১ মে বাংলাদেশের কিছু সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, সৌদি আরব মক্কার মসজিদুল হারাম ও মদিনার মসজিদে নববী উন্মুক্ত করে দিয়েছে।
বাংলানিউজের সংবাদের শিরোনাম, "মসজিদুল হারাম-নববী খুলে দিল সৌদি"।
ভোরের কাগজের শিরোনাম, "মসজিদুল হারাম-নববী খুলে দিল সৌদি আরব"।
জনকণ্ঠের শিরোনাম, "করোনা : মসজিদুল হারাম-নববী খুলে দিল সৌদি"।
ঢাকাটাইমসের শিরোনাম, "খুলে দেয়া হলো মসজিদুল হারাম ও নববী"।
বিডিজার্নাল নামে পোর্টালের শিরোনাম, "খুলে দেয়া হলো মসজিদুল হারাম ও নববী"।
বিবার্তা নামক একটি পোর্টালের শিরোনাম, "খুলে দেয়া হলো মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববী"।
বাংলানিউজের প্রতিবেদনের প্রথম কয়েক প্যারা এখানে তুলে দেয়া হলো--
"অবশেষে খুলে দেওয়া হচ্ছে সৌদি-আরবের সবচেয়ে বড় দুই মসজিদ মক্কার মসজিদ-আল-হারাম ও মদিনার মসজিদ-আল-নববী। প্রায় এক মাস ১০ দিন পর আবার মুসল্লিরা একসঙ্গে নামাজ আদায় করবেন।
করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে গত ২০ মার্চ থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য এই মসজিদ দু'টি বন্ধ করে দেয় সৌদি কর্তৃপক্ষ। শুক্রবার (০১ মে) থেকে আবার খুলে দেওয়া ঘোষণা দেয় সৌদি হজ এবং ওমরাহ মন্ত্রণালয়।"
এখানে উল্লেখ্য, উপরের সবক'টি প্রতিবেদনের তথ্য এবং একাধিক প্যারা হুবহু পরস্পরের সাথে মিলে যায়।
ফ্যাক্ট চেক:
বাংলানিউজ তাদের প্রতিবেদনে "সৌদি হজ এবং ওমরাহ মন্ত্রণালয়" এর বরাত উল্লেখ করেছে। যদিও সৌদি হজ এবং ওমরাহ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
সৌদি হজ এবং ওমরাহ মন্ত্রণালয়ের টুইটার একাউন্ট থেকে সর্বশেষ ২৮ এপ্রিল টুইট করা হয়েছে; যেখানে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে যে, শিগগিরই হারামাইন উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। কিন্তু টুইটে সরাসরি কোনো তারিখ বলা হয়নি যে, কবে উন্মুক্ত করা হবে।
এছাড়া মধ্যপ্রাচ্য বা সৌদি আরবের নির্ভরযোগ্য কোনো সংবাদমাধ্যমে এমন কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে ভোরের কাগজের প্রতিবেদনের শেষে লেখা রয়েছে- "সূত্র: মিডলইস্ট মিরর, ডেইলি টাইমস পিকে"।
গুগল সার্চ করে www.mideast-mirror.com নামে যে ওয়েবসাইটটি পাওয়া যায় সেটিতে মসজিদুল হারামাইন খুলে দেয়া সংক্রান্ত কোনো খবর পাওয়া যায়নি। এই ওয়েবসাইটটি সাধারণ সংবাদমাধ্যম বলতে যা বোঝায় তা নয়, বরং এটি একটি 'নিউজ এগ্রিগেটর' সাইট; যারা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বাছাই করা কিছু সম্পাদকীয়/উপসম্পাদকীয় এর নিজেরা পুনঃপ্রকাশ ও বিশ্লেষণ করে।
middleeastmonitor.com নামে একটি সংবাদমাধ্যমে মসজিদুল হারাম ও নববী খুলে দেয়া সংক্রান্ত খবরটি পাওয়া গেছে। শিরোনাম, "Saudi Arabia to reopen holy mosques in Makkah and Madinah 'in days'.
