সময় টিভির অনলাইনে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে যার শিরোনাম, "লকডাউনে' যাচ্ছে সূর্য, সতর্কতা জারি নাসার"।
আর্কাইভ লিংক: http://archive.is/GE1k8
খবরটি বাংলাদেশ প্রতিদিন, ইনকিলাবসহ বেশ কয়েকটি অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত হয়েছে।
সময় টিভির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে--
"মহামারি করোনা ভাইরাসের মধ্যেই দুঃসংবাদ দিলেন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার বিজ্ঞানীরা। তাদের মতে, এবার লকডাউনে চলে গেছে সূর্য। আর এ কারণে শীতল হয়ে আসছে এটি।
সূর্যের এমন লকডাউনের ফলে বিশ্বে তাপমাত্রা কমে যাবে, শীতল হয়ে উঠবে পৃথিবী। এছাড়া বিশ্বজুড়ে ভূমিকম্প ও দুর্ভিক্ষের মতো ভয়ংকর দুর্যোগ দেখা দিতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞানীরা।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সূর্য বর্তমানে 'সোলার মিনিমাম' পরিস্থিতিতে রয়েছে। ফলে পৃথিবীতে সূর্যের স্বাভাবিক সময়ে সরবরাহ করা তাপমাত্রা অনেক কমে গেছে। পৃথিবীর প্রতি সূর্যের কার্যকলাপ নাটকীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে।"
প্রতিবেদনের বাকি অংশ দেখুন নিচের স্ক্রিনশটে--
সময় টিভির প্রতিবেদনের ৬টি দাবির ফ্যাক্ট চেক:
সময় টিভির প্রতিবেদনে যেসব দাবি করা হয়েছে সেগুলোর সত্যমিথ্যা যাচাই করেছে বুম বাংলাদেশ।
দাবি ১:
"মহামারি করোনা ভাইরাসের মধ্যেই দুঃসংবাদ দিলেন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার বিজ্ঞানীরা।"
ফ্যাক্ট চেক:
না, নাসার বিজ্ঞানীরা 'করোনা ভাইরাস মহামারির মধ্যেই' 'দুঃসংবাদ' আকারে কোনো তথ্য দেননি।
সময়টিভির প্রতিবেদনে যে বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে তা হলো 'সোলার মিনিমাম'। প্রতি ৯ থেকে ১৪ বছর সময়ের মধ্যে একটি 'সোলার সাইকেল' বা সৌরচক্র পূর্ণ হয়। সাধারণত এই সৌরচক্র পূর্ণ হতে ১১ বছর সময় লাগে।
সৌরচক্রের এই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সুর্যের আলো বিকিরণ ক্ষমতা কখনো বাড়ে আবার কখনো কমে। সৌরচক্রের মধ্যে বিকিরণ ক্ষমতা বেড়ে যখন সর্বোচ্চ হয় তখন সেটিকে 'সোলার মেক্সিমাম' এবং যখন বিকিরণ ক্ষমতা সর্বনিম্ন হওয়াকে 'সোলার মিনিমাম' বলে।
২০১৭ সালের ২৭ জুন এক প্রতিবেদনে নাসা জানিয়েছিলো, চলতি সৌরচক্র বা সোলার সাইকেলের 'সোলার মিনিমাম' শুরু হতে পারে ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে। (অনুমিত সময়ের ৬ মাস আগে বা পরের যে কোনো সময়েও হতে পারে)। তবে চলতি 'সোলার মিনিমাম' বিগত 'সোলার মিনিমাম' এর চেয়ে কিছু বেশি সময় স্থায়ী হবে।
এরপর যুক্তরাষ্ট্রের SPACE WEATHER PREDICTION CENTER ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের ৯ তারিখ এক প্রতিবেদনে একই রকম ভবিষ্যদ্বাণী করে।
এরপর চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি নাসা'র ব্লগে একটি নিবন্ধ পোস্ট করা হয় যার শিরোনাম, "There Is No Impending 'Mini Ice Age".
এতে বলা হয়েছে, "সূর্যের শক্তি উৎপাদনে যে ধরনের কমতি হতে পারে বলে ধারণা করা যাচ্ছে তাতে আগামী কয়েক দশকের মধ্যেও "ice age" বা "mini ice age" ঘটার (অর্থাৎ পৃথিবীর শীতল হয়ে যাওয়ার) কোনো শঙ্কা নেই।"
এই একই নিবন্ধে আরও বলা হয়েছে--
"Some scientists have suggested that the relatively small magnitude of the last solar cycle (SC 24) presages a new Grand Solar Minimum in the next few decades."
অর্থাৎ, সর্বশেষ সোলার সাইকেল বা সৌরচক্র তুলনামূলক ছোট আকারের হওয়ার কারণে কিছু বিজ্ঞানী মনে করছেন আগামী কয়েক দশকের মধ্যে নতুন একটি 'গ্রান্ড সোলার মিনিমাম' দেখা দিতে পারে।
'সোলার মিনিমাম' এর চেয়েও যখন সূর্যের বিকিরণ ক্ষমতা আরও কমে যায় তখন সেটিকে 'গ্রান্ড সোলার মিনিমাম' বলে।
নাসা'র নিবন্ধে বলা হয়েছে, ১৬৫০ সাল থেকে ১৭১৫ সাল পর্যন্ত সময়ে পৃথিবীর উত্তার্ধে এ ধরনের 'গ্রান্ড সোলার মিনিমাম' ঘটেছিলো। ওই সময়টিতে পৃথিবীর উত্তার্ধে আগ্নেয়গিরির অ্যারোসোলের প্রভাবের এমনিতেই শীতল আবহাওয়া ছিল। সাথে সূর্যের কার্যক্রমের কমতি যুক্ত হয়ে শীতলতা আরও বেড়ে গিয়েছিলো। সে সময়টিকে "Little Ice Age" বলা হয়ে থাকে।
বর্তমান সময়ে বা নিকট ভবিষ্যতে এ ধরনের আরও একটি 'গ্রান্ড সোলার মিনিমাম' সংঘটিত হলে পৃথিবীর ওপর এর প্রভাব কেমন হতে পারে সে বিষয়ে ১৩ ফেব্রুয়ারির নাসা'র নিবন্ধে বলা হয়েছে--
"Even if a Grand Solar Minimum were to last a century, global temperatures would continue to warm. Because more factors than just variations in the Sun's output change global temperatures on Earth, the most dominant of those today being the warming coming from human-induced greenhouse gas emissions."
অর্থাৎ, বর্তমানে 'গ্রান্ড সোলার মিনিমাম' এর প্রভাবে (১৬৫০ সাল থেকে ১৭১৫ সময়কালের মতো) পৃথিবীর তাপমাত্রা কমে গিয়ে শীতল হয়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা বা শঙ্কা নেই। একশ বছর ধরে 'গ্রান্ড সোলার মিনিমাম' চলতে থাকলেও তাতে পৃথিবীর তাপমাত্রা বর্তমানের চেয়ে কমে না এসে বরং গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের কারণে বেড়েই চলবে।
উপরে তুলে ধরা তথ্য থেকে স্পষ্ট যে, অতি সম্প্রতি কোনো গ্রান্ড সোলার মিনিমাম ঘটার কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না বিজ্ঞানীরা। কয়েক দশকের মধ্যে যে সম্ভাবনা আছে তাতেও পৃথিবীর আবহাওয়া বা জলবায়ুর ওপর সেটির প্রভাব খুব বেশি পড়ার শঙ্কা নেই বলেই তারা জানাচ্ছেন।
আর বর্তমানে যা চলছে সেটি হলো 'সোলার মিনিমাম'; অর্থাৎ, প্রতি ১১ বছরের (কিছু ক্ষেত্রে তার চেয়ে কম বা বেশি সময়ের) ব্যবধানে সূর্যের যে স্বাভাবিক বিকিরণ ক্ষমতা কমে আসার প্রক্রিয়াটি। এতে কোনো 'দুঃসংবাদ' নেই। এবং নাসার বিজ্ঞানীরাও উপরে উল্লিখিত তিনটি ভবিষ্যদ্বাণী বা নিবন্ধে 'দুঃসংবাদ' হিসেবেও কিছু উল্লেখ করেননি।
২০১৭ তে প্রথম বিষয়টি জানানোর পর এ বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি এসে সর্বশেষ ব্যাখ্যামূলক একটি নিবন্ধ প্রকাশ করার পর নাসা সোলার মিনিমামের বিষয়ে আর কোনো বিবৃতি বা নিবন্ধ প্রকাশ করেনি। ফলে, এটিকে "মহামারি করোনা ভাইরাসের মধ্যেই দুঃসংবাদ দিলেন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার বিজ্ঞানীরা" বলারও সুযোগ নেই।
দাবি ২:
"নাসার বিজ্ঞানীরা বলেছেন, "এবার লকডাউনে চলে গেছে সূর্য"।
ফ্যাক্ট চেক:
না, সোলার মিনিমাম বুঝাতে নাসার বিজ্ঞানীরা 'লকডাউন' শব্দ তাদের নিবন্ধে ব্যবহার করেননি। এটি ব্যবহার করেছে ক্লিকবেইট সাংবাদিকতার জন্য খ্যাতিমান ব্রিটেনের ট্যাবলয়েড পত্রিকা দ্য সান; তাদের ১৩ মে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে।
দাবি ৩:
"সূর্যের এমন লকডাউনের ফলে বিশ্বে তাপমাত্রা কমে যাবে, শীতল হয়ে উঠবে পৃথিবী। এছাড়া বিশ্বজুড়ে ভূমিকম্প ও দুর্ভিক্ষের মতো ভয়ংকর দুর্যোগ দেখা দিতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞানীরা।"
ফ্যাক্ট চেক:
উপরের ১ নং দাবির ফ্যাক্ট চেকে তুলে ধরা হয়েছে নাসা জানিয়েছে, সোলার মিনিমাম (যাকে 'সূর্যের লকডাউন' বলা হয়েছে প্রতিবেদনে) এর কারণে বিশ্বের তাপমাত্রা কমে যাওয়ার শঙ্কা নেই, ফলে পৃথিবী শীতলও হবে না।
আর 'বিশ্বজুড়ে ভূমিকম্প ও দুর্ভিক্ষের মতো ভয়ংকর দুর্যোগ দেখা দিতে পারে' বলে যে দাবি করা হয়েছে তা নাসার বক্তব্য নয়।
দ্য সান এর প্রতিবেদনের এক জায়গায় লিখেছে--
"NASA scientists fear it could be a repeat of the Dalton Minimum, which happened between 1790 and 1830 — leading to periods of brutal cold, crop loss, famine and powerful volcanic eruptions."
চলতি সোলার মিনিমাম কিছু বেশি সময় স্থায়ী হওয়া এবং এর প্রভাবে কিছু বিজ্ঞানীর মতে আগামী কয়েক দশকের মধ্যে একটি 'গ্রান্ড সোলার মিনিমাম' সংঘটিত হওয়ার যে ভবিষ্যদ্বাণী নাসার পক্ষ থেকে করা হয়েছে তাতে কোনো বিপদ সতর্কতা না থাকলেও দ্য সান তাদের প্রতিবেদনে এই বিষয়টি উল্লেখ করতে গিয়ে 'fear' শব্দের ব্যবহার করেছে। অর্থাৎ, বুঝানো হয়েছে নাসার বিজ্ঞানী বিপদের শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
অথচ, উপরে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কয়েক দশক পরের সম্ভাব্য গ্রান্ড সোলার মিনিমামের প্রভাব পৃথিবীর তামপাত্রায় তেমন কোনো পরিবর্তন আনবে না বলে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন।
দ্য সান এর প্রতিবেদনে যে Dalton Minimum (১৭৯০ থেকে ১৮৩০ সাল) এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে নাসা সেটির কথা তাদের নিবন্ধে বা বিবৃতিতে উল্লেখ করেনি। বরং Dalton Minimum এর চেয়েও বেশি প্রভাব ফেলা Maunder Minimum (১৬৫০ থেকে ১৭১৫ সাল) এর কথা উল্লেখ করে নাসা বলেছে এটির সম পর্যায়ের গ্রান্ড সোলার মিনিমাম সংঘটিত হলেও, এবং তা একশ বছর ধরে স্থায়ী হলেও পৃথিবীর তাপমাত্রায় তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে না।
অর্থাৎ, নাসা'র বিজ্ঞানীদের বক্তব্য আকারে ভুলভাবে Dalton Minimum এর প্রসঙ্গ টেনে সেটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দ্য সান এর প্রতিবেদনে 'টুইস্ট' হিসেবে ওই সোলার মিনিমামের সময়কালীন দুর্ভিক্ষ এবং দুর্যোগের তথ্য যুক্ত করা হয়েছে। নাসান বিজ্ঞানীরা সোলার মিনিমামের কথা বলতে গিয়ে দুর্ভিক্ষ-দুর্যোগ এসব কিছুর প্রসঙ্গ টানেননি।
