সাবেক সেনা কর্মকর্তা হত্যা মামলার আসামি টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাসের কয়েকটি ছবি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এর মধ্যে দুটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, শেখ হাসিনা প্রদীপ কুমার দাসকে পদক পরিয়ে দিচ্ছেন। অন্য একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে খালেদা জিয়া প্রদীপকে পদক পরাচ্ছেন।
এর মধ্যে খালেদা জিয়া কর্তৃক প্রদীপ কুমার দাসকে পদক পরিয়ে দেয়ার ছবিকে ভুয়া এবং এডিট করা বলে দাবি করা হচ্ছে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান তার একটি ফেসবুক পোস্টে দাবি করেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কর্তৃক পুলিশ কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার দাসের গলায় পদক পরিয়ে ছবিটি ভুয়া এবং এডিট করা।
তিনি লিখেছেন--
"বাজারে ছাড়ে, যে ছবিতে দেখা যাচ্ছে যে, খালেদা জিয়াও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রদীপকে পদক পরিয়ে দিচ্ছেন। কোনো যাচাই বাছাই ছাড়াই এই ছবি কোনো কোনো পত্রিকা নামের ব্যাঙের ছাতায় ছাপা হয়। জালিয়াতরা ফেসবুকেও ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে দেয় এই ছবি।"
ছবিটিকে ভুয়া দাবি করে তিনি আরও লিখেছেন--
"আমি এই পোস্টে তিনটি ছবি দিয়েছি। প্রথম ছবিতে প্রদীপকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিপিএম পদক পরিয়ে দিচ্ছেন। দ্বিতীয় ছবিতেও শেখ হাসিনা পিপিএম পদক পরিয়ে দিচ্ছেন প্রদীপকে। এই দ্বিতীয় ছবিটি খুব ভালো করে দেখুন। হুবহু একই ফর্মেটের ওই ছবিটি এডিট করে তৃতীয় ভুয়া ছবিটি বানিয়েছে জালিয়াতরা।
এই ভুয়া ছবিটিতে বেগম জিয়া ছাড়াও উনার হোম মিনিস্টার এয়ার ভাইস মার্শাল (অবঃ) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও আইজিপি মুদাব্বির হোসাইন চৌধুরী আছেন। মুদাব্বির চৌধুরী ২০০১ সালের নবেম্বরে আইজি হন এবং ২০০৩ সালের ২২ এপ্রিল পর্যন্ত এ পদে ছিলেন। তিনি দু'বছর পুলিসের পদক বিতরণ অনুষ্ঠানে আইজি হিসেবে উপিস্থিত থাকতে পেরেছেন। সে সময় সাব-ইন্সপেক্টর প্রদীপ কোনো পদক পেয়েছে কী? পেয়ে থাকলে তো জেনুইন ফটোই থাকার কথা, জালিয়াতির দরকার পড়তো না। আর না পেয়ে থাকলে এই ফটো এলো কোত্থেকে? জালিয়াতরা এডিট করে বানিয়েছে।
২০০২ কিংবা '০৩ সালের পুলিস সপ্তাহে পদক বিতরণ অনুষ্ঠানের ছবি থেকে খালেদা জিয়া ও অন্যদের কেটে তুলে এনে প্রদীপকে শেখ হাসিনার পদক পরিয়ে দেয়ার ছবির ফর্মেটে বসিয়ে দেয়া হয়েছে এডিট করে। ব্যস হয়ে গেলো প্রোপাগান্ডা ম্যাটেরিয়াল। জালিয়াতরা বলা শুরু করলো: এই নেন প্রমান। প্রদীপ বিএনপির লোক।"
তার ফেসবুক পোস্টটি দেখুন এখানে। আর্কাইভ করা আছে এখানে।
মারুফ কামাল খানের পোস্টটি কিছু অংশ দেখুন নিচের স্ক্রিনশটগুলোতে--
এই পোস্টটি আরও বেশ কিছু ফেসবুক একাউন্ট ও পেইজে প্রকাশ করা হয়েছে। তেমন কয়েকটি দেখুন এখানে, এখানে ও এখানে।
যদিও বুম বাংলাদেশ-এর অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, মারুফ কামালের দাবি সত্য নয়। অর্থাৎ, খালেদা জিয়া প্রদীপ দাসকে পদক পরিয়ে দেয়ার ছবিটি ভুয়া নয়।
২০০৩ সালের জানুয়ারি মাসের ১১ তারিখ আগের বছরের (২০০২ সাল) 'বাংলাদেশ পুলিশ পদক' ও 'প্রেসিডেন্ট পুলিশ পদক' বিতরণ করা হয়। বিতবরণ অনুষ্ঠানে খবর পরদিন ১২ জানুয়ারি দেশের শীর্ষ সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত হয়।
১২ জানুয়ারি ২০০৩ এর ইনকিলাবের প্রথম পাতায় পদক বিতরণ সংক্রান্ত খবর দেখুন নিচের ছবিতে--
এই খবরে দেখা যাচ্ছে, ২০০৩ সালের পুলিশ পদক বিতরণ অনুষ্ঠানে তখনকার আইজিপি মোদাব্বির হোসেন চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। যদিও মারুফ কামাল খানের পোস্টে বলা হয়েছে তিনি উপস্থিত ছিলেন না।
এছাড়া একই অনুষ্ঠানে তখকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া পুলিশ সদস্যদেরকে পদক পরিয়ে দেয়ার ছবি দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ, ওই বছরের অনুষ্ঠানে যারা পদক পেয়েছিলেন (৩৭ জন) তাদেরকে পদক পরিয়ে দিয়েছেন খালেদা জিয়া। ডেইলি স্টার, ডেইলি অবজার্ভার, দৈনিক যুগান্তর ও দৈনিক ইনকিলাব- এই চারটি পত্রিকায় পদক পরিয়ে দেয়ার যেসব ছবি প্রকাশিত হয়েছিল তার মধ্যে ওসি প্রদীপ কুমার দাসের ছবি ছিলো না।
তবে ওই অনুষ্ঠান পদকপ্রাপ্তদের তালিকায় প্রদীপ কুমার দাসও ছিলেন। এ বিষয়ে দৈনিক ইনকিলাবের একটি প্রতিবেদন দেখুন নিচের ছবিতে--
দৈনিক যুগান্তরে একই অনুষ্ঠানের খবর দেখুন--
খালেদা জিয়ার ভাইরাল হওয়া ছবিটি এডিট করা নয়:
মারুফ কামাল খানের পোস্টে দাবি করা হয়েছে, "২০০২ কিংবা '০৩ সালের পুলিস সপ্তাহে পদক বিতরণ অনুষ্ঠানের ছবি থেকে খালেদা জিয়া ও অন্যদের কেটে তুলে এনে প্রদীপকে শেখ হাসিনার পদক পরিয়ে দেয়ার ছবির ফর্মেটে বসিয়ে দেয়া হয়েছে এডিট করে।"
বুম বাংলাদেশ অনলাইন টুল ব্যবহার করে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছে যে, এটি দুইটি আলাদা ছবির কাটা অংশ জুড়ে দিয়ে তৈরি নয়।
'কালো বাক্সে' শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি নয়, পুলিশের মনোগ্রাম:
মারুফ কামাল খানের ফেসবুক পোস্টে দাবি করা হয়েছে--
"এডিট করে বানানো তিন নম্বর ছবিটা খুব ভালো করে দেখুন। অন্য ছবি থেকে খালেদা জিয়াদের কেটে এনে প্রদীপকে হাসিনার পদক প্রদানের ছবির ফর্মেটে বসানো হলেও একটা আলামত এডিট করতে ভুল করে ফেলেছে জোচ্চরেরা।
