ঘুম থেকে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালে বা হাঁটলেই হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হয়না
বুম বাংলাদেশ দেখেছে, হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে দাঁড়ালে বা হাঁটলে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হতে পারে এমন দাবিটি ভিত্তিহীন।
সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকের একাধিক অ্যাকাউন্ট, পেজ এবং গ্রুপে পোস্ট করে বলা হচ্ছে, ঘুম থেকে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালে বা হাঁটলে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হতে পারে। এমনকি এর কারণে তিনি মারাও যেতে পারেন। এরকম কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে ও এখানে।
গত ১৯ মার্চ 'Debasree Roy' নামের ফেসবুক পেজ থেকে একটি দীর্ঘ পোস্ট করে লেখা হয়, "যারা রাত্রে বা ভোরে বাথরুমে যাবার জন্য ঘুম থেকে ওঠেন তাদের জন্য ডাক্তারদের একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ.......আমরা প্রায়ই শুনতে পাই একেবারে সুস্থ একজন মানুষ রাতের বেলা হঠাৎ মারা গেছেন। এটার একটা কারন হচ্ছে রাতে বাথরুমে যাবার জন্য ঘুম ভেঙ্গে গেলে আমরা তাড়াহুড়ো করে হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে পড়ি, যা ব্রেইনে রক্তের প্রবাহ হঠাত কমিয়ে দেয়। এটা আপনার ইসিজি প্যাটার্নও বদলে দেয়। হুট করে ঘুম থেকে উঠেই দাঁড়িয়ে পড়ার দরুন আপনার ব্রেইনে সঠিক ভাবে অক্সিজেন পৌছাতে পারেনা, যার ফলে হতে পারে হার্ট এ্যাটাকের মত ঘটনাও......."। পুরো ফেসবুক পোস্টটির স্ক্রিনশট দেখুন--
ফ্যাক্ট চেক:
বুম বাংলাদেশ যাচাই করে দেখেছে, আলোচ্য দাবিটি সঠিক নয়। একজন স্বাভাবিক মানুষের ক্ষেত্রে হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে দাঁড়ালে বা হাঁটলে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হতে পারে এমনকি এর কারণে তিনি মারাও যেতে পারেন এমন তথ্যের কোনো ভিত্তি পাওয়া যায়নি।
আলোচ্য পোস্টটির শেষ দিকে লক্ষ্য করা যায় পোস্টটিতে 'সংগৃহীত (Collected)' উল্লেখ করা হয়েছে। পরবর্তীতে এই দাবিটি কোথা থেকে সংগৃহীত করা হলো বা কিসের উপর ভিত্তি করে অনলাইনে প্রচারিত হলো সে বিষয়ে সার্চ করে দেখা যায়, একই রকম দাবি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সুপাইরভাইজার (আন্ডারগ্রাজুয়েট) ডাক্তার তাসনিম জারা'র নিজের অভিজ্ঞতা ও পরামর্শ হিসেবে (১, ২, ৩) ফেসবুকে তার নামে কপি পোস্ট প্রচার করা হয়েছিল। এরকম একটি পোস্টের স্ক্রিনশট দেখুন--
এই পোস্টে হার্ট অ্যাটাক এর পরিবর্তে স্ট্রোকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও এই একই দাবিটি আরো কয়েকজন চিকিৎসকের নামেও প্রচার হতে দেখা গেছে। বাংলা ভাষায় এ বিষয়ে সমজাতীয় দাবি সম্বলিত প্রথম দিককার পাবলিক পোস্ট পাওয়া যায় ২০১৭ সালের ১০ এপ্রিল। পোস্টটিতে উল্লেখ করা হয় যে সেটি একটি বিদেশী পোস্ট থেকে অনুবাদ করা হয়েছে। সার্চ করে আলোচ্য পোস্টের ইংরেজি মূল সংস্করণের একটি নমুনা পোস্ট খুঁজে পাওয়া যায়। ইন্টারনেটে প্রচারিত এই দাবি সম্বলিত সম্ভাব্য প্রথম দিককার পাবলিক পোস্টটি (ইংরেজি) পাওয়া যায় ২০১৬ সালের ১৮ জুন।
অর্থাৎ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ইংরেজি ভাষায় দাবিটি প্রচারিত হবার পর এর একটি সংস্করণ অনূদিত হয়ে বাংলা ভাষায় ২০১৭ সাল থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হওয়া শুরু হয়। বাংলাদেশেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দাবিটি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংস্করণে (সংযোজন-বিয়োজনে) প্রচারিত হয়।
