সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের একাধিক আইডি পেজ ও গ্রুপ থেকে তিনটি ছবি পোস্ট করে দাবি করা হচ্ছে, ছবিগুলো সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) রাজনীতি বিরোধী চলমান আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্বদানকারী এক নারী শিক্ষার্থীর, যার পরিবার জামায়াত ও শিবিরের রাজনীতির সাথে জড়িত। প্রথম ছবিতে হিজাব পরা এক তরুণীকে হাতে কাগজ দেখে দেখে হ্যান্ড মাইকে কিছু ঘোষণা দিতে দেখা যাচ্ছে, দ্বিতীয় ছবিতে হিজাব ছাড়া এলোচুলে একটি তরুণীকে খাটের উপর বসে পোজ দিতে দেখা যায় এবং তৃতীয় ছবিতে দুই নারীকে লড়াইরত অবস্থায় দেখা যায়। দাবি করা হচ্ছে, তিনটি ছবিই একই নারীর এবং তিনি বুয়েটে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অন্যতম নেতৃত্বদানকারী নারী শিক্ষার্থী মেঘা। এরকম কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
গত ৩১ মার্চ 'Journalist Utpal Das' নামের একটি পেজ থেকে ছবিগুলো পোস্ট করে বলা হয়, "পঞ্চগড় জেলা জামায়াতের সাবেক আমির আব্দুল খালেক এর ভাগ্নি দেবীগঞ্জ উপজেলা শিবিরের সাবেক সভাপতি ও ঢাকা উত্তর জামায়াতের সদস্য আব্দুল আউয়াল রাফির ছোট বোন ও ইসলামী ব্যাংক কর্মকর্তা সোহরাব হোসেনের মেয়ে মেঘা #বুয়েট এর আন্দোলনের একেবারে প্রথম সারিতে 🤔 উল্লেখ্য নিষ্পাপ সাধারণ শিক্ষার্থী টি বুয়েটে ভর্তি হওয়ার পর ৩ টা বয়ফ্রেন্ডের মালিক। বয়ফ্রেন্ডের গার্লফ্রেন্ডের সাথে চুলোচুলির ভিডিও ইতিমধ্যে ভাইরাল হয়েছে। সবাই ওয়াও বলে জাইয়েন কিন্তু!!!"। নিচে পোস্টটির স্ক্রিনশট দেখুন--
ফ্যাক্ট চেক:
বুম বাংলাদেশ যাচাই করে দেখেছে, আলোচ্য দাবিগুলো সঠিক নয়। পোস্টে যুক্ত করা প্রথম ছবিটি বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ক্যাম্পাসে রাজনীতি বিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পক্ষে গণমাধ্যমে ব্রিফিং করা এক নারী শিক্ষার্থীর হলেও দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ছবিটি তার নয়। দ্বিতীয় ছবিটি একাধিক ভিনদেশি এডাল্ট সাইটে পাওয়া গেছে আর তৃতীয় ছবিটি ভিনদেশের কোনো রাস্তায় জনসম্মুখে দুই নারীর লড়াইয়ের একটি ভিডিও থেকে নেয়া স্ক্রিনশট। এছাড়া, পোস্টে উল্লিখিত বুয়েটের ওই নারী শিক্ষার্থীর নাম, পিতার নাম এবং তার ভাই ও মামা সম্পর্কে দেয়া সব তথ্য ভিত্তিহীন বলে সরেজমিন অনুসন্ধানে নিশ্চিত হয়েছে বুম বাংলাদেশ।
পোস্টে যুক্ত ছবিগুলো সম্পর্কে যা জানা যায়:
প্রথম ছবি:
