সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের কিছু আইডি গ্রুপ ও পেজে একটি পাসপোর্টের ছবি দিয়ে বলা হচ্ছে যে, এটি প্রাচীন মিশরের ১৯ তম রাজবংশের তৃতীয় শাসক ফারাও দ্বিতীয় রেমেসিস বা ফেরাউনের পাসপোর্টের ছবি। এরকম কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
গত ২৬ এপ্রিল 'হৃদয়ে মণিরামপুর' নামের একটি পাবলিক গ্রুপে 'Moniruzzaman Tito' নামের আইডি থেকে একটি পাসপোর্টের ছবি পোস্ট করে ক্যাপশনে লেখা হয়, 'এটা ফেরাউনের পাসপোর্ট! ফেরাউনের মমি ফ্রান্সে নেওয়ার জন্য এই পাসপোর্টটি মিশর সরকার ১৯৭৪ সালে ফেরাউনের নামে ইস্যু করে!' স্ক্রিনশট দেখুন--
ছবিতে দেখা যায় যে, ১৯৭৪ সালে ইস্যু করা ওই পাসপোর্টে ফারাও দ্বিতীয় রেমেসিসের জন্ম সাল দেখাচ্ছে খ্রিস্টপূর্ব ১৩০৩ সাল এবং জাতীয়তা ইজিপশিয়ান অর্থাৎ মিশরীয়। সেখানে ফারাও এর ছবি হিসেবে একটি মমি করা মুখের ছবিও যুক্ত করা হয়েছে।
ফ্যাক্ট চেক:
বুম বাংলাদেশ যাচাই করে দেখেছে যে, ফারাও দ্বিতীয় রেমেসিসের পাসপোর্ট হিসেবে আলোচ্য ছবিটি প্রকৃতপক্ষে তার পাসপোর্টের ছবি নয় বরং এটি একজন শিল্পীর আঁকা শিল্পকর্ম।
ফারাও দ্বিতীয় রেমেসিস প্রাচীন মিশরের ১৯তম রাজবংশের তৃতীয় শাসক ছিলেন এবং তিনি প্রায় ৩০০০ বছর আগে মাত্র ১৪ বছর বয়সে ক্ষমতাসীন হয়ে মহাপরাক্রমের সাথে ১২৭৯ থেকে ১২১৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত আনুমানিক প্রায় ৭ দশক প্রাচীন মিশর শাসন করেন। ১২১৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ৯৬ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়। এসময় তাকে মিশরের রাজধানী শহর কায়রোর 'কিংস ভ্যালি'তে মমি হিসেবে সমাহিত করা হয়।
১৯৭৫ সালে ফরাসি চিকিৎসক মরিস বুকাইলি ফারাও দ্বিতীয় রেমেসিসের দেহাবশেষ পরীক্ষা করে জানান যে, ছত্রাকের আক্রমণের ফলে ফারাওর মমিটি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। তাই মমিটির সংস্কারের জন্যে জরুরি ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এসময়ে, মমিটি ফ্রান্সে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন পড়লে ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় আইন (যেকোনো জীবিত বা মৃত ব্যক্তিকে ফ্রান্সে প্রবেশ করতে হলে আগে পাসপোর্ট তৈরি করতে হয়) মেনে ফারাও দ্বিতীয় রেমেসিসের নামে ইস্যু করা হয়। এ ব্যাপারে National Geograohic-র করা একটি প্রতিবেদন দেখুন এখানে। প্রতিবেদনটির স্ক্রিনশটে দেখুন--
কি-ওয়ার্ড সার্চ করে ব্রিটেনভিত্তিক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, প্রত্নতত্ত্ব গবেষণা ও ভ্রমণ সংক্রান্ত ব্লগিং ওয়েবসাইট 'HeritageDaily'-তে ফারাও দ্বিতীয় রেমেসিসের পাসপোর্টের আলোচ্য ছবিটিসহ একটি প্রতিবেদন খুঁজে পায় বুম বাংলাদেশ। তবে ওই প্রতিবেদনে পাসপোর্টের ওই ছবির ক্যাপশনে ইমেজ ক্রেডিট হিসেবে স্পষ্ট করে লাল হরফে বলা হয়েছে, "Image Credit – HeritageDaily – An artist's creation of the passport – Image is for representative purposes – The actual passport is not publicly available."। অর্থাৎ ছবিটি বাস্তব নয় বরং শিল্পির আঁকা। দেখুন স্ক্রিনশট--
এদিকে, 'The New York Times' ১৯৭৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যেখানে ফারাও দ্বিতীয় রেমেসিসের মমিকে সংস্কাররের জন্য ফ্রান্স নিয়ে যাওয়া এবং সংস্কার কাজ করার প্রমাণ পাওয়া যায়।
তবে আলোচ্য ছবিটির সাথে ফারাও দ্বিতীয় রেমেসিসের মমি ফ্রান্সে নিয়ে যাওয়ার কোনো যোগসূত্র পাওয়া যায় না। ফারাও এর নামে তখন মিশর সরকার পাসপোর্ট ইস্যু করার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তবে সেই পাসপোর্টের কোনো ছবি জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি। 'HeritageDaily'-র ওই লেখায় বলা হয়েছে যে, ফারাওর পাসপোর্টের ওই ভাইরাল ছবিটি আসলে ফারাওর পাসপোর্টের সম্ভাব্য একটি ইলাস্ট্রেশান। এমনকি পাসপোর্টটিতে কিউআর স্ক্যানকোডের নিচে 'HeritageDaily.com'-র নাম লেখা থাকতে দেখা গেছে। ছবিটি খেয়াল করে দেখুন--
আবার, আলোচ্য পাসপোর্টের ছবিটি দেখলে বোঝা যায় যে, এটি একটি মেশিন রিডেবল অত্যাধুনিক পাসপোর্টের নমুনা, যেটি ১৯৭৪ সালে ইস্যু করা সম্ভব নয়। কী ওয়ার্ড ধরে সার্চ করে দেখা গেছে যে, মিশরে প্রথম মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট চালু হয় ২০০৮ সালে। তাই, ভাইরাল ওই ছবির পাসপোর্টটি ১৯৭৪ সালে চালু হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী গণমাধ্যম খালিজ টাইমসে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন দেখুন এখানে।
এছাড়া, National Geographic তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক নিবন্ধে উল্লেখ করেছে যে, ১৯৭৪ সালে যখন দ্বিতীয় রেমেসিসের জন্যে পাসপোর্ট তৈরী করা হয় তখন সেখানে ফারাওর একটি সম্ভাব্য প্রাচীন চেহারা সংযুক্ত করা হয়। তবে, সেই পাসপোর্ট এবং পাসপোর্টে যুক্ত ফারাও দ্বিতীয় রেমেসিসের চেহারা জনসম্মুখে কখনই প্রকাশ করা হয়নি।
তাই, প্রাচীন মিশরের শাসনকর্তা ফারাও দ্বিতীয় রেমেসিসের পাসপোর্ট হিসেবে যে ছবি ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে সেটি ফারাও রেমেসিসের অফিসিয়াল বা আসল ছবি নয় বরং এটি শিল্পির আঁকা একটি প্রতীকী ছবি।
অর্থাৎ ফেরাউনের পাসপোর্টের ছবি উল্লেখ করে প্রকৃতপক্ষে শিল্পির আঁকা একটি প্রতীকী ছবি প্রচার করা হচ্ছে ফেসবুকে, যা বিভ্রান্তিকর।