রাশিয়ায় করোনা ভাইরাস প্রতিরোধী 'বিশ্বের প্রথম ভ্যাকসিনের সফল ট্রায়াল সম্পন্ন হয়েছে'- এরকম দাবি সম্বলিত একটি খবর বাংলাদেশি বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এরকম কয়েকটি প্রতিবেদন দেখুন এখানে, এখানে, ও এখানে।
এছাড়া ভারতীয় মূলধারার সংবাদমাধ্যমেও একই খবর এসেছে।
প্রায় সকল মাধ্যমেই খবরের সূত্র হিসেবে রাশিয়ার রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম 'স্পুটনিক নিউজ' এর এই প্রতিবেদনটিকে সূত্র হিসেবে উল্লেখ করেছে।
স্পুটনিকের প্রতিবেদনের স্ক্রিনশট দেখুন--
স্পুটনিকের প্রতিবেদনে দুটি দাবি করা হয়েছে-
১. রাশিয়ার সেচেনভ বিশ্ববিদ্যালয় করোনা ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সফলভাবে সম্পন্ন করেছে।
২. এটিই বিশ্বে প্রথম কোনও করোনা ভ্যাকসিনের ট্রায়াল সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার ঘটনা।
ভারত এবং বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে এই দাবিগুলোই প্রতিফলিত হয়েছে।
স্পুটনিকের প্রতিবেদনে অসামঞ্জস্য:
স্পুটনিক নিউজ শিরোনাম করেছে "Russia's Sechenov University Successfully Completes Trials of World's 1st COVID-19 Vaccine".
অর্থাৎ, "বিশ্বের প্রথম কভিড-১৯ এর ভ্যাকসিনের সফল পরীক্ষা শেষ করেছে রাশিয়ার শেচেনভ বিশ্ববিদ্যালয়"।
শিরোনামে স্পষ্ট করা হয়নি যে, এই পরীক্ষাটি কোন পর্যায়ের পরীক্ষা। একটি ভ্যাকসিন তৈরির যাত্রায় সেল কালচার টেস্ট, এনিমাল ট্রায়াল এবং তিনটি ধাপের হিউম্যান ট্রায়াল বা পরীক্ষা সম্পন্ন করতে হয়।
বর্তমানে বিশ্বে বেশ কয়েকটি দেশে দেড় শতাধিক সম্ভাব্য করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা ও ট্রায়াল চলছে। এর মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২টি ভ্যাকসিন তৃতীয় ধাপের হিউম্যান ট্রায়ালে (Phase III) আছে।
এগুলো হচ্ছে চীনের Sinovac এবং যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির AstraZeneca ভ্যাকসিন।
অর্থাৎ, Sinovac ও AstraZeneca এখন পর্যন্ত কভিডের ভ্যাকসিন হিসেবে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা সম্ভাবনাময় ভ্যাকসিন।
কোনো ভ্যাকসিনকে এখন পর্যন্ত "বিশ্বের প্রথম কভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন" বলতে হলে এই দুটির মধ্যে যেটি বেশি অগ্রসর সেটিকে বলা যেতে পারে। আর যদি অন্য কোনো ভ্যাকসিনকে এই উপাধি দিতে হয় তাহলে সেটিকে এই দুটির চেয়েও এগিয়ে থাকবে হবে পরীক্ষা নিরীক্ষা বা উৎপাদন প্রক্রিয়ায়।
Sinovac ও AstraZeneca এর তৃতীয় ধাপের হিউম্যান ট্রায়াল চলছে। অন্য কোনো ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেটকে এই দুটির চেয়ে এগিয়ে যেতে হলে তাদের আগে তৃতীয় ধাপের হিউম্যান ট্রায়াল শেষ করতে হবে।
রাশিয়ান ভ্যাকসিনটি হিউম্যান ট্রায়ালের প্রথম ধাপে আছে:
শিরোনামে এবং ইন্ট্রোতে স্পুটনিক নিউজ রাশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেটকে "World's 1st COVID-19 Vaccine" বললেও প্রতিবেদনের ভেতরে পরোক্ষ ইঙ্গিত রয়েছে (সরাসরি বলা হয়নি) যে, এটি মাত্রা প্রথম ধাপের হিউম্যান ট্রায়াল শেষ করেছে।
যেমন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে--
"According to Alexander Lukashev, the director of the Institute of Medical Parasitology, Tropical, and Vector-Borne Diseases at Sechenov University, the objective of this stage of the study was to show the vaccine's safety on humans, which was successfully done.
