করোনাভাইরাস মোকাবিলা: বাংলাদেশে কি সুরক্ষা সরঞ্জামের ঘাটতি নেই?
প্রধানমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী দাবি করেছেন করোনা মোকাবেলায় দেশে স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য সুরক্ষা সরঞ্জামের ঘাটতি নেই।
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে সারা পৃথিবীব্যাপী স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সরঞ্জামের সংকট চলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে এমন তথ্য একাধিকবার জানানো হয়েছে গত দুই সপ্তাহের মধ্যে।
সর্বশেষ গত ৬ এপ্রিল সংস্থাটি বিবৃতি দিয়ে সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানায় যে, সুরক্ষা সরঞ্জামের ব্যবহারের ক্ষেত্রে যেন এটির ঘাটতির কথা মাথায় রাখা হয়।
এরইমধ্যে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে দেয়া তার ভাষণে জানান, দেশে সুরক্ষা সরঞ্জামের কোনো ঘাটতি নেই। প্রধানমন্ত্রীর পূর্ণাঙ্গ ভাষণ দেখুন এই লিংকে।
এদিকে ১৭ এপ্রিল স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক একই দাবি করেছেন। সুরক্ষা সরঞ্জামের বিষয়ে তিনি বলেছেন, ''পারসোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) সংকট নেই।'' (সূত্র: ডেইলি স্টার)।
ফ্যাক্ট চেক:
সরকারের শীর্ষস্থানীয় দুই কর্তা ব্যক্তি সুরক্ষা সরঞ্জামের ঘাটতি বা সংকট নেই বললে দাবি করলেও গণমাধ্যমের অনেকগুলো রিপোর্ট ভিন্ন কথা বলছে। এখানে তেমন কিছু রিপোর্ট তুলে ধরা হলো--
স্বাস্থ্যমন্ত্রী যেদিন (১৭ এপ্রিল) জানালেন ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম বা পিপিই এর কোনো সংকট নেই, সেদিনই প্রকাশিত যমুনা টেলিভিশনের একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম হচ্ছে, "দেশের ৯০ হাজার চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য নেই পর্যাপ্ত সুরক্ষা সরঞ্জাম"। প্রতিবেদনটি পড়ুন এই লিংকে।
যমুনা টেলিভিশনের প্রতিবেদনের প্রথম দুটি প্যারায় বলা হয়েছে--
"ঝুঁকি নিয়েই করোনার চিকিৎসা দিচ্ছেন, চিকিৎসক'সহ স্বাস্থ্যকর্মীরা। এখনও দেশের ৯০ হাজার নিবন্ধিত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য সরবরাহ করা যায়নি পর্যাপ্ত সুরক্ষা সরঞ্জাম। এরইমধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন শতাধিক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী।
কর্মরত চিকিৎসক ও নার্সদের অনেকেই বলছেন, সরবরাহ আগের চেয়ে বাড়লেও পর্যাপ্ত নয়। বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন-বিএমএও বলছে সংকটের কথা। অবশ্য মহাসচিব জানিয়েছেন, ঝুঁকি কমানো ও সংকট সমাধানের চেষ্টা করছে সরকার।"
একই প্রতিবেদনের সচিত্র রূপ দেখুন এই লিংকে: https://youtu.be/hMiXY5kM6VM
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেদিন (১৩ এপ্রিল) জাতির উদ্দেশে ভাষণে জানান, ''সুরক্ষা সরঞ্জামের কোনো ঘাটতি নেই"- ওইদিন এনটিভি অনলাইনের একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, "'সুরক্ষা সরঞ্জাম ছাড়া' করোনায় সেবাদানে না পাঠাতে নার্সদের অনুরোধ"।
বিভিন্ন হাসপাতালে কর্মরত বেশ কয়েকজন নার্সের সঙ্গে কথা বলে বার্তা সংস্থা ইউএনবির তৈরি করা প্রতিবেদনটির প্রথম প্যারাটি হচ্ছে--
"বাংলাদেশের বেশিরভাগ হাসপাতালে নার্সদের জন্য পর্যাপ্ত ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) সরবরাহের ব্যবস্থা নেই, যা মারাত্মক ছোঁয়াচে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের সেবাদানের সময় অত্যন্ত প্রয়োজন। এর ফলে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের সেবাদানের সময় আতঙ্কে ভুগছেন নার্সরা।"
১৪ এপ্রিল করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের জন্য চিকিৎসারত নার্সদের সাথে কথা বলে একই রকম প্রতিবেদন প্রকাশ করে ইংরেজি পত্রিকা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল, "Nurses exhausted by shortage of supplies"।
বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এর প্রতিবেদনের প্রথম দুটি প্যারায় করোনা রোগীদের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের চিত্র বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে--
"Nurses at the Kuwait Bangladesh Friendship Government Hospital have become both physically and mentally exhausted due to the shortage of food, personal protective equipment and manpower.
