বাংলাদেশের কুমিল্লায় কুরআন অবমাননার অভিযোগকে কেন্দ্র করে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়া বিচ্ছিন্ন সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রভাব পড়ে ভারতের ত্রিপুরা সহ বিভিন্ন অংশে। গত ১৩ অক্টোবর শুরু হওয়া ওই ঘটনায় বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিন্দুদের বাড়িঘর, পূজামণ্ডপ ও মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটে প্রায় সপ্তাহব্যাপী। বাংলাদেশে গতমাসে ঘটে যাওয়া বিচ্ছিন্ন সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা নিয়ে বুম বাংলাদেশের আদ্যপান্ত একটি প্রতিবেদন পড়ুন, "কুরআন অবমাননার অভিযোগ: পূজামণ্ডপে হামলা ও বিক্ষোভ-সহিংসতার ৩ দিন"
এর পরপরই ভারতের ত্রিপুরা সহ বিভিন্ন অংশে সেদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় মুসলিমদের বাড়িঘর ও ধর্মীয়স্থান মসজিদে হামলার খবর পাওয়া যায়। এ ঘটনায় ভারত সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কিভাবে খবর প্রকাশিত হয়েছে এক নজরে দেখে নেয়া যাক (পাঠক চাইলে শিরোনামে ক্লিক করে পুরো প্রতিবেদনটিও পড়ে দেখতে পারেন)। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক গণমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টে গত ২৭ অক্টোবর প্রকাশিত খবরের শিরোনাম, "Religious violence flares up in India and Bangladesh"। একইদিনে ফার্স্ট পোস্টে প্রকাশিত খবর, "Tripura mosques get police protection after vandalism in retaliation to Bangladesh violence"। পরদিন ২৮ অক্টোবর প্রকাশিত ব্রিটেন ভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি'র খবরের শিরোনাম, "Tripura: Anti-Muslim violence flares up in Indian state"। ভারতের স্বাধীন গণমাধ্যম scroll.in এ গত ৩ নভেম্বর প্রকাশিত খবরের শিরোনাম, "Tripura anti-Muslim riots demonstrate how Indian and Bangladeshi extremists feed off each other"। আর ৫ নভেম্বর প্রকাশিত খবরে কাতার ভিত্তিক গণমাধ্যম আল-জাজিরা বলছে, "Muslims in India's Tripura remain in fear after mosques targeted"। এদিকে, গত ১৬ নভেম্বর মাদ্রাজ কুরিয়ার পত্রিকায় খবরের স্ক্রিনশট দেখুন--
মাদ্রাজ কুরিয়ারের প্রতিবেদনটি পড়ুন এখানে। এছাড়া, ত্রিপুরায় মুসলিম বিরোধী সহিংসতা, উত্তেজনা এবং এর প্রতিবাদ নিয়ে বাংলাদেশি ও বাংলা ভাষার কয়েকটি গণমাধ্যমের খবর দেখুন--
ঢাকা ট্রিবিউন: ভারতে মসজিদে হামলা, জনসম্মুখে নামাজ পড়ায় বাধা।
দৈনিক ইনকিলাব: নীরব মিডিয়া, ভারতের ত্রিপুরার ১৬ মসজিদে ভাঙচুর, ৩টিতে আগুন, শ্লীলতাহানি।
বিবিসি বাংলা: ভারতের ত্রিপুরায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ওপর রিপোর্ট করাকে কেন্দ্র দুই সাংবাদিক অভিযুক্ত।
আজকের এই নিবন্ধে বুম বাংলাদেশ খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছে, ত্রিপুরা সহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সামাজিক মাধ্যমে কী ধরণের ভুয়া তথ্য, ছবি এবং ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছিল। যেসব ভুয়া খবর বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে আরো উস্কে দিতে পারত, ভার্চুয়াল মাধ্যমকে ছাড়িয়ে যার অনাকাঙ্খিত 'রিয়াল লাইফ কন্সিকোয়েন্স' থাকতে পারত। অর্থাৎ যেসব ভুয়া খবরকে চিহ্নিত করে বাংলাদেশের সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহারকারীদের জন্য নিরাপদ রাখার চেষ্টা করেছে বুম বাংলাদেশ, এমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু ফ্যাক্ট চেক প্রতিবেদনকে তুলে ধরা হলো--
এক.
