বাংলাদেশের শীর্ষ স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে ১ অক্টোবর একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। খবরটিতে দাবি করা হয়েছে, বাংলাদেশের গ্লোব বায়োটেক কর্তৃক প্রস্তুতকৃত করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেট 'ব্যানকভিড'কে 'করোনা প্রতিরোধে সক্ষম ভ্যাকসিন' হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে মার্কিন একটি মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায়।
প্রথমে আমরা কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনের শিরোনাম (আর্কাইভ লিংকসহ) এখানে তুলে ধরা হলো--
বাংলাদেশ প্রতিদিন: মার্কিন জার্নালে প্রতিবেদন: গ্লোব বায়োটেকের ভ্যাকসিন করোনা প্রতিরোধে সক্ষম
কালের কণ্ঠ: মার্কিন মেডিক্যাল জার্নাল বায়োআর্কাইভের দাবি: করোনা প্রতিরোধে সক্ষম বাংলাদেশের ভ্যাকসিন 'ব্যানকোভিড'
সময়টিভি অনলাইন: 'করোনা প্রতিরোধে সক্ষম বাংলাদেশের ভ্যাকসিন'
আরটিভি অনলাইন: মার্কিন মেডিকেল জার্নালের প্রতিবেদন: করোনা প্রতিরোধে বাংলাদেশি গ্লোবের টিকা সক্ষম
নিউজ২৪ অনলাইন: 'করোনা প্রতিরোধে সক্ষম বাংলাদেশের ভ্যাকসিন'
বাংলানিউজ: 'গ্লোবের টিকা করোনা প্রতিরোধে সক্ষম'
ইত্তেফাক: 'দেশীয় প্রতিষ্ঠান গ্লোবের টিকা করোনা প্রতিরোধে সক্ষম'
ঢাকাটাইমস: বাংলাদেশি গ্লোবের ভ্যাকসিন করোনা প্রতিরোধে সক্ষম: মার্কিন জার্নাল
সমকাল: বাংলাদেশি টিকা করোনা প্রতিরোধে সক্ষম: বায়ো আর্কাইভ
গ্লোবালটিভি: গ্লোব বায়োটেকের ভ্যাকসিন করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সক্ষম : মার্কিন মেডিক্যাল জার্নাল
এবার নিচের কয়েকটি স্ক্রিনশটে কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনের শুরুর অংশগুলো দেখুন--
স্ক্রিনশট- ১:
স্ক্রিনশট- ২:
স্ক্রিনশট- ৩:
বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয়েছে, গ্লোব বায়োটেক এর ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেট 'ব্যানকভিড' সংক্রান্ত গবেষণাপত্রটি 'মার্কিন গবেষণা জার্নাল বায়োআর্কাইভ'-এ প্রকাশিত হয়েছে। উপরের বেশিরভাগ শিরোনামেই এই বিষয়টি স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। প্রতিবেদনের ভেতরেও দাবি করা হয়েছে, 'মার্কিন জার্নালে গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে'। (কিছু সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে 'করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সক্ষম' কথাটিকে কোট/আনকোটে রাখা হয়েছে। যদিও প্রতিবেদনের ভেতরে এই তথ্য 'মার্কিন জার্নাল' এর বরাতে তুলে ধরা হয়েছে।)
যেমন কয়েকটি প্রতিবেদনের ইন্ট্রো থেকে কিছু অংশ তুলে ধরা হলো-
বাংলানিউজের ইন্ট্রোতে লেখা হয়েছে--
