সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকের একাধিক আইডি, পেজ ও গ্রুপ থেকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও সাথে তার সহধর্মিনী রাহাত আরা বেগমের ছবি সংযুক্ত করা একটি চেক পোস্ট করা হচ্ছে। যেখানে দাবি করা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য মির্জা ফখরুলকে পঞ্চাশ লাখ টাকা দিয়ে সাহায্য করা হয়েছে। এরকম কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
গতকাল ২৭ আগস্ট 'Rocky Kumar Ghosh' নামের একটি আইডি থেকে ছবিটি পোস্ট করে দাবি করা হয়, "এইটা কি হলো ফকরুল কাকা, এটা আমরা মেনে নিতে পারছি না!"। ছবিটির নিচের অংশে লেখা রয়েছে- প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে চিকিৎসা সহায়তা নিয়ে বিদেশ ভ্রমণে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। নিচে পোস্টটির স্ক্রিনশট দেখুন--
ফ্যাক্ট চেক:
বুম বাংলাদেশ যাচাই করে দেখেছে, আলোচ্য পোস্টে চেকের ছবিটি এডিটেড। করোনাকালীন সময়ে আইনজীবী প্রণোদনা তহবিল থেকে ঢাকা আইনজীবী সমিতিকে দেওয়া সোনালী ব্যাংকের একটি চেক এডিট করে আলোচ্য চেকটি তৈরি করা হয়েছে।
চেকটির উৎস
রিভার্স ইমেজ সার্চ করে আলোচ্য পোস্টের চেকটির অরিজিনাল ভার্সন বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ওয়েবসাইটে "ঢাকা আইনজীবী সমিতিকে ছয় কোটি সত্তর লক্ষ পনের হাজার আটশত পঁচাত্তর টাকার আইনজীবী প্রণোদনার চেক প্রদানের মাধ্যমে বার কাউন্সিল হতে প্রণোদনা অর্থ বিতরণ শুরু হল" শিরোনামে খুঁজে পাওয়া যায়। চেকটি বাংলাদেশ বার কাউন্সিল হতে আইনজীবীদের করোনাকালে প্রণোদনার অংশ হিসেবে 'আইনজীবী প্রণোদনা তহবিল' নামের একটি একাউন্ট থেকে ঢাকা আইনজীবী সমিতিকে প্রদান করা হয়। স্ক্রিনশট দেখুন--
ওয়েবসাইট থেকে নেয়া চেকের ছবিটি আলাদাভাবে দেখুন--
একইভাবে সার্চ করে বাংলাদেশের আইন বিষয়ক অনলাইন পোর্টাল লইয়ার্সক্লাব বাংলাদেশ (lawyersclubbangladesh.com)-এ "৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা প্রণোদনা পেল ঢাকা বারের আইনজীবীরা" শিরোনামে ২০২২ সালের ২৪ মে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনেও চেকটি খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, "করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত আইনজীবীদের সাহায্যার্থে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে বার কাউন্সিলের আইনজীবী প্রণোদনা তহবিলে দেওয়া ২০ কোটি টাকা আইনজীবীদের মধ্যে বিতরণ শুরু হয়েছে। ঢাকা আইনজীবী সমিতিকে ছয় কোটি সত্তর লক্ষ পনের হাজার আটশত পঁচাত্তর টাকার আইনজীবী প্রণোদনার চেক প্রদানের মাধ্যমে সোমবার (২৩ মে) বার কাউন্সিল হতে প্রণোদনা অর্থ বিতরণ শুরু হয়।"
চেক দুটির মধ্যে তুলনামূলক সাদৃশ্য
বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ওয়েবসাইট ও লইয়ার্সক্লাব বাংলাদেশের প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত চেক ও ফেসবুকে আলোচ্য ভাইরাল চেক দুটির মধ্যে অন্তত তিনটি স্থানে হুবহু মিল রয়েছে। চেকটির উপরে ডানপাশে উল্লেখিত চেক নম্বর (১), চেকে দুটি স্বাক্ষর (২) এবং চেকের নিচে ম্যাগনেটিক ইংক ক্যারেক্টার রিকগনিশন বা MICR কোড (৩) যেখানে বিশেষায়িত প্রযুক্তিতে চেক নম্বর, রাউটিং নম্বর ও সংশ্লিষ্ট একাউন্ট নম্বর পাশাপাশি একটু স্পেস দিয়ে উল্লেখ থাকে তাতে হুবহু মিল রয়েছে। অরিজিনাল চেকটি (উপরে) ও ভাইরাল চেকটির (নিচে) মধ্যে তুলনামূলক মিল দেখুন--
চেক দুটির মধ্যে বৈসাদৃশ্য