The medical personnel of the hospital had to stage a demonstration for three meals a day. Meanwhile, the government on April 12 appointed Dr Sarwar Ul Alam as the director of the hospital."
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের তিন দিন পর এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সর্বশেষ বক্তব্যের একদিন আগে ১৬ এপ্রিল বিবিসি বাংলার একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম, "করোনাভাইরাস: উত্তরার কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে নার্সদের পূর্ণ পিপিই না দেয়ার অভিযোগ"।
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনের প্রথম প্যারাটি হচ্ছে--
"ঢাকায় কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে শুরু থেকেই সেবার সাথে জড়িত রয়েছেন এমন একজন নার্স বলছেন, যে সুরক্ষা পোশাকটি খুব দরকারি সেই পিপিই তাদের পুরোটা দেয়া হচ্ছে না। শুধু গাউন দেয়া হচ্ছে এবং খুব দরকারি এন-৯৫ মাস্কও দেয়া হচ্ছে না।"
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের একদিন আগে ১২ এপ্রিল কালের কণ্ঠের একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিলো, "মির্জাপুরে পিপিই সংকট, বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহবান"।
প্রতিবেদনে প্রথম দুটি প্যারা তুলে ধরা হলো--
"টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে করোনাভাইরাস সুরক্ষা সরঞ্জাম পিপিই সংকট দেখা দিয়েছে। এজন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা করোনা উপসর্গ থাকা রোগীদের নমুনা সংগ্রহ করতে হিমশিম খাচ্ছেন। তারা পলিথিন ব্যবহার করে ঝুঁকি নিয়ে নমুনা সংগ্রহ করছেন বলে জানা গেছে। স্বাস্থ্যকর্মীরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স মির্জাপুর ফেসবুক পেজে এই তথ্য পোস্ট করেছেন।
উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মাকসুদা খানম মির্জাপুরের বিত্তবানদের পিপিই দিয়ে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছেন।"
এর আগের দিন ১১ এপ্রিল প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম, "বরিশাল বিভাগের স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে পিপিই নেই, ঝুঁকিতে স্বাস্থ্যকর্মীরা"।
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের প্রায় ৩ সপ্তাহ আগে ২৩ মার্চ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের স্বীকার করেছিলেন স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা সরঞ্জামের ঘাটতি রয়েছে। তার বক্তব্যের ওপর বাংলাট্রিবিউনের প্রতিবেদনের শিরোনাম, "করোনা মোকাবিলার সরঞ্জামের ঘাটতি আছে: ওবায়দুল কাদের"।
ওবায়দুল কাদের এই বক্তব্য দেয়ার পর থেকে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের আগ পর্যন্ত করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য সুরক্ষা সরঞ্জামের ঘাটতি সংক্রান্ত গণমাধ্যমের আরও কয়েকটি রিপোর্ট এখানে তুলে ধরা হলো--
৯ এপ্রিল জাগোনিউজের শিরোনাম, "সুরক্ষা সরঞ্জাম ছাড়া করোনা যুদ্ধে নামলেন চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা"।
৭ এপ্রিল আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, Doctors and other healthcare workers say they do not have adequate personal protective equipment - and the health system cannot cope with the outbreak.
গত ১ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল, ২০২০ পর্যন্ত বাংলাদেশের ১২টি জাতীয় দৈনিক এবং অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, পর্যালোচনা এবং সমালোচনার ভিত্তিতে 'করোনাকালীন মানবাধিকার পরিস্থিতি' গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করেছেন বাংলাদেশের একটি গবেষক দল। ১৩ এপ্রিল তাদের প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, "স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য যথাসময়ে পারসোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্ট (পিপিই) সরবরাহ করা হয়নি"। (সূত্র: ডেইলি স্টার)।