সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট করা হচ্ছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে একজন ব্যক্তি কাপড় দিয়ে চেহারা ঢেকে আরবীতে বক্তব্য দিচ্ছেন এবং তার দুপাশে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে দুজন কালো পোশাকে দাঁড়িয়ে আছেন। ভিডিওটি পোস্ট করে বলা হচ্ছে, যশোরে জঙ্গিদের উত্থান হয়েছে ও জিহাদের ডাক দেওয়া হয়েছে। এরকম কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে ও এখানে।
গতকাল ১৮ ডিসেম্বর ‘ডাঃ ইলিশ নজরুল’ নামের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে ভিডিওটি পোস্ট করা হয়। পোস্টে উল্লেখ করা হয়, “দেশে জঙ্গীর অবাধে চাষবাস”। পোস্টটির স্ক্রিনশট দেখুন--
ফ্যাক্ট চেক:
বুম বাংলাদেশ যাচাই করে দেখেছে, দাবিটি সঠিক নয়। আলোচ্য ভিডিওটি 'যশোর জামিয়া ইসলামিয়া' নামের একটি কওমি মাদ্রাসার বার্ষিক প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের আরবি বক্তব্য প্রতিযোগিতা ক্যাটাগরিতে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের একটি পরিবেশনার।
ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে মঞ্চে একটি ব্যানারে লেখা থাকতে দেখা যায় 'যশোর জামিয়া ইসলামিয়া'। এর সূত্র ধরে কি-ওয়ার্ড সার্চ করে ফেসবুকে ‘H M Abdullah Jessore’ নামের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে গত ১৭ ডিসেম্বর দুপুর ১২:৫৪ মিনিটে পোস্ট করা একটি পোস্টে আলোচ্য ভিডিওটির হুবহু ও স্পষ্টতর একটি ভার্সন পাওয়া যায়, এটিই এই ভিডিওটি নিয়ে ফেসবুকে দেয়া সম্ভাব্য প্রথম পোস্ট। পোস্টটিতে উল্লেখ করা হয়, “যশোর জামিয়া ইসলামিয়া। বার্ষিক প্রতিযোগিতা ও পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠান -২০২৪ । আরবী বক্তৃতা,,,সবাইকে দেখার অনুরোধ রইলো ”। পোস্টটির স্ক্রিনসট দেখুন--
উক্ত ফেসবুক একাউন্টটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তিনি যশোর জামিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার হিফজ বিভাগের একজন শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন। এখান থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সাথে ভিডিও সংশ্লিষ্ট কি-ওয়ার্ড যুক্ত করে সার্চ করে অনলাইন সংবাদ মাধ্যম ‘বাংলা ট্রিবিউন’-এ গত ১৮ ডিসেম্বর “‘অস্ত্র’ হাতে বক্তব্যের ভিডিও ভাইরাল, আসল ঘটনা কী” শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
যশোর জামিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার শিক্ষা সচিব মাকফুর রহমানের বরাতে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘এই মাদ্রাসায় প্রতি বছর শিক্ষার্থীদের নিয়ে বার্ষিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। সেখানে যারা উপস্থিত বক্তৃতা, হামদ-নাত, গজল ও অভিনয়ে ভালো করে তাদের পুরস্কৃত করা হয়। গত ১৭ ডিসেম্বর এই মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ছাত্ররা ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে অভিনয় করে দেখান।’ মুখ ঢেকে ‘সশস্ত্র গার্ডের’ মতো দাঁড়িয়ে থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তাদের হাতে থাকা অস্ত্রগুলো কাঠ ও শোলা দিয়ে তেরি। আসলে এটি অভিনয় ছাড়া অন্য কিছু নয়।’ প্রতিবেদনটির স্ক্রিনশট দেখুন--
এ বিষয়ে জানতে যশোর জামিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করা হলে, মাদ্রাসাটির শিক্ষা সচিব মাকফুর রহমান বুম বাংলাদেশকে একই তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এটি উক্ত মাদ্রাসার একটি বার্ষিক প্রতিযোগিতার শিক্ষার্থীদের পারফরম্যান্সের দৃশ্য। ভিডিওতে ছাত্রদের হাতে অস্ত্রের মত যেটি দেখা যাচ্ছে সেটি প্রকৃত অস্ত্র নয়; এটি কাঠ, শোলা ও কালো স্কচটেপ দিয়ে অস্ত্রের মত করে তৈরি করা বলেও জানান মাকফুর রহমান।
