সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়েছে। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, একটি অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে যা বেকারত্ব দূর করতে সাহায্য করবে। একই ভিডিওতে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলামকে বলতে দেখা যায়, সব শিক্ষার্থীরা মুহাম্মদ ইউনূসের অ্যাপটিতে খেলে আয় করছে। ভিডিওটিতে সময় টেলিভিশনের লোগোযুক্ত একজন সংবাদ পাঠিকার এ সংক্রান্ত সংবাদ পাঠের দৃশ্যও যুক্ত করা হয়েছে। ভিডিও সহ এরকম একটি পোস্ট দেখুন এখানে।
এছাড়াও আরো একটি ভিডিওতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বলতে দেখা যায়, দেশের বর্তমান বিপর্যয়ের কারণে আমি একটি নতুন এপ্লিকেশন তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। Crazy Time নামক এই অ্যাপে মাত্র ৫ টাকা বিনিয়োগ করে অনেক ভালো আয় করা যাবে। এমনকি প্রথম দিনেই ৫০ হাজার বা এক লক্ষ টাকা জিততে (আয় করতে) পারেন। ভিডিও সহ এরকম একটি পোস্ট দেখুন এখানে।
গত ২০ অক্টোবর 'Yudi liceth Arboleda' নামের পেজ থেকে ভিডিওটি (প্রথমে উল্লিখিত) পোস্ট করা হয়। ভিডিওটি দিয়ে একটি অ্যাপের প্রচারণা চালানো হচ্ছে। পোস্টটির স্ক্রিনশটের (কোলাজ) দেখুন--
ফ্যাক্ট চেক:
বুম বাংলাদেশ যাচাই করে দেখেছে, দাবিটি সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও একই ভিডিওতে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলামের ভিডিও প্রযুক্তির সাহায্যে সম্পাদনার মাধ্যমে তাঁদের কণ্ঠের অনুরূপ নকল কণ্ঠ তৈরি ও যুক্ত করে এই ভিডিওটি বানানো হয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস কিংবা নাহিদ ইসলাম কর্তৃক এমন প্রচারণার কোনো সত্যতাও কোনো মাধ্যমে পাওয়া যায়নি।
ভিডিও থেকে কি-ফ্রেম তৈরি করে ছবিটি রিভার্স ইমেজ সার্চ এর মাধ্যমে বেসরকারি সম্প্রচার মাধ্যম সময় 'এটিএন নিউজ' এর একটি ইউটিউব চ্যানেলে "অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে যা বললেন ড. ইউনূস" শিরোনামে প্রকাশিত ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর মূল ভিডিওটি পাওয়া যায়। ভিডিওটিতে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে তরুণদের অবদান ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে তাকে কথা বলতে দেখা গেছে।
তবে, ভিডিওটিতে কোনো অ্যাপ এর প্রচারণা কিংবা আর্থিক প্রণোদনা নিয়ে কথা বলতে দেখা যায়নি। আলোচ্য ভিডিওটির স্থিরচিত্রের (বামে) সাথে 'এটিএন নিউজ' এর ইউটিউব চ্যানেলে পাওয়া ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর কথা বলার সময়ের দৃশ্যের (ডানে) পাশাপাশি মিল দেখুন--
ফেসবুকে প্রচারিত ভিডিওটির আরেক অংশে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলামের একটি ক্লিপও দেখা গেছে। ক্লিপটি থেকে কি-ফ্রেম তৈরি করে ছবিটি রিভার্স ইমেজ সার্চ এর মাধ্যমে বেসরকারি সম্প্রচার মাধ্যম সময় 'মাছরাঙা টেলিভিশন' এর একটি ইউটিউব চ্যানেলে "গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য একটি কমিশন গঠনের কথা প্রাথমিকভাবে ভাবা হচ্ছে-তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা" শিরোনামে প্রকাশিত নাহিদ ইসলাম এর মূল ভিডিওটি পাওয়া যায়। এসময়ে তিনি স্বাধীন গণমাধ্যম কমিশন বিষয়ে আলোচনা করেন। পাশাপাশি সেন্সর বোর্ড পুনর্গঠন সহ আরো নানবিধ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেন।
এক্ষেত্রেও মূল আলোচনায় নাহিদ ইসলামকে 'Crazy Time' নামক কোনো অ্যাপ এর প্রচারণা কিংবা এই অ্যাপ সংশ্লিষ্ট কোনো কথা বলতে দেখা যায়নি। ফেসবুকে প্রচারিত ভিডিওটির নাহিদ ইসলামের একটি ক্লিপটির স্থিরচিত্রের (বামে) সাথে 'মাছরাঙা টেলিভিশন' এর ইউটিউব চ্যানেলে পাওয়া নাহিদ ইসলাম এর কথা বলার সময়ের দৃশ্যের (ডানে) পাশাপাশি মিল দেখুন--