গত ২৩ অক্টোবর হাজার হাজার মানুষের একটি সমাবেশের ছবি আপলোড দিয়ে দাবি করা হয়, "জয় শ্রী-রাম; আসাম বাংলাদেশ সীমান্তে তীব্র উত্তেজনা! বাংলাদেশে চলমান হিন্দু গণত্যার প্রচেষ্টার জেরে সমগ্র বারাক থেকে শুরু করে গৌহাটি অবদি আসামের সর্বস্তরের হিন্দুরা জেগে ওঠেছে! ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত ও সীমান্তবর্তী মুসলিম বহুল এলাকাগুলোতে রেড এলার্ট! জয় শ্রী রাম, জাগো হিন্দু"। বুম বাংলাদেশ ছবিটি নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখে দাবিটি ভিত্তিহীন। ছবিটি মূলত ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে ভারতে নির্বাচনের আগে দক্ষিন বেঙ্গালুরুর দ্য প্যালেস গ্রাউন্ডে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর একটি পথসভার। এ নিয়ে বুম বাংলাদেশের ফ্যাক্ট চেক প্রতিবেদনের স্ক্রিনশট দেখুন--
দুই.
আংশিক পুড়ে যাওয়া মুসলিমদের কিছু ধর্মীয় গ্রন্থ নিয়ে দুই যুবক দাড়িয়ে আছেন, এমন একটি ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে দাবি করা হয়, এটি ভারতের ত্রিপুরায় মুসলমানদের উপর হামলার ছবি। ত্রিপুরার মুসলমানদের জন্য দোয়াও চাওয়া হয় ওই পোস্টে। ছবিটি দেখুন এখানে--
পরে বুম বাংলাদেশের অনুসন্ধানে ওঠে আসে ছবিটির সাথে কোন সাম্প্রদায়িক হামলার সম্পর্ক নেই। ছবিটি মূলত গত জুন মাসে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির কাঞ্চন কুঞ্জ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নি দুর্ঘটনার ছবি। এ নিয়ে ফ্যাক্ট চেক প্রতিবেদনটি পড়ুন এখানে।
তিন.
ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট করে দাবি করা হয়, ত্রিপুরায় সাম্প্রতিক মুসলিম-বিরোধী উত্তেজনার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে মুসলমানরা। ভারতের ত্রিপুরার চুরাইবাড়ি নামক এলাকায় মুসলিমদের বিশাল বিক্ষোভ মিছিলের ভিডিও এটি। পরে ভিডিওটি নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে বুম বাংলাদেশ নিশ্চিত হয় যে, এটি ত্রিপুরার কোন ভিডিও নয় এবং মুসলমানদের বিক্ষোভেরও ভিডিও নয়। এটি মূলত উত্তরপ্রদেশের বুদাউন শহরের সুফি হযরত সালিম উল কাদরীর জানাজার একটি ভিডিও। এ নিয়ে বুম বাংলাদেশের ফ্যাক্ট চেক প্রতিবেদনের শিরোনাম, "ভিডিওটি ভারতের ত্রিপুরার নয় বরং উত্তরপ্রদেশের এক সুফির জানাজার"
চার.
হিন্দু বর-কনে মুসলিম এক বয়স্ক দম্পতিকে প্রণাম করছেন এমন একটি ছবি গত ২ নভেম্বর ফেসবুকে পোস্ট করে দাবি করা হয়, ভারতের পশ্চিম বঙ্গে এক মুসলিম দম্পতি নিজ ধর্মের "বহু বিবাহ ও তিন তালাক" থেকে নিজ কন্যাকে বাঁচাতে সেখানকার হিন্দু ছেলের সাথে বিয়ে দিচ্ছেন। পরে বুম বাংলাদেশ অনুসন্ধান চালিয়ে দেখে দাবিটি ভিত্তিহীন। বরং ভারতের কেরালায় এক মুসলিম দম্পতির পালিত হিন্দু কন্যাকে ২০২০ সাথে সেখানকার কাসারাগড়ের এক মন্দিরে হিন্দু রীতিতেই বিয়ে দেয়া হয়। ওই ছবি সহ ঘটনাটি তখন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। এ নিয়ে ফ্যাক্ট চেক প্রতিবেদনটি পড়ুন, "ভারতে মুসলিম দম্পতির পালিত হিন্দু কন্যার বিয়ের ছবি ভুয়া দাবিতে ভাইরাল'
পাঁচ.
