দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার অনলাইনে ২২ এপ্রিল একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় যার শিরোনাম ছিলো, "ল্যানসেট রিপোর্ট ভিত্তি করে করোনা থেকে বাঁচার উপায়"।
প্রথম শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ইউআরএল ছিলো: https://www.ittefaq.com.bd/corona-update/238818/ল্যানসেট-রিপোর্ট-ভিত্তি-করে-করোনা-থেকে-বাঁচার-উপায়?
দেখুন নিচের স্ক্রিনশটটি-
প্রথমবারের শিরোনামটি পরে পরিবর্তন করে দেয়া হয় "কোভিড-১৯ নিয়ে এই মুহূর্তে সবচেয়ে আলোচিত ল্যানসেট রিপোর্ট"।
দেখুন পরিবর্তিত শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনের স্ক্রিনশট-
শিরোনাম পরিবর্তনের পরে প্রতিবেদনটি ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে ফেলে ইত্তেফাক। তবে শিরোনাম এডিট করা ভার্সনটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
ডেইলি ক্যাম্পাস নামে একটি অনলাইন পোর্টাল একই রকমের প্রতিবেদন প্রকাশ করে "ল্যানসেটে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে শিশু-কিশোরদের করোনা ঝুঁকি কমবে"।
ইত্তেফাকের প্রতিবেদনে বিজ্ঞান বিষয়ক বিখ্যাত জার্নাল ল্যানসেট-এ ১২ এপ্রিল প্রকাশিত এক 'মন্তব্যমূলক নিবন্ধ' এর বরাতে করোনা সংক্রমণ ও নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে ১৭টি পয়েন্টে বেশ কিছু 'তথ্য' তুলে ধরা হয়। তন্মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বক্তব্যটিকে 'তথ্য' হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে তা হলো,
উল্লেখযোগ্য কিছু দাবি হল- "কোভিড ১৯ বায়ু দ্বারা সংক্রামিত হয়। অন্য কোনো ভাবেই নয়।"
এর বাইরে আরও কিছু দাবিকে 'তথ্য' হিসেবে তুলে ধরা হয় যেমন--
১- কোভিড রোগ কোনমতেই হাঁচি, কাশি, কফ, থুতুর মাধ্যমে ছড়ায় না।
৩- যারা বাইরে ঘুরেছেন তাঁদের চেয়ে যারা ঘরে বদ্ধ থেকেছেন, তাদের রোগটি হয়েছে বহুগুণ বেশি।
৩- লকডাউন এই রোগ নিয়ন্ত্রণে কোনোভাবেই উপকারী নয়।
৪- ল্যানসেট ভারত, বাংলাদেশ, চীনে অবিলম্বে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের ভ্যাকসিন দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করতে বলেছে।
ফ্যাক্ট চেক:
বুম বাংলাদেশ যাচাই করে দেখেছে, ইত্তেফাকের প্রতিবেদনটির বেশ কিছু দাবি ভিত্তিহীন এবং বিভ্রান্তিকর।
যাচাই-প্রক্রিয়ায় সবার আগে খুঁজে দেখা হয়েছে, ইত্তেফাকের আলোচ্য প্রতিবেদনটির উৎস কী? এতে দেখা গেছে, সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া পোস্ট যেটিতে ভুল ও বিভ্রান্তিকর বেশ কিছু তথ্য রয়েছে সেটিকে সরাসরি ল্যানসেটের বরাতে প্রকাশ করা হয়েছে সংবাদমাধ্যমটিতে।
ইত্তেফাক তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করে ২২ এপ্রিল। অন্যদিকে ২১ এপ্রিল ফেসবুকে দেখা যায় হুবহু একই রকম লেখা যেটি ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয়েছে। উভয় লেখার মধ্যে পার্থক্য হলো, ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া পোস্টটিতে বেশ কিছু নাম ও টার্মকে ইংরেজি হরফে লেখা হয়েছে, আর ইত্তেফাকের প্রতিবেদনে সেগুলোকে বাংলা হরফে লেখা হয়েছে।
আগের দিন ভাইরাল হওয়া ফেসবুক পোস্ট এবং পরের দিন প্রকাশিত ইত্তেফাকের প্রতিবেদনের তুলনামূলক স্ক্রিনশট দেখুন-
ভাইরাল হওয়া পোস্টটি 'Towhidul Islam' নামের একটি ফেসবুক আইডিতে দেখুন নিচে। Towhidul Islam পোস্টটি দিয়েছেন অন্য এক ব্যক্তির বরাতে।
Covid 19 নিয়ে এই মুহূর্তে সবচাইতে আলোচিত Lancet report.
Lancet পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ Science Journal. এটি New York...
Posted by Towhidul Islam on Wednesday, 21 April 2021
পোস্টটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
তবে ভাইরাল ফেসবুক পোস্টটির প্রকৃত লেখক কে তা খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এ পর্যায়ে প্রতিবেদনে উল্লেখিত দাবিগুলোর সত্যতা যাচাই করার চেষ্টা করেছে বুম বাংলাদেশ। ইত্তেফাকের প্রতিবেদনে তথা ভাইরাল হওয়া ফেসবুক পোস্টে যেসব বক্তব্যকে তথ্য আকারে তুলে ধরা হয়েছে সেগুলো আদৌ ল্যানসেটে প্রকাশিত হয়েছে কিনা?
ইত্তেফাকের প্রতিবেদনের শুরুতে বলা হয়েছে, "বিখ্যাত জার্নাল ল্যানসেটে ১২ এপ্রিলের একটি রিপোর্টমতে, করোনা কেবল বায়ুর মাধ্যমে সংক্রমিত হয়, অন্য কোনভাবে ছড়ায় না।"
কিন্তু ল্যানসেটে এ বছরের ১২ এপ্রিলে প্রকাশিত এমন কোনো রিপোর্ট পাওয়া যায়নি।
তবে করোনা বাতাসে ছড়াতে পারে, এ সংক্রান্ত একটি 'কমেন্ট' (বা মন্তব্যমূলক প্রতিবেদন) ল্যানসেটে প্রকাশিত হয় ১৫ এপ্রিল। 'Ten scientific reasons in support of airborne transmission of SARS-CoV-2' শিরোনামে সেই 'কমেন্ট'টি মূলত ৬ জন গবেষক সম্মিলিতভাবে প্রকাশ করেন এবং সেই দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ত্রিশা গ্রিনহালগ। কমেন্টটিতে করোনা ভাইরাস বাতাসের মাধ্যমে ছড়াতে পারে এর পক্ষে ১০টি বৈজ্ঞানিক কারণ উল্লেখ করেন উক্ত গবেষকদল। দেখুন--
এছাড়া 'করোনাভাইরাস মূলত বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়: ল্যানসেট' শিরোনামের ডেইলি স্টারের একটি প্রতিবেদনেও উক্ত ৬ জন গবেষকের গবেষণার বরাতই দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ ল্যানসেটে প্রকাশিত 'কমেন্ট'টি ১২ তারিখ নয়, ১৫ এপ্রিল প্রকাশিত হয়েছে।
ইত্তেফাকের দাবিমতে, ল্যানসেটের গবেষণায় বলা হয়েছে, "করোনা কেবল বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়, অন্য কোনো উপায়ে ছড়ায় না।" অথচ ল্যানসেটের গবেষণায় এমন দাবি করা হয়নি। বরং উপসংহার অংশে বলা হয়েছে--
যার মানে দাঁড়ায়, করোনা ভাইরাস বাতাসের মাধ্যমে ছড়ানোর পক্ষে যথেষ্ট শক্ত প্রমাণ আছে। তবে অন্য উপায়েও যেকেউ করোনায় আক্রান্ত হতে পারে। তবে আলোচ্য গবেষকরা বিশ্বাস করেন যে, প্রধানত বাতাসের মাধ্যমেই করোনা ছড়িয়েছে থাকে। "করোনা কেবল বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়, অন্য কোনো উপায়ে ছড়ায় না।" এমন কোনো কথা ল্যানসেটের নিবন্ধে নেই।
ইত্তেফাকের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে ল্যানসেটের রিপোর্টমতে, "হাঁচি, কাশি, কফ, থুতুর মাধ্যমে করোনা ছড়ায় না"। কিন্তু ল্যানসেটের রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে ঠিক উল্টো কথা। দেখুন ইংরেজি বাক্যটি-
"But if an infectious virus is mainly airborne, an individual could potentially be infected when they inhale aerosols produced when an infected person exhales, speaks, shouts, sings, sneezes, or coughs".
যার বাংলা অনুবাদ হল- "যদি কোনো সংক্রমণযোগ্য ভাইরাস প্রধানত বাতাসের মাধ্যমে বাহিত হয়, তবে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির মুখের বাতাস, কথা, চিৎকার, গান, হাঁচি কিংবা কাঁশির বাতাসের মাধ্যমে যেকোনো ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হতে পারে"।
অর্থাৎ, হাঁচি, কাশির মাধ্যমে করোনা না ছড়ানোর দাবিটি একেবারেই ভিত্তিহীন। ল্যানসেট এর আলোচ্য প্রতিবেদনেও এমন কথা বলা হয়নি।
ইত্তেফাকের প্রতিবেদনে ল্যানসেটের বরাতে আরেকটি 'তথ্য' ছিল, "যাঁরা বাইরে ঘুরেছেন তাঁদের চেয়ে যাঁরা ঘরে বদ্ধ থেকেছেন, তাঁদের রোগ হয়েছে বহুগুণ বেশী। বাস্তবে মৃতদের প্রায় ৮৬% ই ঘরে বদ্ধ ছিলেন।"।
কিন্তু ল্যানসেটের 'কমেন্ট'টিতে বলা হয়েছে, "transmission of SARS-CoV-2 is higher indoors than outdoors and is substantially reduced by indoor ventilation"; যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায়, "করোনার সংক্রমণ ঘরের ভিতরের চেয়ে বাইরে কম, তবে ঘরে বাতাসের যথাযথ ভ্যান্টিলেশন সুবিধা থাকলে সংক্রমণ কমে আসে।"
অর্থাৎ, ইংরেজি থেকে অনুবাদে বিকৃতি ঘটানো হয়েছে। এছাড়াও "বাস্তবে মৃতদের প্রায় ৮৬% ই ঘরে বদ্ধ ছিলেন"- বলে কোনো পরিসংখ্যান ল্যানসেটের প্রতিবেদনে নেই।
ইত্তেফাকের প্রতিবেদনে ল্যানসেট এর বরাতে আরেকটি দাবি হয়েছে: "লকডাউন এই করোনা নিয়ন্ত্রণে তেমন উপকারি নয়।" কিন্তু ল্যানসেটের 'কমেন্ট'টিতে লকডাউন সংক্রান্ত কোনো তথ্যেরই উল্লেখ পাওয়া যায়নি। বরং অন্যান্য গবেষণাপত্রে দেখা গেছে, যথাযথ লকডাউনের মাধ্যমে করোনার সংক্রমণ কমানো গেছে। দেখুন এরকম একটি গবেষণার লিংক এখানে।
আরেকটি 'তথ্য' দিয়েছে ইত্তেফাক যেখানে ল্যানসেট এর বরাতে বলা হয়েছে, "ভারত, বাংলাদেশ, চীন এসব ঘনবসতিপূর্ণ দেশে অবিলম্বে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের ভ্যাকসিন দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করতে বলা হয়েছে। এতে শিক্ষার উন্নতির সাথে শিশু কিশোরদের কোভিড হবার সম্ভাবনাও অনেক কমে যাবে।"
অথচ ল্যানসেটের উক্ত 'কমেন্ট'টিতে এ ধরণের কোনো আহবানের উল্লেখ পাওয়া যায়নি।