শিরোনাম থেকেই স্পষ্ট যে, মসজিদ দুটি 'খুলে দেয়া হয়েছে' এমন তথ্য দেয়া হয়নি এখানে। বরং বলা হয়েছে, 'কিছু দিনের মধ্যে খুলে দেয়া হবে'।
প্রতিবেদনের ভেতরেও তা-ই বলা হয়েছে। কাবা শরীফের ইমাম এবং হারামাইন শরীফের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের (General Presidency) প্রধান আবদুর রহমান আল সুদাইসের একটি বক্তব্যের ওপর প্রতিবেদনটি তৈরি।
middleeastmonitor.com এর প্রতিবেদন থেকে একটি প্যারা উদ্ধৃত করা হলো--
"Days (will come) when the sorrow will be driven away from the Islamic Ummah and we return to the Two Holy Mosques for Tawaf (circumambulation around the Holy Ka'ba), Sa'i (the ritual of hastening between the hills of Safa and Marwa) and praying at Al-Rawdah Al-Sharifa and greet the Prophet Muhammed (peace be upon him)," Al-Sudais said in a video posted on social media."
ভোরের কাগজের প্রতিবেদনে যেমন বলা হয়েছে, পাকিস্তান ভিত্তিক একটি নিউজ পোর্টাল 'dailytimes.com.pk' অবশ্য তাদের প্রতিবেদনে ৮ম রমজান (১ মে) থেকে মসজিদে নববী খুলে দেয়ার তথ্য জানিয়েছে। যদিও তারা এই তথ্য কোথায় পেয়েছে তা জানায়নি।
সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে আরবী ও ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোর (যেমন আল জাজিরা মুবাশার, সৌদি গ্যাজেট, আরব নিউজ, আল আরাবিয়্যা, আরটি অ্যারাবিক, আল ওয়াতান, আল ইয়াওম) ওয়েবসাইট ঘেটে ৮ম রমজান ((১ মে) থেকে মদিনা বা মক্কার মসজিদে হারাম খুলে দেয়ার কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
তবে এসব সংবাদমাধ্যমে হারামাইন খুলে দেয়ার ব্যাপারে আল-সুদাইসের আশাবাদী বক্তব্য (উপরে মিডলইস্ট মনিটরে যা উল্লেখ করা হয়েছে) নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
সৌদি গেজেট ২৯ এপ্রিল (৬ষ্ঠ রমজান) হারামাইন খুলে দেয়ার বিষয়ে তার আশাবাদী বক্তব্য সংক্রান্ত খবরের শিরোনাম করেছে, "Holy Mosques to open for the faithful soon: Al-Sudais"।
এখানেও জানানো হয়েছে যে, হারামাইন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের (General Presidency) প্রধান আবদুর রহমান আল সুদাইস শিগগিরই মসজিদ দুটি খুলে দেয়ার আশা ব্যক্ত করেছেন।
এদিকে নিয়মিত মসজিদে হারামাইন সংক্রান্ত এক্সক্লুসিভ তথ্য, ছবি ও ফুটেজ প্রকাশ করে থাকে এমন একটি ফেসবুক পেইজ ও একটি টুইটার একাউন্টে ৩০ এপ্রিল একটি নোটিশ প্রকাশ করা হয়; যাতে জানানো হয়েছে হারাইমাইন শরীফ জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার যে খবর ছড়ানো হয়েছে তা 'ভিত্তিহীন ও ভুয়া'।
CLARIFICATION UPDATE: 30TH APRIL 2020 pic.twitter.com/fZf9vhP3Td
— 𝗛𝗮𝗿𝗮𝗺𝗮𝗶𝗻 (@HaramainInfo) April 29, 2020
যেহেতু উল্লিখিত ফেসবুক পেইজ এবং টুইটার হ্যান্ডলটি ভেরিফায়েড নয়, ফলে Boom Bangladesh যাচাই করে দেখার চেষ্টা করেছে যে, পেইজ ও একাউন্টটির নির্ভরযোগ্যতা আসলে কতটুকু।
অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যের নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম হারামাইন সংক্রান্ত তাদের প্রতিবেদনে @HaramainInfo টুইটার হ্যান্ডেলটির টুইটকে এমবেড করে প্রকাশ করেছে।
আল জাজিরা ইংলিশ এবং মিডলইস্ট আই এর এমন দুটি প্রতিবেদন দেখুন এখানে ও এখানে।
www.facebook.com/haramain.info নামে পেইজটিতে ৫৬ লাখের কিছু বেশি ফলোয়ার রয়েছে। প্রতিদিন ১০টির বেশি পোস্টে হারামাইনের এক্সক্লুসিভ ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করা হয়, নামাজের জামায়াত লাইভ সম্প্রচার করা হয়। ২০০৯ সালে খোলা পেইজটি ৯টি দেশ থেকে মোট ১৮ জন ব্যক্তি পরিচালনা করেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৫ জন পাকিস্তানে, ৩ জন সৌদি আরব এবং ৩ জন ভারত থেকে এটির সাথে কাজ করেন।
তাদের একটি ইউটিউব চ্যানেল (১৪ লাখ সাবস্ক্রাইবার, খোলা হয় ২০১২ সালে) ও ওয়েবসাইট রয়েছে, যেগুলোতেও নিয়মিত হারামাইনের এক্সক্লুসিভ কন্টেন্ট প্রকাশ করা হয়। ২৪ ঘণ্টা হারামাইন থেকে লাইভ করা হয় ইউটিউব চ্যানেলে; যেখানে মোট ২৬ হাজারের বেশি ভিডিও রয়েছে এবং এর বেশিরভাগই হারামাইনের এমন সব ফুটেজ যা অনলাইনে অন্য কোনো সূত্রে পাওয়া যায় না। প্রতিদিন হারামাইনের ভেতরের ১৫ থেকে ৩০ পর্যন্ত ভিডিও আপলোড করা হয় চ্যানেলটিতে।
@HaramainInfo নামক টুইটার হ্যান্ডেল, ফেসবুক পেইজ এবং ইউটিউব চ্যানেল সংক্রান্ত উপরের এসব তথ্য থেকে ধারণা করা যায় যে, এই প্লাটফর্মগুলো হারামাইনের অফিসিয়াল কোনো প্লাটফর্ম নয়। তবে এগুলোর পরিচালনাকারীদের মধ্যে এমন ব্যক্তিবর্গ আছেন যারা হারাইমাইনের অভ্যন্তরীণ বিষয়াদিতে তাদের প্রবেশাধিকার রয়েছে। ফলে হারামাইন সংক্রান্ত কোনো তথ্যের ক্ষেত্রে তাদেরকে নির্ভরযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
অর্থাৎ, সাধারণের জন্য হারামাইন খুলে দেয়ার খবরটিকে @HaramainInfo ভুয়া হিসেবে যে দাবি করেছে তা নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচনাযোগ্য।
অন্যদিকে যেহেতু সৌদি আরবের সরকারি ওয়েবসাইট, সরকারি কর্তৃপক্ষের টুইটার হ্যান্ডল, সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের শীর্ষস্থানীয় কোনো সংবাদমাধ্যম হারামাইন খুলে দেয়ার কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি (যেমনটা তারা আল সুদাইসের আশাবাদী বক্তব্য নিয়ে করেছিলো), ফলে বাংলাদেশি সংবামাধ্যমে পাকিস্তানি একটি ওয়েবসাইটের বরাতে ১ মে থেকে হারামাইন খুলে দেয়ার যে খবর প্রকাশিত হয়েছে ভুয়া।
হারামাইনে সাম্প্রতিক ঘটনার টাইম লাইন:
২৬ ফেব্রুয়ারি: সৌদি সরকার বিদেশিদের হারামাইনে ভ্রমণের (উমরাহ ও মসজিদে নববীতে জিয়ারত) জন্য ভিসা দেয়া বন্ধ ঘোষণা করে।
২০ মার্চ: সৌদি কর্তৃপক্ষ হারামাইনে নামাজ আদায় বন্ধ ঘোষণা করে।
২১ এপ্রিল: রমজানেও হারামাইনে নামাজ আদায়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
২২ এপ্রিল: সীমিত আকারে তারাবির জামায়াত অনুষ্ঠানের অনুমোদন দেন বাদশাহ সালমান।
বর্তমানে শুধু হারামাইনের কর্মচারিদের অংশগ্রহণে ১০ রাকাত তারাবির জামায়াত অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এতে সাধারণ মুসল্লিদের অংশগ্রহণের সুযোগ নেই।