"দেশীয় গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেকের তৈরি 'ব্যানকোভিড' (ডি৬১৪জি ভ্যারিয়েনটস এমআরএনএ ভিত্তিক) ভ্যাকসিন (টিকা) করোনা ভাইরাসকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম বলে মার্কিন মেডিক্যাল জার্নাল বায়োআর্কাইভে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। বুধবার (৩০ সেপ্টেম্বর) বায়োআর্কাইভ মেডিক্যাল জার্নালে এ সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করা হয়।"
সময় টিভির প্রতিবেদনের ইন্ট্রোতে বলা হয়েছে--
"বাংলাদেশের গ্লোব বায়োটেকের ভ্যাকসিন 'ব্যানকোভিড' (ডি৬১৪জি ভ্যারিয়েনটস এমআরএনএ ভিত্তিক) করোনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে সক্ষম বলে জানিয়েছে মার্কিন মেডিকেল বিষয়ক জার্নাল বায়োআর্কাইভ। বুধবার (৩০ সেপ্টেম্বর) মার্কিন জার্নালে এ তথ্য প্রকাশের পর বৃহস্পতিবার (০১ অক্টোবর) বিষয়টি সংবাদমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন গ্লোব বায়োটেক লিমিটেডের রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্টের প্রধান ড. আসিফ মাহমুদ।"
কালের কণ্ঠের ইন্ট্রোতে বলা হয়েছে--
"মারণভাইরাস করোনার ভ্যাকসিন তৈরি করছে সারা বিশ্বের অনেক দেশই। সেই দৌড়ে রয়েছে বাংলাদেশও। আর দেশের গ্লোব বায়োটেকের ভ্যাকসিন 'ব্যানকোভিড' (ডি৬১৪জি ভ্যারিয়েনটস এমআরএনএ ভিত্তিক) করোনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে সক্ষম বলে জানিয়েছে মার্কিন মেডিক্যাল বিষয়ক জার্নাল বায়োআর্কাইভ।"
ভোরের কাগজ- এর প্রতিবেদনে 'বায়োআইর্কাইভ'কে 'শীর্ষস্থানীয় মার্কিন মেডিকেল জার্নাল' এবং 'বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় মেডিকেল জার্নাল' বলে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে।
ফ্যাক্ট চেক:
বুম বাংলাদেশ- এর যাচাইয়ে দেখা যাচ্ছে, গ্লোব বায়োটেক এর প্রস্তুতকৃত ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেট 'ব্যানকভিড' সংক্রান্ত গবেষণাপত্রটি এখনও কোনো গবেষণা জার্নালে প্রকাশিত হয়নি।
বায়োআর্কাইভ (BioRxiv.org) নামে যে ওয়েবসাইটের কথা বলা হয়েছে সেটি কোনো 'গবেষণা জার্নাল' নয়। এটি একটি 'প্রি-প্রিন্ট' আর্কাইভ।
BioRxiv এর ওয়েবসাইটের এবাউট সেকশনে তাদের পরিচয় সম্পর্কে লেখা আছে-
"bioRxiv (pronounced "bio-archive") is a free online archive and distribution service for unpublished preprints in the life sciences. It is operated by Cold Spring Harbor Laboratory, a not-for-profit research and educational institution. By posting preprints on bioRxiv, authors are able to make their findings immediately available to the scientific community and receive feedback on draft manuscripts before they are submitted to journals."
