণ্ডপে অগ্নি দূর্ঘটনা নিয়ে প্রচারিত একটি ভিডিও প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায় আগরতলা ভিত্তিক বাংলা ভাষার টেলিভিশন 'চ্যানেল দিনরাত'-এর ইউটিউব চ্যানেলে। প্রতিবেদনটি দেখুন--
অর্থাৎ ভিডিওটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের কমলপুর থানা এলাকার মরাছড়া বাজারের কাছে একটি দূর্গাপূজার মণ্ডপ সহ কিছু দোকানপাটে অগ্নি দুর্ঘটনার। এই ভিডিওটিকেই বিভ্রান্তিকরভাবে রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার বটেরতল মাঝিপাড়া গ্রামের মন্দিরে অগ্নিসংযোগ বলে দাবি করা হচ্ছে।
এদিকে, ওই অগ্নিকাণ্ড নিয়ে ত্রিপুরার স্থানীয় স্যন্দন পত্রিকা ও অসমিয়া সংবাদমাধ্যম টাইমএইট-এ প্রকাশিত আরো দুটি প্রতিবেদন দেখুন এখানে এবং এখানে। স্ক্রিনশট দেখুন--
প্রসঙ্গত, আজ ১৮ অক্টোবর মূলধারার গণমাধ্যম দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার অনলাইনে, এক তরুণের ফেসবুকে ধর্মীয় অবমাননাকর পোস্টের অভিযোগ তুলে গতকাল (১৭ অক্টোবর) রাত ১০ টার দিকে রংপুরের পীরগঞ্জের বটেরতল মাঝিপাড়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের মন্দির ও বসতবাড়িতে হামলা সম্পর্কিত একটি খবর প্রকাশিত হয়। "কী দোষ করছিলাম, কেন আমাদের সব শেষ করে দিল" শিরোনামে প্রকাশিত প্রথম আলোর ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে--
"রংপুরের পীরগঞ্জের বড়করিমপুর গ্রামের সবার চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ। গ্রামটি ঘিরে রেখেছেন পুলিশ ও বিজিবির সদস্যরা। গতকাল রোববার রাত সাড়ে ১০টার দিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের মন্দির ও বসতবাড়িতে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের পর থেকে বাসিন্দারা আতঙ্কে সময় পার করছেন। আগুনে পুড়ে গেছে ২১টি বাড়ির সবকিছু। এ ঘটনায় আজ সোমবার সকাল পর্যন্ত অন্তত ৩০ জনকে আটক করা হয়েছে।"
সুতরাং ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের একটি পূজামণ্ডপের অগ্নি দুর্ঘটনার ভিডিওকে রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার মন্দিরে অগ্নিসংযোগ বলে সাম্প্রদায়িক ভুয়া দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে ফেসবুকে, যা বিভ্রান্তিকর।
নোট: প্রতিবেদনটি তৈরিতে বুম বাংলাদেশকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন, ভারতের বাংলা ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা বুম বাংলা'র সৃজিত দাস।