দেখা যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট আয়োজনে নিজেদের বক্তব্যে কিংবা স্পষ্ট করে বললে আলোচ্য ভিডিওটির মূল ভিডিওগুলোর দৃশ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং নাহিদ ইসলাম কোনো অ্যাপ এর প্রচারণা কিংবা আর্থিক প্রণোদনা নিয়ে কথা বলেননি। সেহেতু প্রতীয়মান হয়, আলোচ্য প্রচারিত ভিডিওতে অ্যাপ এর প্রচারণার বিষয়টি ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং নাহিদ ইসলাম এর কণ্ঠস্বর নকল (ভয়েস ক্লোন) করে তৈরি করা হয়েছে।
ভিডিওতে উল্লিখিত ড. মুহাম্মদ ইউনূস কিংবা নাহিদ ইসলাম কর্তৃক 'ক্রেজি টাইম' অ্যাপ এর প্রচারণার কোনো তথ্য গ্রহণযোগ্য কোনো মাধ্যমের কোথাও পাওয়া যায়না। তাই এরকম একটি বিষয়ে সময় টেলিভিশনের সংবাদ প্রকাশ করা তথা সংবাদ পাঠিকার এ সংশ্লিষ্ট সংবাদ পাঠের বিষয়টিও সমীচীন নয়।
এদিকে সংবাদ পাঠিকার মূল ভিডিওটি না পাওয়া গেলেও আলোচ্য ভিডিওতে তাঁর অঙ্গভঙ্গির অস্বাভাবিকতা ও কথার সাথে মুখের ভঙ্গিমার অমিল লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও তাকে অসম্পূর্ণ ও অসামঞ্জ্যপূর্ণ বাক্য পাঠ করতে শোনা যায়। সাধারণত সংবাদ পাঠের ক্ষেত্রে এরকমটা করা হয়না। এর ফলে প্রতীয়মান হয় যে সংবাদ পাঠিকার দৃশ্য ও কণ্ঠস্বরের ক্ষেত্রেও সম্পাদনা করা হয়েছে।
ভিডিওতে টেক্সট ফরম্যাটের লেখা (সংবাদ) এর বাক্য গঠনের ক্ষেত্রেও শব্দের ব্যবহার সহ কিছু অসামঞ্জস্যতা পাওয়া যায়। সাধারণত সংবাদের ক্ষেত্রে বাক্যের এমন ভুল দেখা যায়না। দেখুন--
ভিডিওটি এআই কন্টেন্ট সনাক্তের টুলস 'ট্রু মিডিয়া' ব্যবহার করে যাচাই করলে টুলসটি ভিডিওটির অডিও অংশকে অধিকতর সম্ভাব্য এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি বলে ফলাফল দিয়েছে। ফলাফলের স্ক্রিনশটের কোলাজ দেখুন--
অর্থাৎ সময় টেলিভিশনের লোগো যুক্ত করে একজন সংবাদ পাঠিকার সম্পাদিত ভিডিও সহ ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও নাহিদ ইসলামের ভিডিওতে প্রযুক্তিগত উপায়ে নকল কণ্ঠ তৈরি করে তা যুক্ত করার মাধ্যমে বেটিং বা এ জাতীয় কোনো অ্যাপের প্রচারণার ভুয়া ভিডিও প্রচার করা হয়েছে। তাঁরা কেউই বেটিং বা এ জাতীয় কোনো অ্যাপের প্রচারণা কিংবা অ্যাপ ব্যবহার করলে আর্থিক সহায়তার কথা বলেননি।
দ্বিতীয় ভিডিওটির ক্ষেত্রেও ভিডিও থেকে কি-ফ্রেম তৈরি করে ছবিটি রিভার্স ইমেজ সার্চ এর মাধ্যমে বেসরকারি সম্প্রচার মাধ্যম সময় 'এনটিভি' এর ইউটিউব চ্যানেলে "জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস (সরাসরি)" শিরোনামে প্রকাশিত ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর মূল ভিডিওটি পাওয়া যায়। এসময়ে তিনি ও তার উপদেষ্টা পর্ষদের সদস্যরা নিজ নিজ কর্তব্য পালন করা সহ তাদের কাজে সবাইকে এগিয়ে আসতে অনুরোধ করেন। অপরাধ সংঘটিত করেছে যারা, তাদেরকে আইনানুগ বিচারের মাধ্যমে শাস্তি সহ সকল ক্ষেত্রে অপরাধের বিচার নিশ্চিত করা সহ নানাবিধ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কথা বলেন।
পুর্বের ন্যায় এই ভিডিওটিতে কোনো অ্যাপ এর প্রচারণা কিংবা আর্থিক প্রণোদনা নিয়ে কথা বলতে দেখা যায়নি ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। আলোচ্য ভিডিওটির স্থিরচিত্রের (বামে) সাথে 'এনটিভি' এর ইউটিউব চ্যানেলে পাওয়া ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর জাতির উদ্দেশ্যে কথা বলার সময়ের দৃশ্যের (ডানে) পাশাপাশি মিল দেখুন--
আলোচ্য ভিডিওটির মূল ভিডিওর দৃশ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস কোনো অ্যাপ এর প্রচারণা কিংবা আর্থিক প্রণোদনা নিয়ে কথা বলেননি। সেহেতু প্রতীয়মান হয়, আলোচ্য প্রচারিত ভিডিওতে অ্যাপ এর প্রচারণার বিষয়টি ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর কণ্ঠস্বর নকল (ভয়েস ক্লোন) করে তৈরি করা হয়েছে।
অর্থাৎ ভিডিওটি বাস্তব নয় বরং প্রযুক্তিগত উপায়ে নকল কণ্ঠ তৈরি করে তা ভিডিওতে যুক্ত করার মাধ্যমে এটি তৈরি করা হয়েছে।
সুতরাং সামাজিক মাধ্যমে আর্থিক প্রতারণার উদ্দেশ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও নাহিদ ইসলামের ভিডিওতে প্রযুক্তির সাহায্যে নকল কণ্ঠ জুড়ে দিয়ে জুয়ার প্রচারণা চালানো হচ্ছে, যা প্রতারণামূলক।