তিনি বুম বাংলাদেশকে ঐ প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের আরো কয়েকটি ভিডিও পাঠিয়েছেন ১, ২, ৩। আলোচ্য ভিডিওটির দৃশ্যের সাথে তার পাঠানো ভিডিওগুলোর দৃশ্যের মিল পাওয়া যায়। এসব ভিডিওতে বিভিন্ন শিক্ষার্থীরা প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে অংশ নিয়েছেন। তন্মধ্যে একটি ভিডিওর প্রিভিউ দেখুন--
বুম বাংলাদেশ ঘটনাটি সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে আলোচ্য ভিডিওতে অংশ নেয়া প্রতিযোগীদের সাথেও যোগাযোগের চেষ্টা করে। আলোচ্য ভিডিওতে দেখতে পাওয়া তিনজনের একজন (ডানে কালো পোশাকে দাঁড়ানো) শোয়াইব আহমেদ। তিনি বুম বাংলাদেশকে জানান, প্রতিযোগিতায় আরবি বক্তব্য ক্যাটাগরিতে অংশ নেয়া তাদের পারফরম্যান্সের ভিডিও এটি। ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিবাদে তারা তিন শিক্ষার্থী এই ব্যতিক্রমী সাজে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। অন্য প্রতিযোগীরা স্বাভাবিক পোশাকেই অংশগ্রহণ করেছে, ব্যতিক্রমী এই উপস্থাপনার জন্য তারা প্রথম স্থান অধিকার করেছেন বলেও জানান শোয়াইব। হাতে থাকা অস্ত্রের বিষয়ে তিনি বলেন, এগুলো কাঠ ও শোলা দিয়ে নিজেরা অস্ত্রের মত করে তৈরি করেছেন প্রতিযোগিতায় উপস্থাপনের জন্য।
এদিকে, আলোচ্য ভিডিওটি বিভ্রান্তিকর দাবিতে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়লে মাদ্রাসাটির অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ “যশোর জামিয়া ইসলামিয়া” থেকে রাতে তাৎক্ষণিক লাইভে এসে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেন প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা মহাপরিচালক মুফতি লুৎফুর রহমান ফারুকী। আলোচ্য ভিডিওটি নিয়ে একই তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, এর সাথে জঙ্গিবাদের কোনো সম্পর্ক নেই, আর আরবি বক্তব্যে শিক্ষার্থীরা বলেছেন, কিভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা উচিত। আলোচ্য ভিডিও নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণায় কাউকে বিভ্রান্ত না হওয়ারও আহ্বান জানান মুফতি ফারুকী। তাঁর ফেসবুক লাইভটির প্রিভিউ দেখুন--
এছাড়া, আলোচ্য ভিডিওটির বিষয়ে যশোরের পুলিশও গণমাধ্যমকে একই তথ্য জানিয়েছেন। পুলিশের বক্তব্য সহ বিস্তারিত একটি ভিডিও প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বেসরকারি সম্প্রচার মাধ্যম যমুনা টেলিভিশন। এই প্রতিবেদনে যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নূর ই আলম সিদ্দিকী বলেছেন, পুলিশ সরেজমিন তদন্ত করে অস্ত্র সদৃশ দুটি বস্তু উদ্ধার করেছে, দেখা গেছে এগুলো কাঠ ও ককশিটের তৈরি খেলনা।
অর্থাৎ ভিডিওটি যশোরের একটি মাদ্রাসার বার্ষিক প্রতিযোগিতায় ভিন্ন সাজে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের।
উল্লেখ্য, বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিবেদন অনুযায়ী যশোর শহরতলীর রাজারহাট বিহারি কলোনি এলাকায় ২০১২ সালে যশোর জামিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। কওমি ধারার এই মাদ্রাসায় প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করেন।
সুতরাং সামাজিক মাধ্যমে 'যশোর জামিয়া ইসলামিয়া' মাদ্রাসার বার্ষিক প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের আরবি বক্তব্য প্রতিযোগিতার একটি দৃশ্যকে বিভ্রান্তিকর দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে।