ফেসবুকে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। BangladeshDarpan.com নামের একটি পেইজে গত ৭ জুলাই ভিডিওটি আপলোড করার পর ১৪ জুলাই পর্যন্ত ১৩ হাজারের বেশি মানুষ এটি শেয়ার করেছেন, এবং ১৪ লাখের বেশিবার ভিডিওটি 'ভিউ' হয়েছে।
এর বাইরেও কিছু ফেসবুক পেইজ থেকে ভিডিওটি পোস্ট করা হয়েছে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, "২০০ বছরের পুরনো শিব মন্দিরের জায়গা জোরপূর্বক দখলের ঘটনা ঘটেছে"। দেখুন নিচের স্ক্রিনশটে--
ভিডিওতে শোনা যায় একজন ব্যক্তি চিৎকার করে বলছেন, "দর্শক আপনারা দেখতে পাচ্ছেন হিন্দুদের ওপর কিভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে। একটু দেখেন, দেখেন একটু দেখেন, আপনারা দেখতে পাচ্ছেন।... দেখুন সংখ্যালঘুদের ওপর কিভাবে নির্যাতন করতেছে ভাই। সবাই দেখুন একটু সংখ্যালঘুদের ওপর কিভাবে নির্যাতন চলেতেছে। একটু দেখুন আপনারা লাইভে, দেখুন।..."
আরেকটি কণ্ঠ শোনা যায় যিনি বলছেন, "লুট করতেছে লুট।"
BangladeshDarpan.com নামক ফেসবুক পেইজে ভিডিওটির ক্যাপশনের শেষাংশে "বিস্তারিত পড়ুন" বলে একটি লিংক যুক্ত করা হয়েছে। তাতে ক্লিক করলে একই ওয়েবসাইটের একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায় যার শিরোনাম, "পিরোজপুরে ২শ বছরের পুরনো শিব মন্দিরের জমি দখল (ভিডিও)"।
আর্কাইভ লিংক এখানে।
প্রতিবেদনটির প্রথম চারটি প্যারা এখানে হুবহু তুলে ধরা হলো--
"পিরোজপুর জেলায় একটি সম্ভ্রান্ত সংখ্যালঘু হিন্দু পরিবারের ২০০ বছরের পুরনো শিব মন্দিরের জায়গা (১০ শতাংশ) ও পারিবারিক ১১ শতাংশ জায়গা দেশের আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জোরপূর্বক দখল করেছে প্রভাবশালী ভূমিদস্যু।
পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর থানার অন্তর্গত দিঘিরজান গ্রামে এ ঘটনাটি ঘটেছে। ভুক্তভোগী শ্রী দীপ্তেন মজুমদার স্থানীয় শহীদ জননী কলেজের প্রিন্সিপাল। একইসাথে তিনি হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নাজিরপুর উপজেলার সহ-সভাপতিও।
দীপ্তেন মজুমদার আক্ষেপ করে বলেন, তাদের ২০০ বছরের পুরনো শিব মন্দিরের ১০ শতাংশ ও ব্যক্তিমালিকানাধীন ১১ শতাংশ জায়গা কাঁটা তার ও বাঁশ দিয়ে বেড়া দিয়েছিলেন। সরকারি খতিয়ানে ওই জায়গা ও মন্দির তাদের নামেই রেকর্ড করা।
সোমবার (৬ জুলাই) সকাল ৮ টার দিকে মোঃ কামরুল শেখের (কাবুল) নেতৃত্বে মোঃ শাহজাহান শেখ (তহসিলদার) ও মোঃ হেদায়েত শেখ লাঠিয়াল বাহিনী একত্রিত হয়ে কাঁটাতার ও বাঁশের বেড়া ভেঙে দিয়ে জায়গা দখল করে নেন।"
অভিযোগ:
BangladeshDarpan.com এর প্রতিবেদনে অভিযোগ হচ্ছে- "সংখ্যালঘু হিন্দু পরিবারের ২০০ বছরের পুরনো শিব মন্দিরের জায়গা (১০ শতাংশ) ও পারিবারিক ১১ শতাংশ জায়গা দেশের আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জোরপূর্বক দখল করেছে প্রভাবশালী ভূমিদস্যু।"
এবং এই অভিযুক্তরা হচ্ছেন, মোঃ কামরুল শেখের (কাবুল), মোঃ শাহজাহান শেখ (তহসিলদার) ও মোঃ হেদায়েত শেখ।
আর ভিডিওটি যিনি করেছেন তিনি অভিযোগ করেছেন, ঘটনাটি হিন্দু তথা সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা।
খবরটি ছড়িয়েছে ভারতেও:
BangladeshDarpan.com এর প্রতিবেদন অবলম্বনে ইংরেজিতে "Bangladesh: Muslims destroy the fence of a 200-year-old Shiva temple".
শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করেছে www.opindia.com নামে ভারতীয় একটি সংবাদমাধ্যম।
এর বাইরেও বেশ কয়েকটি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। সেরকম কয়েকটি প্রতিবেদন দেখুন এখানে, এখানে ও এখানে।
ফ্যাক্ট চেক:
বুম বাংলাদেশ এই অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে চেষ্টা করেছে। এজন্য এ ঘটনায় ইতমোধ্য মূলধারার সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরগুলো থেকে তথ্য নেয়ার পাশাপাশি স্থানীয় পুলিশ, ভূমি অফিস, অভিযুক্ত এবং স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয়দের সাথে কথা বলেছে বুম।
গত ৯ জুলাই দৈনিক কালের কণ্ঠে "দখলকৃত জমি উচ্ছেদে গিয়ে ফেসবুকের গুজবে বিপাকে ভূমি অফিস" শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
কালের কণ্ঠকে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফাহমি মো. সায়েফ বলেন, "নাজিরপুর সদর ও মাটিভাঙ্গা ২ ইউনিয়নের বড় বুইচাকাঠী ও ২৫ বানিয়ারী মৌজার সংলগ্ন ওই জায়গায় ১৫ ফুট প্রশস্ত একটি খাল রয়েছে। গত কয়েকদিন আগে ওই খাল দখলের খবর আসে। পরে ভূমি অফিসের লোকজন পাঠিয়ে সেখানে ওই দখল উচ্ছেদের অভিযান চালানো হয়। মন্দিরের জমি বেদখল বা সেখানে বেড়া ভাঙার কোনো ঘটনা ঘটেনি।"
ফাহমি মো. সায়েফ বুম বাংলাদেশ'কে বলেছেন, গত ৬ জুলাই নাজিরপুর উপজেলা ভূমি অফিসের পক্ষ থেকে স্থানীয় দীঘিরজান বাজারসংলগ্ন একটি খাল দখলকারীদের উচ্ছেদের জন্য অভিযান পরিচালনা করা হয়। ভূমি অফিসের দায়িত্বরত তহশিলদার শেখ মোহাম্মাদ শাহজাহান কবিরের উপস্থিতিতে খাল উদ্ধার অভিযানে বেড়া উচ্ছেদ করা হয়। এসময় স্থানীয় কিছু লোকজন প্রশাসনকে সহায়তা করেন।
ভাইরাল হওয়া ভিডিওর ব্যাপারে সহকারী কমিশনারের কাছে জানতে চাওয়া হয়। ভিডিওতে নীল পোশাক পরা যে ব্যক্তিকে বাঁশের বেড়া ভাঙতে দেখা যাচ্ছে তিনি কি প্রশাসনের অভিযান পরিচালনাকারীদের কেউ কিনা- জানতে চাইলে ফাহমি মো. সায়েফ জানান, তার নাম হেদায়েত শেখ। তিনি নাজিরপুরের পাশের উপজেলা মঠবাড়িয়া ভূমি অফিসের 'অফিস সহায়ক' পদে কর্মরত আছেন।
হেদায়েত শেখের বাড়ি এই এলাকায় হওয়ায় তিনিও ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন এবং অন্যদের সাথে বেড়া উচ্ছেদে সহায়তা করেছেন বলে জানান সহকারী কমিশনার। "তবে এই বেড়া সরকারি জায়গায় অবৈধভাবে নির্মিত, মন্দিরের জায়গায় নয়", বলেন তিনি।
ফাহমি মো. সায়েফ আরও বলেন, ফেসবুকে মন্দির ভাঙার বা মন্দিরের জায়গা দখলের কথা বলে গুজব ছড়ানো হয়েছে। আসলে ওখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের কোনো স্থাপনায় হামলা বা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেনি। খালের জায়গা দখলদারদের হাত থেকে উদ্ধারের অংশ হিসেবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযান চালানো হয়েছে।
তিনি জানান, প্রশাসনের অভিযানকে যারা 'মন্দিরে হামলা এবং জায়গা দখল' বলে গুজব ছড়িয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা করেছেন তহশিলদার শেখ মোহাম্মদ শাহজাহান।
তহশিলদার শেখ শাহজাহানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, অভিযানের বিষয়ে যারা সামাজিক মাধ্যমে গুজব ছড়িয়েছে তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা তিনি করেছেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পুলিশের সাথে যোগাযোগের পরামর্শ দেন তিনি।
নাজিরপুর থানার নাজিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মুনিরুল ইসলাম মুনিরের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, গুজব ছড়ানোর অভিযোগে ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আমরা প্রাথমিক তদন্তের পর তাদেরকে গ্রেফতারের চেষ্টা চালাচ্ছি।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলায় ৬ জন আসামি হলেন, দীপু মজুমদার (২৫), নির্জন বিশ্বাস (৫০), শফিকুল ইসলাম (৪০), গৌতম হালদার, জাকারিয়া ইমতিয়াজ শুভ ও সঞ্জয় রায়।
এই তথ্য দিয়ে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মুনিরুল ইসলাম বলেন, এ মামলাটি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিতে পারবেন ওসি (তদন্ত) মো. জাকারিয়া হোসেন।
দ্বন্দ্ব জমি সংক্রান্ত, সাম্প্রদায়িক নয়:
জাকারিয়া হোসেন জানান, ৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে "আক্রমাণাত্মক মিথ্যা তথ্য ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি বিনষ্ট করে আইনশৃঙ্খলা অবনতি ঘটানোর চেষ্টা" করেছেন তারা। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে।
তিনি বলেন, ভূমি অফিস অনেক দিন ধরেই তাদের দখলকৃত জমি উদ্ধারে কাজ করছে। এর অংশ হিসেবে যাদের দোকান উচ্ছেদ করা হয়েছে তাদের মধ্যে মুসলমান ব্যক্তিও আছেন। এছাড়া গুজব ছড়ানোয় অভিযুক্তদের মধ্যেও শুধু হিন্দুরা নন, মুসলিমরাও রয়েছেন। উচ্ছেদ অভিযানের সাথে সাম্প্রদায়িক কোনো বিষয় জড়িত নয়। দ্বন্দ্ব সরকারি জমি দখল ও উদ্ধার নিয়ে। দখলকারীদের মধ্যে মুসলিম-অমুসলিম উভয়পক্ষই আছেন।
জাকারিয়া হোসেন আরও জানান, ফেসবুকের ভিডিওতে এবং কিছু অনলাইন পোর্টালে যেমন দাবি করা হয়েছে যে হিন্দুদের জমি দখল করা হয়েছে বা মন্দিরের বেড়া ভাঙচুর করা হয়েছে তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
ভিডিওতে যে বেড়া ভাঙা হয়েছে বলে দেখা যাচ্ছে সেটি মন্দিরের নয়। এ বিষয়ে ৯ জুলাই দৈনিক কালের কণ্ঠের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে--
"মঙ্গলবার (৭ জুলাই) বিকালে সরেজমিনে গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা ও দেখা গেছে, সেখানে থাকা শিব মন্দির ও তার জন্য দেয়া পূর্ব-পশ্চিমের বেড়া অক্ষত রয়েছে। উত্তর-দক্ষিণের যে অংশের বেড়া ভাঙা হয়েছে সেখানে রেকর্ডিও খাল ছিল। স্থানীয়রা সেই খাল দখল করতে বেড়া দেন। ভূমি অফিস সেই বেড়া ভেঙে ফেলেন।"
