বিভ্রান্তিকর তথ্যসহ সুত্রবিহীন ফিলিস্তিনি এক বালকের ঘটনা প্রচার
বুম বাংলাদেশ দেখেছে, কোন তথ্যসুত্র ছাড়া ফিলিস্তিনের ফরিদ আব্দুল আলী নামের একজনের 'অনুপ্রেরণামূলক গল্প' প্রচার করা হচ্ছে।
সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে ফিলিস্তিন বংশোদ্ভুত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফরিদ আব্দুল আলীর বাল্যকালের ঘটনা-সম্বলিত পোস্ট ভাইরাল হয়েছে। দেখুন এমন দুটি পোস্ট এখানে এবং এখানে।
গত ২০ ডিসেম্বর 'গান ও জীবন' নামের ফেসবুক পেজ থেকে ছবিসহ দীর্ঘ একটি পোস্ট দেয়া হয় যার শিরোনাম ছিল, ফিলিস্তিনের সেই মেধাবী বালক। সেই পোস্টটিতে 'ড. মুহাম্মদ খানী' নামক এক লোকের বরাতে 'ফরিদ আব্দুল আলী' নামের এক ফিলিস্তিনি শিশুর ঘটনা বর্ণনা করা হয়। সেখানে আরো বলা হয়, অর্থ সংকটে বড় হওয়া ফরিদ আব্দুল আলী আমেরিকায় ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়াশোনা করে বর্তমানে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তরুণ শিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন। উক্ত ব্যক্তির একটি ছবিও সেই পোস্টে যুক্ত করা হয়েছে। দেখুন সেই পোস্ট--
পোস্টটির আর্কাইভ ভার্সন পড়ুন এখানে।
ফ্যাক্ট চেক:
বুম বাংলাদেশ যাচাই করে দেখেছে, সেই পোস্টটিতে একাধিক বিভ্রান্তিকর তথ্য রয়েছে। প্রথমত, রিভার্স ইমেজ সার্চিং টুল ব্যবহার করে পোস্টের সাথে যুক্ত ছবিটি একাধিক ওয়েবসাইটে পাওয়া গেছে। 'dsef.org' নামক ওয়েবসাইটে একই ছবিটির সাথে নাম উল্লেখ করা হয়েছে কেবল 'আব্দুল আলি'। তবে সেখানে আরো কোনো তথ্যের উল্লেখ নেই। দেখুন--
দেখতে ক্লিক করুন এখানে।
এই একই ছবি আরো পাওয়া গেছে আরব আমিরাত বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক একটি ওয়েবসাইটে। সেই ওয়েবসাইটের উপদেষ্টামণ্ডলীর সাথে ফেসবুকে প্রচারিত ছবিটি দেখা যাচ্ছে। সেখানেও সেই ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা হয়েছে ড. আব্দুল আলি হিসেবে। সেখানে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, ব্যবসন কলেজ, আমেরিকা। দেখুন--
দেখতে ক্লিক করুন এখানে।
পরবর্তীতে আরো সার্চ করে ড. আব্দুল আলির আরেকটি ছবিসহ একটি লেখা পাওয়া যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসন কলেজের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে। ২০১৯ সালের মে মাসে প্রকাশিত সেই লেখায় উল্লেখ করা হয়, ব্যবসন কলেজের প্রতি তার অবদানের সম্মাননা স্বরূপ ড. আব্দুল আলিকে থমাস কেনেডি এওয়ার্ড (মরণোত্তর) পুরস্কারে ভূষিত করেছে ব্যবসন কলেজ কর্তৃপক্ষ। উক্ত অনুষ্ঠানে তার হয়ে পুরস্কারটি গ্রহণ করেন তার সহকর্মী অনিরুদ্ধ ধেবার। সেখানে আরো উল্লেখ করা হয়, ড. আলি ২০১৮ সালে ক্রিসমাসের দু দিন আগে মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু ফেসবুক পোস্টগুলোতে বলা হচ্ছে, তিনি বর্তমানেও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। ব্যবসন কলেজের ফেসবুক পেইজেও লেখাটি প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে। দেখুন--
দেখুন এখানে।
এছাড়া 'জার্নাল অব মাইক্রোমার্কেটিং'এর টুইটার আইডি থেকে মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল আলির মৃত্যুর জন্যে শোক প্রকাশ করা হয় ২০১৯ সালে। দেখুন-
অর্থাৎ তিনি এখনো তরুন অধ্যাপক হিসেবে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন তা সত্য নয়।
তাছাড়া ব্যবসন কলেজের ওয়েবসাইটে আমরা ড. আব্দুল আলির একাডেমিক সিভিও খুঁজে পায় বুম বাংলাদেশ। সেখানে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার বিষয়ে কিছুরই উল্লেখ নেই। বরং তিনি ব্যবসন কলেজের আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিরাকিউস এবং ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সাথে যুক্ত ছিলেন।
২০১৩ সালে 'হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ'তে লিখিত তার একটি যৌথ আর্টিকেল প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানেও তাঁকে ব্যবসন কলেজের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পড়ুন আর্টিকেলটি এখানে।
ড. আলির সিভিতে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি প্রথমে ভারতের খড়গপুরের আইআইটি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ভারতের আহমেদাবাদের আইআইএম থেকে এমবিএ করেছেন। তারপর মার্কেটিং বিভাগে পিএইচডি নিয়েছেন আমেরিকার পারডু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কিন্তু আলোচ্য ফেসবুক পোস্টে উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি আমেরিকায় ইঞ্জিনিয়ারিং এ ডিগ্রি নিয়েছেন যার কোনো উল্লেখ তাঁর সিভিতে নেই। দেখুন তার সিভিতে উল্লেখিত তার ডিগ্রির বিস্তারিত–
তাঁর সম্পুর্ন সিভিটি দেখুন এখানে।
ফেসবুক পোস্টগুলোতে আরো দাবি করা হচ্ছে তিনি ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত। কিন্তু সেরকম কিছুরই উল্লেখ তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোফাইল এবং সিভিতে পাওয়া যায়নি। ড. আব্দুল আলির জাতীয়তার বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে আমরা যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি তার ব্যবসন কলেজের সহকর্মী অনিরুদ্ধ ধেবার এর সাথে। তাঁর জবাবটি এলে সেটি আমরা যুক্ত করে দিব।
তাছাড়া নানাভাবে সার্চ করে ইন্টারনেটে "ফরিদ আব্দুল আলী' নামের কোনো শিশুর ফিলিস্তিন থেকে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হওয়ার ঘটনা কোনো বিশ্বাসযোগ্য সোর্সে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে এ সংক্রান্ত দুটি ভিডিও পাওয়া গেছে ইউটিউবে যা সম্প্রতি আপলোড করা হয়েছে। সেখানে ছবিসহ একই ঘটনা কোনো উৎস ছাড়া উল্লেখ করা হয়েছে। দেখুন সেই ভিডিও দুটি এখানে এবং এখানে।
অর্থাৎ একাধিক বিভ্রান্তিকর তথ্যসহ সুত্রবিহীন একজন ফিলিস্তিন বংশদ্ভুত ব্যক্তি 'ফরিদ আব্দুল আলী'র ঘটনা একাধিক ফেসবুক গ্রুপ এবং পেজ থেকে পোস্ট করা হচ্ছে।