আলোচ্য পোস্টের প্রথম ছবিটি নিয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চ করে কাঙ্ক্ষিত কোনো ফলাফল পাওয়া যায়নি। পরে আলোচ্য ছবিতে বাংলাদেশি গণমাধ্যমের বুম দৃশমান থাকায় এবং পোস্টটি বুয়েট শিক্ষার্থী সম্পর্কিত হওয়ায় সংশ্লিষ্ট কি-ওয়ার্ড সার্চ করে "বুয়েটে ছাত্রলীগের 'প্রবেশ' নিয়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ" শিরোনামে গত ৩০ মার্চ প্রকাশিত বেসরকারি সম্প্রচার মাধ্যম আরটিভির ভেরিফায়েড ইউটিউব চ্যানেলে একটি ভিডিও প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটির ৩৭ সেকেন্ড থেকে এক মিনিট ১২ সেকেন্ড পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে ব্রিফিং দেয়া এক নারী শিক্ষার্থীর সাথে আলোচ্য ছবিটির মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ভিডিওতে নারী শিক্ষার্থীর পোশাক এবং তার পাশে দাঁড়িয়ে হ্যান্ড মাইক ধরে রাখা আরেক আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীর উপস্থিতি থেকে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে, আলোচ্য ছবিটি উক্ত ব্রিফিংয়ের। আরটিভির ইউটিউব চ্যানেলে পাওয়া প্রতিবেদনে ওই নারী শিক্ষার্থীর একটি স্ক্রিনশট দেখুন--
এর সুত্র ধরে আরো কি-ওয়ার্ড সার্চ করে বেসরকারি টেলিভিশন বায়ান্ন টিভির ফেসবুক পেজে বুয়েটে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সেদিনের আন্দোলন ও ব্রিফিং নিয়ে গত ৩০ মার্চ আপলোড করা একটি দীর্ঘ ভিডিও পাওয়া যায়। ভিডিওটির ১৩ তম সেকেন্ডে পাওয়া একটি ফ্রেমের সাথে আলোচ্য ছবিটির হুবহু মিল খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত ভিডিওটির ১৩ তম সেকেন্ডের একটি ফ্রেমের স্ক্রিনশট দেখুন--
এবারে আলোচ্য ছবিটি বামে ও বায়ান্ন টিভির ফেসবুক পেজে পাওয়া ভিডিওটির ১৩ তম সেকেন্ডের একটি ফ্রেমের স্ক্রিনশট থেকে নেয়া সংশ্লিষ্ট অংশ (ডানে) দেখুন পাশাপাশি--
অর্থাৎ ছবিটি ৩০ মার্চ বুয়েটে রাজনীতি বিরোধী আন্দোলনকারী সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে ব্রিফিং করা এক নারী শিক্ষার্থীর। তবে এই দুই ভিডিও থেকে ওই শিক্ষার্থীর নাম পরিচয় জানা যায়নি এবং অন্যান্য গণমাধ্যমেও এ সংক্রান্ত খবরে সার্চ করে তার নাম জানা যায়নি। আলোচ্য পোস্টে দাবি করা হচ্ছে, বুয়েটের এই নারী শিক্ষার্থী, দ্বিতীয় ছবিতে দৃশ্যমান নারী এবং তৃতীয় ছবিতে লড়াইরত দুই নারীর একজন একই ব্যক্তি।
দ্বিতীয় ছবি:
আলোচ্য পোস্টের দ্বিতীয় ছবিটি নিয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চ করে ছবিটি একাধিক এডাল্ট সাইটে খুঁজে পাওয়া গেছে, তন্মধ্যে রাশিয়া ভিত্তিক একটি এডাল্ট সাইটেও ছবিটি পাওয়া গেছে, যেখানে তাকে পাকিস্তানি মেয়ে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নীতিমালা বিবর্জিত হওয়ায় আলোচ্য ছবিটি ব্যতীত অন্যান্য ছবি ও ওয়েবসাইটের লিংক স্ক্রিনশটে ব্লার করে দেয়া হয়েছে এবং এর লিংক এই প্রতিবেদনে সচেতনভাবেই যুক্ত করা হয়নি। রাশিয়ান একটি এডাল্ট সাইট থেকে নেয়া আলোচ্য ছবি সংশ্লিষ্ট একটি স্ক্রিনশট দেখুন--
তৃতীয় ছবি:
ছবিটি নিয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চ করে কোনো কাঙিক্ষত ফলাফল না পেয়ে, কি-ওয়ার্ড সার্চ করে ইউটিউবে "মেয়ে দের ঝগড়া দেখুন না দেকলে মিস কোরবেন" শিরোনামে 'md parveh' নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে নিশ্চিত হওয়া যায়, তৃতীয় ছবিটি উক্ত ভিডিওটি থেকে নেয়া স্ক্রিনশট। ভিডিওটিতে দুজন নারীকে রাস্তার পাশে অসংখ্য মানুষের সামনে মারামারি করতে দেখা যায়, ভিডিওটির ব্যাকগ্রাউন্ডে বিভিন্ন মানুষের বলা কথা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে, ভাষা শুনে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে এটি বাংলা ভাষা নয় কিংবা বাংলা ব্যতিত বাংলাদেশে প্রচলিত উপভাষা ও আদিবাসী ভাষাও নয়। অর্থাৎ ভিডিওটি বাংলাদেশের কোথাও থেকে ধারণ করা নয় বরং ভিন্ন কোনো দেশের ভিন্ন কোনো ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে ঘটা ঘটনার। তবে, সেটি কোন ভাষা কিংবা কোন দেশে ধারণ করা তা নিশ্চিত হতে পারেনি বুম বাংলাদেশ। ফেসবুকে প্রচারিত ছবি (বামে) এবং ইউটিউব থেকে পাওয়া ভিডিওর স্ক্রিনশট (ডানে) দেখুন পাশাপাশি--
অর্থাৎ প্রথম ছবির মেয়েটি বুয়েটে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে গত ৩০ মার্চ গণমাধ্যমে ব্রিফিং করা ছাত্রী। তবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ছবির ব্যক্তি তিনি নন।
পোস্টে দেয়া তথ্য অনুসন্ধান:
আলোচ্য ফেসবুক পোস্টে বুয়েটে রাজনীতি বিরোধী আন্দোলনকারী এক ছাত্রীর ছবি দিয়ে তার নাম, স্থায়ী ঠিকানা, মামা, ভাই এবং তার পিতার ব্যাপারে বিভিন্ন তথ্য দেওয়া হয়েছে। অনলাইন অনুসন্ধানে এ ব্যাপারে কোনো তথ্য না পাওয়ায়, এসব বিষয়ে সরেজমিনে তদন্ত করেছে বুম বাংলাদেশ।
বুম বাংলাদেশের এই ফ্যাক্ট চেকার ও প্রতিবেদক আলোচ্য পোস্টের প্রথম ছবিতে দৃশ্যমান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) রাজনীতি বিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পক্ষে গণমাধ্যমে ব্রিফিং করা এই নারী শিক্ষার্থীকে খুঁজে বের করেছে। পাশাপাশি তার কাছ থেকে তার জন্ম নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র ও বুয়েটের স্টুডেন্ট আইডি কার্ড, তার এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ট্রান্সক্রিপ্টের কপি সংগ্রহ করেছে। আলোচ্য পোস্টে দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওই শিক্ষার্থী ও তার বাবার সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। এরপর নির্ভুল তথ্য যাচাইয়ের স্বার্থে তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত সব তথ্য তৃতীয় মাধ্যম থেকে ক্রসচেক করে দেখা হয়েছে। নিরাপত্তার স্বার্থে এই নারী শিক্ষার্থী তিনি তার নাম, পরিচয় ও ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানানোয়, এই প্রতিবেদনে তা উল্লেখ করা হচ্ছে না। তবে এসব তথ্য বুম বাংলাদেশের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে আলোচ্য পোস্টের দাবিগুলো নিচে ধারাবাহিকভাবে খণ্ডন করা হচ্ছে।