এদিকে, ড. তাসনিম জারা'র ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে সার্চ করে ২০২২ সালের ২১ এপ্রিল প্রকাশিত এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও পাওয়া যায়। ভিডিওতে তিনি বলেন, তিনি আলোচ্য এজাতীয় কোনো পরামর্শ দেননি এবং স্বাভাবিক ক্ষেত্রে এই দাবিটির বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই (সংক্ষেপিত)। ভিডিওটির স্ক্রিনশট দেখুন--
এছাড়াও কি-ওয়ার্ড সার্চ এর মাধ্যমে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব শেফিল্ড এর গবেষক ও চিকিৎসক মারুফুর রহমান অপু এর ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ২০২২ সালের ১৮ এপ্রিল এ সংক্রান্ত একটি ফেসবুক পোস্ট খুঁজে পাওয়া যায়। পোস্টে তিনি উল্লেখ করেন, ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে যাবার জন্য দ্রুত দাড়ালে স্ট্রোক হয় এর কোন প্রমাণ নেই (সংক্ষেপিত)। পোস্টটির স্ক্রিনশট দেখুন--
পাশাপাশি কি-ওয়ার্ড সার্চ এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান 'পলিটিফ্যাক্ট' -এ ২০১৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর "Sitting up too quickly in the middle of the night won’t cause your sudden death" শিরোনামে প্রকাশিত একটি ফ্যাক্ট-চেক প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন স্কুল অব মেডিসিনের পালমোনারি, ক্রিটিক্যাল কেয়ার এবং স্লিপ মেডিসিন এর সহযোগী অধ্যাপক ডাক্তার সিনা গারিব পলিটিফ্যক্টকে জানিয়েছেন, তিনি দাবিটির সত্যতার বিষয়ে কখনো কোনো প্রমাণ পাননি। তবে 'অর্থোস্ট্যাটিক হাইপোটেনশন' এর কারণে বিশেষ করে বয়স্কদের ক্ষেত্রে হঠাৎ শোয়া থেকে সোজা হয়ে দাঁড়ালে রক্তচাপ কমে যেতে পারে। মস্তিষ্কে নিম্ন রক্তচাপের কারণে মাথা ঘোরা হতে পারে তবে মৃত্যু নয়। (অনূদিত ও সংক্ষেপিত)।
এছাড়াও প্রতিবেদনটিতে আরো উল্লেখ করা হয়, ব্রিস্টল ইউরোলজিক্যাল ইনস্টিটিউটের ইউরোলজিক্যাল সার্জন এবং অধ্যাপক ডা. হাশিম হাশিম পলিটিফ্যক্টকে জানিয়েছেন, 'পোস্টুরাল হাইপোটেনশন' রোগে আক্রান্তদের ক্ষেত্রে কেউ যদি দ্রুত বিছানা থেকে উঠে বাথরুমে যায়, তবে 'পোস্টুরাল হাইপোটেনশন' এর কারণে তাদের রক্তচাপ কমে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন। সেক্ষেত্রে কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়ার কারণে যদি মাথা শক্ত কিছুতে আঘাত পায় সে কারণে মারা যেতে পারেন। কিন্তু অন্য কিছুতে আঘাত না পেয়ে, শুধুমাত্র দ্রুত বিছানা থেকে উঠে যাওয়ায় মৃত্যু হয় এমন কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি (অনূদিত ও সংক্ষেপিত)। পলিটিফ্যাক্টের প্রতিবেদনটির স্ক্রিনশট দেখুন--
অর্থাৎ পলিটিফ্যাক্ট এর তথ্য অনুযায়ী, একজন স্বাভাবিক মানুষের ক্ষেত্রে হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে দাঁড়ালে বা হাঁটলে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হতে পারে, এমনকি এ কারণে তিনি মারা যেতে পারেন এমন দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়না। তবে 'পোস্টুরাল হাইপোটেনশন' বা 'অর্থোস্ট্যাটিক হাইপোটেনশন' এর রোগীদের ক্ষেত্রে কেউ যদি দ্রুত বিছানা থেকে উঠে বাথরুমে যায়, অনেকক্ষেত্রে তাদের রক্তচাপ কমে যেতে পারে এবং এর ফলে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন।
উল্লেখ্য এএফপি এবং এএপিও ঘুম থেকে উঠে দাঁড়ালে বা হাঁটলে মৃত্যুও হতে পারে এমন দাবি সত্য নয় জানিয়ে ফ্যাক্ট-চেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
সুতরাং সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে ঘুম থেকে উঠে দাঁড়ালে বা হাঁটলে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হতে পারে, এমনকি হতে পারে মৃত্যুও মর্মে যে তথ্য প্রচার করা হচ্ছে; তা সঠিক নয়।