কেরালায় অন্তঃসত্ত্বা হাতির মর্মান্তিক মৃত্যু: গুজব ও ধর্মান্ধতার ইন্ধন
বুমের অনুসন্ধানে দেখা গেছে কিছু সংবাদমাধ্যমের ভুল প্রতিবেদন ঘটনাটিকে ঘিরে গুজব ছড়ানোতে সহায়তা করেছে।
বুমের অনুসন্ধানে দেখা গেছে প্রাথমিকভাবে সংবাদমাধ্যমগুলোর ভুল প্রতিবেদন ও সামাজিক মাধ্যমে ক্ষোভের প্রকাশ করুণ এই ঘটনাটিকে ঘিরে গুজব ছড়ানোতে সহায়তা করেছে।
ভুল সংবাদ প্রতিবেদন ও সামাজিক মাধ্যমে পূর্বানুমানভিত্তিক মতামত প্রদানের কারণে কেরালার জঙ্গলে একটি অন্তঃসত্ত্বা হাতির করুণ মৃত্যু কম্যুনিস্ট পার্টি শাসিত ওই রাজ্য এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানোর সহায়ক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে।
বুম দেখতে পেয়েছে যে ভারতে ইংরেজিতে প্রকাশিত প্রাথমিক সংবাদ প্রতিবেদনগুলো প্রকৃতপক্ষে ভুল ছিল। প্রতিবেদনসমূহে বলা হয়, হাতিটিকে বাজিভর্তি আনারস খাওয়ানো হয়েছিল এবং ঘটনার স্থান হিসেবে কেরালার মালাপ্পুরাম জেলাকে উল্লেখ করা হয়।
হাতিটিকে 'আনারস খাওয়ানো' বলে সংবাদ প্রচারের ব্যাপারটি তাৎপর্যপূর্ণ কারণ এতে বোঝা যায় কাজটি ইচ্ছাকৃত ছিল। এছাড়া বিজেপির কিছু নেতাকর্মী ঘটনাটির সাথে মুসলিম সম্প্রদায়কে অসত্যভাবে সম্পর্কিত করার জন্য তাদের মন্তব্যে মালাপ্পুরাম জেলার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন।
ঘটনাটির প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য 'বুম' বন বিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেছে এবং জানতে পেরেছে যে প্রাণীটি খুব সম্ভবত দুর্ঘটনাবশত বিস্ফোরকভর্তি কিছু খাওয়ার পরে মারা গেছে। এ ধরনের বিস্ফোরকভর্তি খাবার মূলত ওই এলাকার কলা ও আনারস ক্ষেত থেকে বন্য শূকরকে দূরে রাখার জন্য ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার হয়।
এছাড়া প্রাথমিকভাবে ঘটনাটি মালাপ্পুরামে ঘটার কথা বলা হলেও আসলে তা পালাক্কাড় জেলায় ঘটেছে। এই
প্রতিবেদনটি প্রকাশের সময় একজন সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী কেরালা বন বিভাগ ঘটনার সাথে সম্পর্কিত পি উইলসন নামে একজনকে গ্রেফতার করেছে। বুম পৃথকভাবে গ্রেফতারের খবরটির সত্যতা নিশ্চিত হয়েছে।
যে নদীতে হাতিটি মারা যায় সেখানে তার দাঁড়িয়ে থাকার হৃদয়বিদারক দৃশ্য শুধু প্রাণী অধিকার কর্মী নয়, বরং রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে শিল্পপতি, ক্রীড়াব্যক্তিত্ব ও বলিউড তারকাদেরও সরব প্রতিবাদ জানাতে বাধ্য করেছে। কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নও অনাকাঙ্ক্ষিত এই ঘটনা নিয়ে টুইট করেছেন।
তবে বিজয়ন অবশ্য বলেছেন যে কেউ কেউ ঘটনাটিকে ঘৃণা ছড়ানোর কাজে ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন।
ঘটনার পরম্পরা:
আনুমানিক ১৫ বছর বয়সী হাতিটি গত ২৭ মে পালাক্কাড় জেলার মানারকাড়ে মারা যায়। বন বিভাগের একজন কর্মকর্তা বুমকে জানিয়েছেন যে পেটের ভ্রূণটি একমাস বয়সী ছিল।
গত ৩০ মে কেরালা বন বিভাগের সেকশন অফিসার মোহন কৃষ্ণ তার ফেসবুক পেজে ঘটনাটির কয়েকটি ছবিসহ একটি আবেগঘন পোস্ট দেন। জুনের প্রথম সপ্তাহে পোস্টটি ভাইরাল হয় এবং ভারতীয় গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