ভাইয়েরা আমার! ছবিতে খালেদা জিয়ার ঠিক পেছনে কালো বাক্সের মতো যে বস্তুটা আছে সেটা ভালো কৈরা খিয়াল করেন। দেখেন কালা বাক্সোটার গায়ে ছাপ মারা আছে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের ফটো। খালেদা জিয়ার আমলে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে শেখ সাহেবের ফটো লাগাবার কোনো চল নিশ্চয়ই ছিলনা। আসলে এডিট করার সময় শেখ হাসিনার অনুষ্ঠানের ছবির ফরমেট থেকে উনার ফটোটা মুছে দিতে ভুলে গিয়েছিল এই বিখ্যাত নকলবাজেরা।"
কিন্তু ছবিটির বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, 'কালো বাক্স' বলে অভিহিত বস্তুটি টেবিলের ওপর রাখা 'টেবিল ক্লথ'। এবং টেবিল ক্লথের ঝুলানো অংশ যে গোল বস্তুটি অঙ্কিত দেখা যাচ্ছে তা শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি নয়, বরং পুলিশের মনোগ্রাম। উপরে যুগান্তর ও ইনকিলাবে ছবিগুলো লক্ষ্য করুন, একই টেবিলের ওপর একই রঙের টেবিল ক্লথ দেখা যাচ্ছে। যদিও মনোগ্রামটি খালেদা জিয়ার আড়ালে পড়ে।
এছাড়া পত্রিকার ছবি এবং ভাইরাল হওয়া ছবিতে খালেদা জিয়ার পরনে একই রঙ্গের শাড়ি দেখা যাচ্ছে।
নিচের ছবি দুটি দেখুন-
ছবিটি realme 6 Pro মোবাইল সেট দিয়ে ২০০৩ সালে তোলা হয়নি:
মারুফ কামাল খানের পোস্টে বলা হয়েছে--
"বিশেষ দ্রষ্টব্য : অল্প পানিতে খলবলানো এইসব ব্যর্থ নকলবাজরা ক্যামেরাও বোঝে না। দুই ও তিন নম্বর ছবির বামদিকের নিচের কোণায় তাকান। একই ক্যামেরায় তোলা অভিন্ন ফটো। সেখানে উঠে আছে সব প্রমাণ। R 64 MP AI QUAD CAMERA এবং তার নিচের লাইনে Shot on realme 6 Pro লেখা পরিষ্কার দু'টোতেই। পড়তে পাচ্ছেন? বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতা ছেড়েছেন ১৪ বছর আগে। আজ থেকে ১৪/১৫ বছর আগেকার সে-সময়ে ৬৪ মেগাপিক্সেল realme 6 pro ক্যামেরাঅলা স্মার্টফোন কি বেরিয়েছিল? অবশ্যই না। তাহলে যে ফোন তখন ছিলই না, সেই ফোনের ক্যামেরায় উনার পদক বিতরণ অনুষ্ঠানের ছবি কিভাবে উঠলো? নকল করার সময় ক্যামেরার মডেল ও নামধাম যে মুছতে হয়, এই জালিয়াতরা দেখি সেই সামান্য ব্যাপারটাও জানেনা ও বুঝেনা।"
এই দাবিটিও সত্য নয়।
কিন্তু খালেদা শেখ ও শেখ হাসিনার ছবি দুটো পাশাপাশি রাখলে স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে, ছবি দুটো কোনো দেয়ালে ঝুলানো ফ্রেইমের ছবি। অর্থাৎ, খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার কাছ থেকে প্রদীপ দাসের পদকপ্রাপ্তির ছবি কেউ কোনো দেয়ালে ফ্রেইমের মধ্যে ঝুলিয়ে রেখেছিলো। সেই ফ্রেইমগুলোর ছবি উঠানো হয়েছে realme 6 Pro মোবাইল ফোন সেট দিয়ে। পাশেই ছবিগুলো তোলার রাখি দেখা যাচ্ছে "০৮/০৮/২০২০"। ওসি প্রদীপের আত্মসমর্পণের দুই দিন পর ছবিগুলো তোলা।