জার্নাল আর প্রি-প্রিন্ট আর্কাইভের মধ্যে পার্থক্য কী তা BioRxiv এর ওয়েবসাইটেই একটি ট্যাবে উল্লেখ করে দেয়া হয়েছে। পড়ুন এই লিংকে।
উপরের স্ক্রিনশটে লেখা টেক্সটে যা বলা হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত রূপ হলো- "সাধারণত একটি জার্নাল-আর্টিকেল তখন প্রকাশযোগ্য যখন উক্ত জার্নালের সম্পাদকমণ্ডলী আর্টিকেলটির ব্যাপারে সন্তুষ্ট থাকে যে জার্নালটির লেখক বিশেষজ্ঞদের দেয়া পরামর্শ আমলে নিয়েছেন। বায়ো-আর্কাইভের পাঠকদের তাই সচেতন থাকা উচিত যে এখানে প্রকাশিত আর্টিকেলগুলো লেখকের শেষ কথা নয়। এছাড়াও এখানে প্রকাশিত আর্টিকেলগুলোতে ভুলও থাকতে পারে এবং এমন তথ্য থাকতে পারে যা বৈজ্ঞানিক-চিকিৎসক মহলে স্বীকৃত বা গৃহীত নয়।"
অর্থাৎ, প্রি-প্রিন্ট আর্কাইভ আর গবেষণা জার্নাল সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। জার্নালে কোনো গবেষণা প্রকাশের আগে তা সংশ্লিষ্ট ফিল্ডে বিশেষজ্ঞ 'পিয়ার'দের দ্বারা যাচাইবাছাই এবং সংশোধন পরিমার্জনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সেই প্রক্রিয়ায় উত্তীর্ণ হলেই কেবল কোনো গবেষণা জার্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। কিন্তু পিয়ার-রিভিউ এর আগেও কিছু আর্কাইভে কোনো গবেষণা প্রকাশ করা হয়, যার মূল উদ্দেশ্য হলো সংশ্লিষ্ট ফিল্ডের বিজ্ঞানীদেরকে গবেষণাটি সম্পর্কে ধারণা দেয়া, তাদের কাছ থেকে মতামত সংগ্রহ করা ইত্যাদি।
গ্লোব বায়োটেক এর গবেষণাপত্রটি নিজেদের আর্কাইভে প্রকাশ করে শিরোনামের উপরের হলুদ রঙে হাইলাইট করে লিখে রাখা হয়েছে--"bioRxiv is receiving many new papers on coronavirus SARS-CoV-2. A reminder: these are preliminary reports that have not been peer-reviewed. They should not be regarded as conclusive, guide clinical practice/health-related behavior, or be reported in news media as established information."
অর্থাৎ, "বায়োআর্কাইভ করোনাভাইরাস সংক্রান্ত বহু গবেষণাপত্র পাচ্ছে। তবে মনে রাখতে হবে, এগুলো প্রাথমিক রিপোর্ট যা কোনো পিয়াররিভিউ জার্নালে প্রকাশিত হয়নি। এগুলোর ভিত্তিতে উপসংহার টানার সুযোগ নেই, কোনো ধরনের ক্লিনিকাল এবং স্বাস্থ্যগত বিষয়ে নির্দেশনা হিসেবে না অথবা প্রতিষ্ঠিত তথ্য হিসেবে সংবাদমাধ্যমেও প্রকাশিত হওয়া উচিত হবে না।"
সিদ্ধান্ত:
বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যমে BioRxiv-কে 'মেডিকেল জার্নাল', 'মার্কিন মেডিকেল জার্নাল', 'শীর্ষস্থানীয় মেডিকেল জার্নাল', 'বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় মেডিকেল জার্নাল' ইত্যাদি বলে যে তথ্য দেয়া হয়েছে তা ভুল। 'বিজ্ঞান বিষয়ক পিয়ার-রিভিউড জার্নালে প্রকাশিত' হওয়া গবেষণাপত্রে যেসব তথ্য প্রকাশিত হয় সেগুলোকে 'বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত' হিসেবে ধরে নেয়া হয়। কিন্তু কোনো পিয়ার-রিভিউ জার্নালে প্রকাশিত নয় এমন গবেষণাপত্রে উল্লেখিত অনেক তথ্যে ভুল, অসম্পূর্ণ তথ্য থাকার শঙ্কা থেকে যায়। ফলে এই ধরনের গবেষণাপত্রের আলোকে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসার সুযোগ নেই। কিন্তু বাংলাদেশি অনেক সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে এবং প্রতিবেদনের ভেতরে গ্লোব বায়োটেক এর জার্নালে প্রকাশ না হওয়া গবেষণাপত্রের আলোকে সিদ্ধান্তমূলক তথ্য দেয়া হয়েছে যে, "গ্লোবের ভ্যাকসিন করোনা প্রতিরোধে সক্ষম"; যা বিভ্রান্তিকর।