দাবি ৪:
সময়টিভির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে "নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।"
ফ্যাক্ট চেক:
না, নিউইয়র্ক টাইমস এর কোনো প্রতিবেদনে সম্প্রতি এমন তথ্য তুলে ধরা হয়নি। বরং উপরে উল্লিখিত দ্য সান এর প্রতিবেদন দ্য সান এর বরাতে পুনঃপ্রকাশ করেছে 'নিউইয়র্ক পোস্ট' নামে একটি পত্রিকা।
'নিউইয়র্ক টাইমস' আর 'নিউইয়র্ক পোস্ট' এর মধ্যে পার্থক্য হলো প্রথমটি বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় নির্ভরযোগ্য সংবাদমাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত। আর দ্বিতীয়টি অনলাইনে ক্লিকবেইট সাংবাদিকতার প্লাটফর্ম হিসেবে পরিচিত; ঠিক যেমন পরিচয় দ্য সান-এরও রয়েছে।
দ্য সান এর প্রতিবেদনকে 'নিউইয়র্ক পোস্ট' এর প্রতিবেদন বলাও ভুল (আর নিউইয়র্ক টাইমস তো প্রকাশই করেনি এটি)।
দাবি ৫:
দ্য সান এর প্রতিবেদনের আলোকে সময়টিভির প্রতিবেদনের এক জায়গায় লেখা হয়েছে--
"বিশ্বখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ড. টনি ফিলিপস বলেন, আমরা এমন গভীরতম সময়ের ভেতরে প্রবেশ করতে যাচ্ছি, যে সময়ে সূর্যের আলো কার্যত অদৃশ্য হয়ে যাবে।"
ফ্যাক্ট চেক:
কিন্তু দ্য সান (অথবা নিউইয়র্ক পোস্ট) এর প্রতিবেদনের কোথাও সরাসরি 'জ্যোতির্বিজ্ঞানী ড. টনি ফিলিপস' মুখে এমন কথা পাওয়া যায়নি।
তবে দ্য সান এর প্রতিবেদনে এক জায়গায় লেখা হয়েছে--
"Experts believe we are about to enter the deepest period of sunshine "recession" ever recorded as sunspots have virtually disappeared."
যার প্রকৃত অনুবাদ হবে- "বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সানস্পট অদৃশ্য হয়ে যাওয়ায় আমরা ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে সূর্যালোকের "খরা"য় ঢুকতে যাচ্ছি।"
অর্থাৎ, সময়টিভির প্রতিবেদনে ভুলভাবে অনুবাদ করে বলা হয়েছে, "সূর্যের আলো কার্যত অদৃশ্য হয়ে যাবে"।
আবার দ্য সান এর প্রতিবেদনে 'বিশষেজ্ঞদের' বরাতে যেভাবে দাবি করা হয়েছে 'সানস্পট অদৃশ্য' বা 'নাই' হয়ে গেছে, বাস্তবে তা সঠিক নয়। বরং চলতি বছরেই নাসার Solar Dynamics Observatory জানিয়েছে, নতুন দুটি সানস্পট ভেসে ওঠেছে। সূর্যের পৃষ্ঠে সানস্পট কমেছে, এটা সত্য, কিন্তু একেবারে নাই হয়ে যায়নি।
দাবি ৬:
"সূর্যের এই লকডাউনে যাওয়ার ঘটনায় 'ডাল্টন মিনিমাম' এর পুনরাবৃত্তি হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন নাসার বিজ্ঞানীরা। ১৭৯০ এবং ১৮৩০ এর মধ্যে সূর্যের মিনিমাম সোলারের কারণে তীব্র শীতের মুখে পড়েছিল পৃথিবী।"
ফ্যাক্ট চেক:
উপরে ইতোমধ্যেই উল্লেখ করা হয়েছে যে নাসার প্রতিবেদনগুলোতে 'ডাল্টন মিনিমাম' এর কথা এবং সেটির সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো দুর্ভিক্ষ-দুর্যোগের কথা উল্লেখ করা হয়নি।