প্রথমত, আলোচ্য পোস্টে উল্লেখ্য করা হয়েছে মেয়েটির নাম মেঘা। যা মেয়েটির জাতীয় পরিচয়পত্র, বুয়েটের স্টুডেন্ট আইডি কার্ড এবং এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ট্রান্সক্রিপ্ট অনুযায়ী সঠিক নয়। এছাড়া, তিনি ও তার বাবার পাশাপাশি তার সহপাঠীদের দেয়া তথ্যে নিশ্চিত হওয়া গেছে তার ডাক নামও মেঘা নয়।
দ্বিতীয়ত, আলোচ্য পোস্টে তাঁর স্থায়ী ঠিকানা পঞ্চগড় জেলার দেবিগঞ্জ উপজেলা দাবি করা হলেও তাঁর জন্ম নিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী তার বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা ঢাকা। তার জন্ম এবং বেড়ে উঠাও ঢাকায় এবং ঢাকার একটি স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাশ করে বর্তমানে তিনি বুয়েটে অধ্যয়ন করছেন।
তৃতীয়ত, আলোচ্য পোস্টে এই নারী শিক্ষার্থীর মামা পঞ্চগড় জেলা জামায়াতের সাবেক আমির আব্দুল খালেক দাবি করা হলেও, যাচাই করে দেখা গেছে প্রকৃতপক্ষে তার কোনো মামাই নেই।
চতুর্থত, আলোচ্য পোস্টে তার বড় ভাই হিসেবে দেবীগঞ্জ উপজেলা শিবিরের সাবেক সভাপতি ও ঢাকা উত্তর জামায়াতের সদস্য আব্দুল আউয়াল রাফির নাম উল্লেখ করা হলেও, যাচাই করে দেখা গেছে প্রকৃতপক্ষে পরিবারে তার কোনো বড় ভাই নেই। একজন ছোট ভাই আছেন, যিনি ঢাকায় অবস্থিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করে বর্তমানে একই প্রতিষ্ঠান বুয়েটেই পড়াশোনা করছেন।
পঞ্চমত, পোস্টে উল্লেখিত তার বাবার পরিচয় হিসেবে ইসলামী ব্যাংক কর্মকর্তা সোহরাব হোসেন নামের এক ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা হলেও, বুম বাংলাদেশের প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত অনুযায়ী তার বাবার নাম সোহরাব হোসেন নয় বরং সম্পূর্ণ ভিন্ন নাম। এছাড়া, তিনি ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তা দাবি করা হলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি ব্যাংকিং খাতেই কাজ করেন না বরং নন-ব্যাংকিং খাতের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
এছাড়া, বুম বাংলাদেশের কাছে এই নারী শিক্ষার্থী আলোচ্য পোস্টের পরবর্তী দুটি ছবি তার নয় বলেও জানিয়েছেন। তার সহপাঠীরাও জানিয়েছেন, দ্বিতীয় ছবির তরুণীর সাথে এই শিক্ষার্থীর চেহারার কোনো মিল নেই। স্বাভাবিকভাবেই সহপাঠীরাই দুয়েক বছর আগে একজন সহপাঠী দেখতে কেমন ছিলেন, তা সহজে চিহ্নিত করতে পারেন।
অর্থাৎ বুয়েটে আন্দোলনকারী নারী শিক্ষার্থীর দাবিতে পোস্ট করা ছবিগুলোর দ্বিতীয় ও তৃতীয় ছবিটি তার নয়। এছাড়া তার ব্যাপারে পোস্টে উল্লিখিত সব তথ্য ভিত্তিহীন বলে বুম বাংলাদেশের সামগ্রিক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
সুতরাং বুয়েটের আন্দোলনকারী এক নারী শিক্ষার্থীকে নিয়ে ফেসবুকে ভিত্তিহীন তথ্য সহ ভুয়া ছবি পোস্ট করা হচ্ছে, যা বিভ্রান্তিকর।