ঘটনাবহুল বছর ২০২১। ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থায় কাজ করার অভিজ্ঞতা বলছে, ভুয়া বা বানোয়াট খবর সাধারণত কোন ঘটনা বা ঘটনা প্রবাহকে আশ্রয় করে ছড়িয়ে পড়ে এবং এমন একটি প্রবণতা সংশ্লিষ্ট ঘটনাকে ঘিরে বেশ কিছুদিন ধরে চলতে থাকে। ঠিক তেমনি ২০২১ সালে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভুয়া খবর ছড়িয়েছিল সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে।
২০২০ সালের শুরুতে করোনা অতিমারি শুরু হওয়ার পর থেকে কোভিড-১৯ ও এ নিয়ে সরকারের নানা পদক্ষেপ নিয়ে যেমন করে ভুয়া খবর ছড়িয়ে পড়েছিল, ২০২১ সালেও তা অব্যাহত ছিল। কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে সরকারের লকডাউন ঘোষণা, লকডাউন শিথিল করা কিংবা বিধিনিষেধ আরোপ করা, কোভিডের চিকিৎসা ও লকডাউন প্রত্যাহারের দাবিতে সাধারণ ব্যবসায়ীদের বিক্ষোভ ইত্যাদিকে আশ্রয় করে ভুয়া খবর ছড়িয়েছে। পাশাপাশি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুর্বণ জয়ন্তী, হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন ও ধর্মীয় বক্তাদের গ্রেফতার, চিত্রনায়িকা পরিমনি ইস্যু, ঘুর্ণিঝড় ইয়াস, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার ও তালেবানের আফগান অধিগ্রহণ এবং সবশেষ বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা চলাকালে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও এর রেশ ধরে ভারতের কোথাও কোথাও সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর হামলার ঘটনা ছিল উল্লেখযোগ্য, যেসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভুয়া খবর ছড়িয়েছে বাংলাদেশের সামাজিক মাধ্যমে। এছাড়া, মধ্যপ্রাচ্যের ইসরায়েল, ফিলিস্তিন, সিরিয়া ও ইরান ইস্যুও ছিল অন্যান্য বছরের মত আলোচ্য বিষয়, যেসব বিষয়কে কেন্দ্র করেও ভুয়া খবর ছড়িয়েছে।
২০২১ সালে ছড়িয়ে পড়া ভুয়া খবর চিহ্নিত করে বুম বাংলাদেশের ফ্যাক্ট চেকারদের করা ফ্যাক্টচেক স্টোরিগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বা শীর্ষ কিছু ফ্যাক্ট চেক স্টোরি ধারাবাহিকভাবে নিম্নে তুলে ধরা হলো।
এক.
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় ফেসবুকে তাঁর ভেরিফায়েড পেজ থেকে বিদায়ী বছরের শুরুতে ১০ জানুয়ারি বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের একটি প্রচ্ছদের ছবি পোস্ট করে লিখেন, "Cover of Time Magazine (17 January 1972)"। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিসহ টাইমের ওই প্রচ্ছদটিতে লেখা রয়েছে: "Sheik Mujibur Rahman- Bangladesh: From Jail To Power"। এই পোস্টটি নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ায়, ফেসবুকের অনেক ব্যবহারকারী এটি সত্য নয় মর্মে ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি অর্থাৎ একই বছরের একই তারিখে প্রকাশিত টাইম ম্যাগাজিনের সংখ্যার প্রচ্ছদ রয়েছে এমন একটি লিংক জুড়ে দেন। এ বিষয়ে বুম বাংলাদেশের তদন্তে বেরিয়ে আসে, এটি টাইম ম্যাগাজিনেরই প্রচ্ছদ, সংখ্যাও ঠিকই আছে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর জানা যায়, টাইম ম্যাগাজিন সারা পৃথিবীর জন্য ৪টি ভার্সন প্রকাশ করে থাকে। এর মধ্যে যারা জয়ের পোস্ট মিথ্যা দাবি করে যুক্তি হিসেবে লিংক জুড়ে দিয়েছেন, তারা মূলত টাইমের ওই তারিখে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্র ভার্সনের লিংক জুড়ে দিয়েছেন। অন্য ৩টি ভার্সনের প্রচ্ছদ টাইম কর্তৃপক্ষ আর্কাইভে আপডেট করার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। তাই অন্য ভার্সনগুলো টাইমের আর্কাইভে পাওয়া না গেলেও, আলোচ্য প্রচ্ছদ নিয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি গণমাধ্যমে লেখা একটি কলামের সুত্র ধরে, ওই কলামিস্টের সাথে যোগাযোগ করে তাঁর কাছে থাকা ভার্সনটির একটি কপির ছবি সংগ্রহ করতে সক্ষম হয় বুম বাংলাদেশ। এ নিয়ে বুম বাংলাদেশের ফ্যাক্ট চেক প্রতিবেদন, "সজীব ওয়াজেদ জয়ের ফেসবুক পোস্ট নিয়ে অসত্য প্রচারণা"। দেখুন স্ক্রিনশট--
দুই.
একটি বিলাসবহুল সাদা রংয়ের টয়োটা প্রাডো গাড়িতে হেফাজত নেতা মামুনুল হকের বসে থাকার ছবি গত বছরের ৪ মার্চ পোস্ট করে বলা হয়, গাড়িটি তাঁর এবং কোটি টাকায় এটি তিনি কিনেছেন। পরে বুম বাংলাদেশ অনুসন্ধান করে দেখে, গাড়িটি তাঁর নয়। এর দুইদিন আগে অর্থাৎ গত বছরের ২ মার্চ সিলেটের ছাতকের এক ব্যবসায়ীর ব্যক্তিগত এই গাড়িতে করে মামুনুল হক একটি ওয়াজ মাহফিলে যোগ দিতে গেলে সেখানে ছবিটি তোলা হয়। এ নিয়ে বুম বাংলাদেশের ফ্যাক্ট চেক প্রতিবেদন, "ল্যান্ড ক্রুজার গাড়িটি কি মাওলানা মামুনুল হকের?"
তিন.
মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক করোনার টিকা না নিয়ে, টিকা নেয়ার অভিনয় করেছেন দাবিতে একটি ভিডিও গত বছরের মার্চ মাসে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়। পরে বুম বাংলাদেশ অনুসন্ধান করে সত্য উদঘাটন করে, মন্ত্রী টিকা নিয়েছেন ঠিকই কিন্তু পরবর্তীতে তিনি এক টেলিভিশন সাংবাদিকের (যিনি প্রথমবার ভিডিও ধারণ করতে পারেননি) অনুরোধে ক্যামেরার সামনে টিকা নেয়ার ডেমো দেখিয়েছেন। এ নিয়ে ফ্যাক্ট চেক প্রতিবেদনের স্ক্রিনশট দেখুন--
চার.
বাংলাদেশের প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহর নাম ও ছবি সম্বলিত দুটি চিকিৎসাপত্র পোস্ট করা হয় গত বছরের মে মাসে, যেখানে করোনা আক্রান্তদের জন্য লক্ষণ অনুযায়ী বেশকিছু পরামর্শের পাশাপাশি ওষুধের তালিকা দেয়া হয়েছে। বুম বাংলাদেশ যাচাই করে দেখে, পোস্টটি ভিত্তিহীন। ডা. আবদুল্লাহ এমন কোন চিকিৎসাপত্র দেননি। এ নিয়ে ফ্যাক্ট চেক প্রতিবেদনের শিরোনাম, "এবিএম আব্দুল্লাহর নামে ছড়ানো কোভিড-১৯ এর চিকিৎসাপত্রটি ভুয়া"
পাঁচ.
গত বছরের ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস আঘাত হানার সময়ে ফেসবুকে শহরের রাস্তায় বন্যার পানির তীব্র স্রোতের একটি ভিডিও লাইভ মুডে প্রচার করে দাবি করা হয়, এটি ওই দিনের ঘটনা। ভিডিওতে দেখা যায়, পানির স্রোত এক নারীকে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় কয়েকজন তাকে উদ্ধার করে এবং একটি গাড়িকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। বুম বাংলাদেশ যাচাই করে দেখে এটি কলম্বিয়ার বাররানকুইল্লা শহরে বন্যার পুরোনো ভিডিও। এ নিয়ে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনের শিরোনাম, "ভিডিওটি সাম্প্রতিক কোনো ঝড়ের নয়"
ছয়.
গত বছরের ৮ জুন ফেসবুকে দুটি ছবির একটি কোলাজ দিয়ে দাবি করা হয়, চীনে উইঘুর মুসলিমদের নির্যাতন করার ছবি এটি। ছবিতে দেখা যায় এক ব্যক্তিকে একটি বিশেষ চেয়ারে বসিয়ে রেখে তাঁর হাত পা ও শরীর লোহার শিকলে আটকিয়ে রাখা হয়েছে। বুম বাংলাদেশ যাচাই করে ছবিটি সংক্রান্ত একটি ভিডিও খুঁজে পায়, যেখানে দেখা যায় সামাজিক মাধ্যমে কটু মন্তব্য বা গালাগালি করার দায়ে একজন চীনা নাগরিককে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন দেশটির পুলিশ। যেখানে আটক ওই ব্যক্তি নিজের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। আটক ব্যক্তি ও পুলিশের মধ্যকার কথোপকথন নির্ভুল বঙ্গানুবাদের স্বার্থে চাইনিজ ও বাংলা ভাষার দোভাষীর সহায়তাও নেয়া হয়। এ নিয়ে বুম বাংলাদেশের ফ্যাক্ট চেক প্রতিবেদনের স্ক্রিনশট দেখুন--
সাত.