"The safety of the vaccine has been confirmed. It corresponds to the safety of those vaccines that are currently on the market", Lukashev told Sputnik."
অর্থাৎ, গবেষক জানাচ্ছেন তারা চলমান ধাপে যাচাই করে দেখতে চেয়েছেন যে, মানুষের ওপর ভ্যাকসিনটি নিরাপদ কিনা।
কোনো ভ্যাকসিন তৈরির যাত্রায় প্রথম ধাপের যে হিউম্যান ট্রায়াল করা হয় তার উদ্দেশ্য হচ্ছে ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেটটি মানুষের শরীরে নিরাপদ কিনা তা যাচাই করে দেখা। (প্রথম ধাপ হিউম্যান ট্রায়ালের উদ্দেশ্য ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে।
এছাড়া রাশিয়ান রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা তাস এর এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে যেসব তথ্য রয়েছে তাতেও স্পষ্ট হয় এটি হিউম্যান ট্রায়ালের প্রথম ধাপ শেষ করেছে।
"Russian university says clinical trials of COVID-19 vaccine completed" শিরোনামের প্রতিবেদনে তাস জানিয়েছে এই ট্রায়ালটি ওই ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেট নিয়ে গবেষণার "first stage"; যা শুরু হয়েছে মাত্র এক মাস আগে (জুনের ১৮ তারিখ) এবং দুই ধাপে মোট ৩৮ জন স্বেচ্ছাসেবীর ওপর ভ্যাকসিনটি প্রয়োগ করা হয়েছে।
ভ্যাকসিন গ্রহণকারী স্বেচ্ছাসেবীদের সংখ্যাও প্রথম ধাপের হিউম্যান ট্রায়ালের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এছাড়া মাত্র এক মাসের মধ্যে কোনো ভ্যাকসিনের তিনটি ধাপের হিউম্যান ট্রায়াল সম্পন্ন হওয়ার সুযোগ নেই। আর তিন ধাপের হিউম্যান ট্রায়ালের ফলাফল ছাড়া কোনো ভ্যাকসিনকে 'চূড়ান্তভাবে গ্রহণযোগ্য' হিসেবে বিবেচনা করা হয় না।
গবেষণাকারী শেচেনভ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে এই ভ্যাকসিনের ট্রায়ালকে স্পুটনিক নিউজের মতো করে "Trials of World's 1st COVID-19 Vaccine" বলে দাবি করা হয়নি।
শেচেনভ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে ভ্যাকসিনটি মানবদেহে প্রয়োগের পর করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে এটির কার্যকারিতা নিয়ে কিছু বলা হয়নি বরং ভ্যাকসিন প্রয়োগে উক্ত স্বেচ্ছাসেবীরা মাথাব্যথা ও জ্বর ছাড়া অন্য কোন তীব্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হননি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া এখনো তাদেরকে ২৮ দিন আইসোলেশনে রাখা হবে এবং পরবর্তীতে আরো ৬ মাস পর্যবেক্ষনে রাখা হবে বলেও জানানো হয়েছে।
উপসংহার:
যেহেতু রাশিয়ান শেচনেভ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাকসিনটি এখনও হিউম্যান ট্রায়ালের প্রথম ধাপে রয়েছে। অন্যদিকে চীন এবং যুক্তরাজ্যের দুটি ভ্যাকসিন বর্তমানে তৃতীয় ধাপের হিউম্যান ট্রায়াল পার করছে। এবং আরও বেশ কিছু ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেট দ্বিতীয় ধাপের হিউম্যান ট্রায়ালে রয়েছে। ফলে কোনোভাবেই রাশিয়ান ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেটকে "বিশ্বের প্রথম করোনা ভ্যাকসিন" বলার সুযোগ নেই। আবার এটাও বলার সুযোগ নেই যে, "বিশ্বের প্রথম দেশ হিসাবে করোনা টিকার হিউম্যান ট্রায়াল শেষ করল রাশিয়া"। কারণ রাশিয়ার আগেই অন্যান্য দেশে একাধিক ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেট আরও অগ্রসর (Phase II) ট্রায়াল সফলভাবে শেষ করেছে।