গত ৩০ অক্টোবর একাধিক সহিংস ও অগ্নিকাণ্ডের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে দাবি করা হয়, এগুলো ভারতের ত্রিপুরায় মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর হামলা ও মসজিদে আগুন দেয়ার ঘটনার ছবি। পোস্টের স্ক্রিনশট দেখুন--
বুম বাংলাদেশ যাচাই করে দেখে ছবিগুলো পুরোনো ও ভিন্ন ভিন্ন ঘটনার, যার সাথে সাম্প্রদায়িক হামলার কোন সর্ম্পক নেই। এ নিয়ে বুম বাংলাদেশের ফ্যাক্ট চেক প্রতিবেদনের শিরোনাম, "ভারতের ত্রিপুরার সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার খবরের সাথে পুরোনো ছবি প্রচার"
ছয়.
গত ৩ নভেম্বর একটি ভিডিও পোস্ট করে দাবি করা হয়, ভিডিওটি ত্রিপুরায় মুসলমানদের উপর নির্যাতনের প্রতিবাদে কেরালায় মুসলমানদের বিশাল বিক্ষোভ মিছিলের। পরে বুম বাংলাদেশ ভিডিওটি যাচাই করে দেখে ভিডিওটি সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে নয় বরং এটি ২০২০ সালে কেরালায় নাগরিক সংশোধন আইন-সিএএ এর বিরুদ্ধে মুসলিমদের বিক্ষোভ মিছিলের। এ নিয়ে বিস্তারিত ফ্যাক্ট চেক প্রতিবেদন পড়ুন এখানে।
সাত.
একটি মসজিদ সদৃশ ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ছবি ও আরেকটি বিক্ষোভ-সহিংসতার ছবি পোস্ট করে ফেসবুকে দাবি করা হয়, ছবি দুটি ত্রিপুরায় সাম্প্রতিক মুসলিম বিরোধী সহিংসতার। বুম বাংলাদেশ অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে যে, একটি ছবি ভারতের কাশ্মীরের শ্রীনগরে একটি মাজারে ২০১২ সালে অগ্নিকাণ্ডের ছবি এবং অপরটি ভারতের আসামে বহুল আলোচিত সামালোচিত নাগরিক সংশোধন আইন-সিএএ বিরোধী আন্দোলনের ছবি। এ নিয়ে ফ্যাক্ট চেক প্রতিবেদনের স্ক্রিনশট দেখুন--
বিস্তারিত প্রতিবেদনটি পড়ুন এখানে।
আট.
একটি অগ্নিকাণ্ডের ও আরেকটি সহিংস বিক্ষোভের ছবি পোস্ট করে দাবি করা হয়, ছবি দুটি ভারতের ত্রিপুরায় সাম্প্রদায়িক হামলার ছবি। কিন্তু বুম বাংলাদেশ অনুসন্ধান চালিয়ে দেখে ছবি দুটি ত্রিপুরার নয় বরং একটি ছবি ভারতের নয়াদিল্লির রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডের ও অপরটি আসামে নাগরিক সংশোধন আইন-সিএএ বিরোধী বিক্ষোভের। এ নিয়ে গত ২১ নভেম্বর প্রকাশিত বুম বাংলাদেশের ফ্যাক্ট চেক প্রতিবেদনটি পড়ুন এখানে।
এদিকে, বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও উত্তেজনা নিয়ে বাংলাদেশের সামাজিক মাধ্যমেও ভুয়া খবর ছড়িয়েছে। বাংলাদেশে ঘটা সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিয়ে কী ধরণের ভুয়া খবর ছড়িয়েছে এ নিয়ে গত ২৫ নভেম্বর প্রকাশিত বুম বাংলাদেশের একটি ফ্যাক্ট ফাইল প্রতিবেদন পড়ুন, "সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক সহিংসতা: ভুয়া তথ্য প্রবাহ"।