চেক দুটি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল থেকে ঢাকা আইনজীবী সমিতিকে দেয়া চেকটির অন্তত নয়টি স্থানে এডিট করে ফেসবুকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নামে ভাইরাল চেকটি তৈরি করা হয়েছে। সোনালী ব্যাংকের উক্ত চেকটির শাখার নাম (১), ইস্যু তারিখ (২), রাউটিং নম্বর (৩), প্রাপকের নাম (৪), টাকার পরিমাণ কথায় (৫), টাকার পরিমাণ অংকে (৬), একাউন্টের নাম (৭), একাউন্ট নম্বর (৮) ও দুটি স্বাক্ষরের নীচে দেওয়া সীল (৯), এই নয়টি স্থানে এডিট করে পরিবর্তন করা হয়েছে। চেকটি কোথায় কোথায় এডিট করে কী কী পরিবর্তন আনা হয়েছে তা বুঝতে নিচে দেয়া দুটি চেকের মধ্যে তুলনা দেখুন (উপরের চেকটি অরিজিনাল ও নিচের চেকটি এডিটেড)--
আলোচ্য চেকের মধ্যে অসঙ্গতি
এবারে বুম বাংলাদেশের বিশ্লেষণে আলোচ্য চেকটির মধ্যে কয়েকটি অসঙ্গতিও ধরা পড়েছে। ব্যাংকের চেকে চেক নম্বর, রাউটিং নম্বর ও একাউন্ট নম্বর ভিন্ন ভিন্ন স্থানে উল্লেখ থাকে এবং চেকের নিচে ম্যাগনেটিক ইংক ক্যারেক্টার রিকগনিশন বা MICR কোডে বিশেষায়িত প্রযুক্তিতে এই তিনটি নম্বর পাশাপাশি একটু স্পেস দিয়ে পুনরায় উল্লেখ থাকে। এখানে দেখা যাচ্ছে, কেবল চেক নম্বরটি (নীল রংয়ে ব্লক করা) MICR কোডে মিল রয়েছে। এছাড়া, রাউটিং নম্বর ও একাউন্ট নম্বর দুটি ভিন্ন। অর্থাৎ উপরে পৃথকভাবে লেখা রাউটিং নম্বর ও একাউন্ট নম্বরটি এডিট করা হয়েছে। দেখুন--
এদিকে আলোচ্য চেকের তথ্য অনুযায়ী চেকটি সোনালী ব্যাংকের তেজগাঁও ব্রাঞ্চের। কি-ওয়ার্ড সার্চ করে সোনালী ব্যাংকের 'তেজগাঁও ব্রাঞ্চ' নামের কোনো ব্রাঞ্চের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তবে 'তেজগাঁও ইডাস্ট্রিয়াল এরিয়া ব্রাঞ্চ' নামে সোনালী ব্যাংকের একটি ব্রাঞ্চ রয়েছে। ব্যাংকবিডি ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী ব্রাঞ্চটির রাউটিং নম্বর 200264512 যদিও চেকের মধ্যে রাউটিং নম্বর উল্লেখ করা 200276678. এছাড়া, ভাইরাল চেকে উল্লেখিত এই রাউটিং নম্বরের সাথে মিল রয়েছে সোনালী ব্যাংকের কোনো ব্রাঞ্চ খুঁজে পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ রাউটিং নম্বরটি বানোয়াট। স্ক্রিনশট দেখুন--
কী বলছে গণমাধ্যম
কি-ওয়ার্ড সার্চ করে প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কোনো অনুদান নেয়ার সংবাদ গণমাধ্যমে খুঁজে পাওয়া যায়নি। বরং প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে মির্জা ফখরুল চিকিৎসা সহায়তা নিয়ে বিদেশ ভ্রমণে গেছেন এমন গুজব সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হলে, এটি গুজব হিসেবে চিহ্নিত করে খবর প্রকাশ করে কয়েকটি গণমাধ্যম। “ফখরুল বললেন- এই নোংরামির শেষ কোথায়?“ শিরোনামে মানবজমিন, “প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল : ফখরুলের সাহায্য নেওয়ার খবর ভিত্তিহীন“ শিরোনামে ঢাকাপোস্ট, “প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে সাহায্য নেননি ফখরুল“ শিরোনামে ভোরের কাগজ পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এসব গণমাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে মির্জা ফখরুলের সাহায্য নেয়ার বিষয়টি ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করা হয়।
বিএনপির বক্তব্য
এ বিষয়ে জানতে বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বুম বাংলাদেশকে বলেন, "সরকার গুজব ছড়াচ্ছে। তারা আমাদের মহাসচিবকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে নকল চেক বানিয়ে সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করছে।"
অর্থাৎ কারোনাকালে আইনজীবী প্রণোদনা তহবিল নামের সোনালী ব্যাংকের একটি একাউন্ট থেকে ঢাকা আইনজীবী সমিতির নামে ইস্যু করা একটি চেক এডিট করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে চিকিৎসা সহায়তা নিয়ে বিদেশ ভ্রমণ করছেন বলে প্রচার করা হচ্ছে।
সুতরাং একটি এডিটেড চেক জুড়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে মির্জা ফখরুলকে চিকিৎসা নিয়ে বিদেশ ভ্রমণ করছেন বলে যে দাবি করা হচ্ছে ফেসবুকে, তা ভিত্তিহীন ও বিভ্রান্তিকর।