গত বছরের ৮ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিক্ষোভের ভিডিও লাইভ মুডে প্রচার করে বলা হয়, পরীমনির ফাঁসির দাবিতে এই বিক্ষোভ হচ্ছে। বুম বাংলাদেশ ভিডিওটি নিয়ে অনুসন্ধান করে দেখে দাবিটি ভুয়া বরং ভিডিওটি মূলত গত ১ মার্চ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে হওয়া একটি বিক্ষোভ মিছিলের। এ নিয়ে ফ্যাক্ট চেক প্রতিবেদনের শিরোনাম, "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষোভের ভিডিওকে পরিমনির ফাঁসির দাবির বলে প্রচার"
আট.
গত বছরের ১৫ আগস্ট রাস্তায় একটি বৃহদাকার ফটকের সামনে তরুণদের উচ্ছ্বাসের ছবি পোস্ট করে দাবি করা হয়, এটি আফগানিস্তানে তালেবানদের রাজধানী কাবুলে প্রবেশ করার ছবি। বুম বাংলাদশ যাচাই করে দেখে, দাবিটি অসত্য এবং ছবিটি মূলত ২০১৮ সালের ১৬ জুন আফগানিস্তানের নানগারহার প্রদেশের রোদাত জেলায় আফগান সরকার ও তালেবানের মধ্যকার যুদ্ধবিরতির পর সাধারণ নাগরিকদের উল্লাসের সময় তোলা। এ নিয়ে ফ্যাক্ট চেক প্রতিবেদনের স্ক্রিনশট দেখুন--
নয়.
গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর ফেসবুকে একটি ভিডিও শেয়ার করে বলা হয়, "ওসি প্রদীপের ফাঁসি দেওয়া উচিত বললেন প্রধানমন্ত্রী, ওসি প্রদীপ নিয়ে যা বললো প্রধানমন্ত্রী"। ভিডিওটিতে শেখ হাসিনার একপাশে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন ও অন্যপাশে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনকে বসে থাকতে দেখা যায়। পরে বুম বাংলাদেশ যাচাই করে দেখে, প্রধানমন্ত্রী এ ধরণের কোন বক্তব্য দেননি ওই ভিডিওতে। যেখানে ভিডিওটির আবহে কণ্ঠ দিয়ে এক প্রশ্নকারীকে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি দীর্ঘ আলংকারিক প্রশ্ন ছুড়ে দিতে দেখা যায় এবং ভিডিওর একই ক্লিপ বারবার দেখাতে থাকে। এ নিয়ে বুম বাংলাদেশের ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনের স্ক্রিনশট দেখুন--
দশ.
গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর রাস্তায় মাছ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকার কভার ছবিসহ একটি খবরের লিংক পোস্ট করে দাবি করা হয়, ছবিটি হন্ডুরাসে হওয়া মাছ বৃষ্টির ঘটনার। বুম বাংলাদেশ যাচাই করে দেখে খবরের সাথে যুক্ত ছবিটি চীনের গুইঝো প্রদেশে ঘটা একটি মাছের ট্রাক দুর্ঘটনার। এ নিয়ে ফ্যাক্ট চেক প্রতিবেদনের শিরোনাম, "খবরটি হন্ডুরাসের মাছ-বৃষ্টির, ছবিটি চীনের মাছের ট্রাক দুর্ঘটনার"।
এগার.
গত বছরের ১৩ অক্টোবর কুমিল্লায় কুরআন অবমাননার অভিযোগে সারাদেশে হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িক সহিংসতা শুরু হয়। এর মধ্যে ১৬ অক্টোবর একটি খবর ফেসবুকে ভাইরাল হয়, যেখানে বলা হয় চাঁদপুরে এক হিন্দু পরিবারের মা, মেয়ে, বোনের মেয়ে সবাই ধর্ষিত হয়েছেন। এরমধ্যে ১০ বছরের মেয়েটি মারা গেছে। খবরটি মুহুর্তেই সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। বুম বাংলাদেশ অনুসন্ধান চালিয়ে দেখে, খবরটি ভিত্তিহীন। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন, স্থানীয় সাংবাদিক, স্থানীয় পূজা উদযাপন পরিষদ ও স্থানীয় হিন্দু নেতারা খবরটিকে ভিত্তিহীন বলে চিহ্নিত করে। এ নিয়ে বুম বাংলাদেশের প্রতিবেদনের শিরোনাম, "চাঁদপুরে হিন্দু কিশোরী ধর্ষিত হওয়ার ভিত্তিহীন খবর ভাইরাল"
বার.
গত বছরের ১৭ নভেম্বর আইসিইউতে চিকিৎসারত এক নারীর ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে দাবি করা হয় ছবিটি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার, তিনি জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আছেন। বুম বাংলাদেশ যাচাই করে দেখে, ছবিটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বেগম খালেদা জিয়ার নয় বরং সামসাদ বেগম নামের এক নারীর যিনি গত ফেব্রুয়ারী মাসে মারা গেছেন। এ নিয়ে ফ্যাক্ট চেক প্রতিবেদনের স্ক্রিনশট দেখুন--
এছাড়া, গত বছর মূলধারার কোন কোন গণমাধ্যম কয়টি ভুয়া ও বিভ্রান্তিকর খবর ছড়িয়েছে, তা পড়তে ক্লিক করুন এখানে।