ফেসবুকে গুজব ছড়ানো হয়েছে: বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ
ঘটনার পরদিন বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের পিরোজপুর জেলা কমিটি 'হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ' এর নেতৃবৃন্দসহ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। এরপর ৮ জুলাই একটি সংবাদ সম্মেলন করে তাদের প্রাপ্ত তথ্য তুলে ধরে।
সংবাদ সম্মেলনে "লিখিত বক্তব্যে সংগঠনটির জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক গোপাল চন্দ্র বসু জানান, নাজিরপুর উপজেলার দীঘিরজান বাজারের কাছে জনৈক মনিন্দ্রনাথ মজুমদার এবং উপজেলা ভূমি অফিসের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে। গত সোমবার (৬ জুলাই) উপজেলা ভূমি অফিসের লোকজন সরকারি জমির উপর নির্মিত একটি বেড়া উচ্ছেদ করে। এ সময় এক যুবক ফেসবুকে মিথ্যা প্রচারণা চালায় যে, মন্দ্রিনাথের বাড়ির ২০০ বছরের পুরণো একটি শিব মন্দির দখল করে সেটি ভাংচুর করা হয়েছে। তবে সেখানে এ ধরণের কোন ঘটনা ঘটেনি বলে জানান গোপাল বসু।"
এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন পড়ুন ডিবিসি নিউজ এর ওয়েবসাইটে।
সংবাদ সম্মেলনে যে লিখিত বক্তব্য পাঠ করা হয়েছে সেটির কপি দেখুন--
উচ্ছেদ নোটিশ না দিয়ে অভিযান চালানো হয়েছে:
ফেসবুকে প্রচারিত ভিডিও ও অনলাইন পোর্টালের দেয়া তথ্যকে 'মিথ্যা' বললেও বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, খালের অবৈধ দখল উচ্ছেদের আগে ভূমি অফিসের পক্ষ থেকে কোনো নোটিশ দেয়া হয়নি সংশ্লিষ্টদেরকে। এছাড়া ওই জমি নিয়ে দখলদার মজুমদার পরিবারের দায়ের করা একটি মামলা দেওয়ানী আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। এমতাবস্থায় ভূমি অফিস কর্তৃক অভিযান পরিচালনা করা যদি বেআইনি হয়ে থাকে তাহলে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে পরিষদ।
উপসংহার:
একটি জমির ভোগদখলকে কেন্দ্র করে সরকারের ভূমি অফিস ও স্থানীয় কিছু দখলদারদের- যাদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের লোকজন রয়েছেন- মধ্যকার বিরোধ ও সরকারি অফিসের উচ্ছেদ অভিযানকে 'সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন' 'হিন্দুদের ওপর নির্যাতন' হিসেবে ভিডিওতে দাবি করা হয়েছে, যা সত্য নয়। এছাড়া বাংলাদেশ দর্পন নামক অনলাইন পোর্টালে দাবি করা হয়েছে 'মন্দিরের জমি দখল করা হয়েছে', যেটিকে স্থানীয় হিন্দু নেতৃবৃন্দ এবং প্রশাসন 'মিথ্যা' বলে অভিহিত করেছেন। আর ভারতীয় কিছু সংবাদমাধ্যমে ঘটনাটিকে 'হিন্দুদের ওপর মুসলিমদের হামলা' এবং 'ইসলামপন্থীদের দ্বারা মন্দিরের জমি দখল' বলে যেসব তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে সেগুলো অসত্য।