সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকের একাধিক আইডি ও পেজ থেকে একটি ছবি পোস্ট করে দাবি করা হচ্ছে, ছবিটি কুমিল্লার হাফেজ রবিউল ইসলাম নামের এক ব্যক্তির। তবে ছবিটি কোন ঘটনার সে সম্পর্কে কোনো তথ্য দেয়া হয়নি। পোস্ট করা ছবিটিতে রক্তাক্ত এক তরুণকে দেখতে পাওয়া যায়। এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
গত ১৮ অক্টোবর "محمد طارق أحمد" নামের একটি ফেসবুক আইডি থেকে ছবিটি পোস্ট করে বলা হয়, "(হাফিজ রবিউল ইসলাম কুমিল্লা) ভাই,চলে গেলেন, ইনশাআল্লাহ দেখা হবে কেয়ামতের ময়দানে।আপনার রক্তের বদলা আমরা নেবো,যদি আমরা নিতে না পারি সন্তানকে বলে যাবো। ইনশাআল্লাহ কথা দিলাম........" ছবিটি কয় তারিখের বা কোনো ঘটনার সে সম্পর্কে কোনো তথ্য পোস্টটিতে দেয়া হয়নি। তবে সাম্প্রতিক তারিখে ছবিটি পোস্ট করার ফলে মনে হতে পারে পূজামণ্ডপে সাম্প্রদায়িক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ঘটনার সাথে এর কোনো সম্পর্ক আছে।
ফ্যাক্ট চেক
বুম বাংলাদেশ যাচাই করে দেখেছে, রক্তাক্ত তরুণের ছবিটি সাম্প্রতিক নয়। বিগত বছরে বিভিন্ন সময় ছবিটি সামাজিক মাধ্যম ও ব্লগস্পটে খুঁজে পাওয়া গেছে।
রিভার্স ইমেজ সার্চ করার, ভাইরাল ছবিটি একাধিক ওয়েবপোর্টাল এবং ব্লগস্পটে খুঁজে পাওয়া গেছে। তন্মধ্যে, বিডি২৪লাইভ ডটকম নামের একটি ওয়েব পোর্টালে "শাপলা চত্বরের ২ বছর!" শিরোনামে খবরের সাথে ছবিটি যুক্ত করতে দেখা যায়, যার প্রকাশের তারিখ ২০১৫ সালের ৫ মে। তবে ছবিটির চিত্রগ্রাহক বা আহত ব্যক্তি সম্পর্কে কোনো তথ্য ওয়েবপোর্টালটিতে দেয়া হয়নি। স্ক্রিনশট দেখুন--
ছবিটি বাংলা ভাষার ব্লগ 'সামহোয়্যার ইন' এর একটি ব্লগে পোস্ট করতে দেখা যায় ২০১৩ সালের ১৩ ই মে। ব্লগ পোস্টটির আর্কাইভ দেখুন এখানে। স্ক্রিনশট দেখুন--
অর্থাৎ রক্তাক্ত তরুণের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া না গেলেও ছবিটি যে সাম্প্রতিক নয় তা প্রমাণিত।
পূর্বের বছরগুলোতে সামাজিক মাধ্যমে ছবিটি ছড়িয়েছে দুইভাবে। কোনো কোনো পোস্টে কেবল রক্তাক্ত এই তরুণের ছবি দিয়ে দাবি করা হচ্ছে, ছবিটিতে দেখতে পাওয়া ব্যক্তি হাফেজ রবিউল ইসলাম। আবার কিছু পোস্টে পাঞ্জাবি-টুপি পরা এক তরুণের ছবিও যুক্ত করা হয়েছে। পোস্ট দুইটি দেখুন এখানে ও এখানে। পোস্টের স্ক্রিনশট পাশাপাশি দেখুন-
রক্তাক্ত তরুণের ছবি আমরা আগেই খুঁজে পেয়েছি। ছবিটি অন্তত ৭ বছর পুরানো।
সার্চ করার পর পাঞ্জাবী টুপি পরিহিত তরুণের ছবিও ট্যাবলয়েড মানবজমিন অনলাইনের-এর একটি প্রতিবেদনে খুঁজে পাওয়া গেছে। 'রমজানের খতমে তারাবির জন্য ইমাম নির্বাচিত হয়েছি' শিরোনামে চলতি বছরের ২৮ মার্চ প্রকাশিত উক্ত প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, "
'মা আমি চাটখিলের একটি মসজিদে ইন্টারভিউ দিয়ে রমজানের খতমে তারাবির জন্য ইমাম নির্বাচিত হয়েছি। গতকাল আমার পরীক্ষা শেষে রোববার বাড়ি ফিরবো।' গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের হাটহাজারী থেকে শেষবারের মতো মাকে ফোন দিয়ে এ কথাগুলো বলেছিল কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার উত্তর হাওলা ইউনিয়নের বরল্লা গ্রামের আবদুল জব্বারের মেজো ছেলে হাফেজ রবিউল হোসাইন। নিয়তির নির্মম পরিহাসে আর বাড়ি ফেরা হলো না তার! সে গত শুক্রবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনের প্রতিবাদে হাটহাজারীতে মুসল্লিদের বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশের ছোড়া গুলিতে নিহত হয়েছে।
রবিউল হোসাইনের আকস্মিক মৃত্যুর খবরে স্বজনদের বুকফাটা আর্তনাদ ও শোকে এলাকার আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। শান্ত, সদালাপী ও মিষ্টভাষী রবিউলের নির্মম মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি এলাকাবাসী ও স্বজনরা। রাজমিস্ত্রি পিতার ৪ সন্তানের সংসারে হাফেজ রবিউল হোসাইন দ্বিতীয়। তার অপর দুই ভাইও পবিত্র কোরআনের হাফেজ। স্বজনরা জানান, সে দীর্ঘদিন ধরে পড়াশোনার পাশাপাশি নোয়াখালীর চাটখিলের একটি মসজিদে ইমামতি করতো। দাওরায়ে হাদীস পরীক্ষা দিতে গত ১৭ই মার্চ সে হাটহাজারী দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয়।
গত ২৫শে মার্চ রবিউলের সঙ্গে তার মায়ের সর্বশেষ কথা হয়। ২৭শে মার্চ পরীক্ষা শেষ হলে ২৮শে মার্চ বাড়ি ফিরবে বলে মাকে জানায় রবিউল। এরমধ্যে ২৬শে মার্চ শুক্রবার জুমার নামাজের পর হাটহাজারীতে মুসল্লিদের বিক্ষোভে পুলিশের ছোড়া গুলিতে নিহত হয় রবিউল।" স্ক্রিনশট দেখুন-
অর্থাৎ এই ছবিই কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার হাফেজ রবিউল হোসাইন নামের এক তরুণের যিনি গত মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনের প্রতিবাদে হাটহাজারীতে মুসল্লিদের বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশের ছোড়া গুলিতে নিহত হন। যার মানে কুমিল্লার বাসিন্দা হাফেজ রবিউল হোসাইন (ইসলাম নয়) নামের এক ব্যক্তি হাটহাজারীতে নিহত হন গত মার্চ মাসে। তবে ছবির রক্তাক্ত তরুণ হাফেজ রবিউল নন। বরং রক্তাক্ত ছবিটি অন্তত ৭ বছর আগেও সামাজিক মাধ্যম ও ব্লগস্পটে দেখা গিয়েছে।
সুতরাং, অন্তত ৭ বছর পুরোনো একটি ছবি ভুল নামে সাম্প্রতিক তারিখে কুমিল্লায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার মাঝে ছড়ানো হচ্ছে, যা বিভ্রান্তিকর।