জুনের ২ তারিখে NDTV এর মত উল্লেখযোগ্য মূলধারার গণমাধ্যম হাতিটিকে বিস্ফোরকভর্তি আনারস খাওয়ানো হয়েছিল বলে ভুল প্রতিবেদন করে। India Today, Republic, Times Now, Financial Express এবং DNA এর মত সংবাদমাধ্যমও একইভাবে ভুল সংবাদ প্রকাশ করে। Hindustan Times ও ANI একইরকম টুইট করে।
আসলে কী ঘটেছিল:
বুম ঘটনার সাথে সম্পর্কিত চারজন কর্মকর্তার সাথে কথা বলেছে এবং হাতিটির মৃত্যু পূর্ববর্তী ধারাবাহিক ঘটনাপ্রবাহের চিত্র এঁকেছে।
মান্নারকাড়ের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বুমকে বলেন যে হাতিটি মে মাসের ২৭ তারিখে মারা যায়। তার এক সপ্তাহ আগে স্থানীয়রা হাতিটিকে দেখতে পায় এবং তাড়িয়ে জঙ্গলে ফিরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে কিন্তু সেটি আবার ফিরে আসে।
বুম পরবর্তীতে মান্নারকাড়ের রেঞ্জ বন কর্মকর্তা আশিক আলীর সাথে কথা বলেছে। আলী আমাদের জানান যে, ঘটনাটি পালাক্কাড় ও মান্নারকাড়ের সীমান্তবর্তী পালাক্কাড়ের আম্বারাপ্পারা গ্রামে ঘটেছে। তিনি আরো জানান, মে মাসের মাঝামাঝিতে যখন হাতিটি সাইলেন্ট ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক থেকে বেরিয়ে পার্শ্ববর্তী বাফার জোনের কলা ও আনারস ক্ষেতে চলে আসে তখন স্থানীয়রা এটি দেখতে পায়।
তিনি বলেন, 'হাতিটি বারবার জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসছিল। ওই এলাকায় প্রচুর কলা ও আনারস ক্ষেত রয়েছে। স্থানীয়রা প্রথমে এটিকে তাড়িয়ে দেয় কিন্তু সে আবার ফিরে আসে। আমরা পুনরায় হাতিটিকে প্রায় ছয় দিন আগে ক্ষতবিক্ষত জিহবা ও চোয়ালসহ দেখতে পাই। এটি সম্ভবত বিস্ফোরকভর্তি কোন ফল খেয়েছিল যা স্থানীয়রা তাদের ক্ষেত থেকে বন্য শূকরকে দূরে রাখার জন্য ব্যবহার করে।'
রেঞ্জ বন কর্মকর্তা জানান যে ক্ষেত থেকে বন্য শূকরকে দূরে রাখার জন্য পান্নি পাদাক্কাম বা ফাঁদ পাতা স্থানীয়দের একটি প্রচলিত কৌশল। তারা ফল, বিশেষ করে আনারসের ভিতরে পটকা ভর্তি করে রাখেন এবং যখনই কোন প্রাণী সেটাতে চাপ দেয় তখন এটি বিস্ফোরিত হয় ফলে প্রাণীটি ভয়ে পালিয়ে যায়। যদিও গত পাঁচ বছরে এরকম কোন প্রাণীর ক্ষতি হওয়ার খবর তারা পাননি।
আলী বলেন, 'আমরা মে মাসের ২৩ তারিখে মান্নারকাড়ের ভেলিয়ার নদীর একটি শাখানদীতে হাতিটিকে দাঁড়ানো দেখতে পাই। এটি ব্যথায় কাতরাচ্ছিল এবং অপারেশন করা জরুরী ছিল কিন্তু এর জন্য হাতিটিকে ডাঙ্গায় নিয়ে আসা প্রয়োজন ছিল। আমরা এটিকে শান্ত করতে না পেরে দুটি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পোষা হাতি নিয়ে আসি সেটিকে পানি থেকে উপরে তুলে নিয়ে আসার জন্য কিন্তু তার আগেই হাতিটি সেখানে মারা যায়।'
ময়নাতদন্ত প্রতেবদন:
The News Minute এর পাওয়া ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী বিস্ফোরনের কারণে হাতিটির মুখ ও মুখ বিহবর মারাত্নক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই আঘাত থেকে সেপটিক সংক্রমণ হয় যার ফলে টানা দুই সপ্তাহ হাতিটি কোন খাবার কিংবা পানিও পান করতে পারেনি যা তাকে আরো দুর্বল করে দিয়েছিল। হাতিটি পানিতে দাঁড়িয়ে ছিল এবং প্রতিবেদনে পানিতে ভর্তি হয়ে ফুসফুসের অকার্যকারতাকে মৃত্যুর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে।
মানুষ বনাম প্রাণী:
মান্নারকাড়ের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বুমকে বলেন যে এরকম এলাকায় মানুষ আর বন্য প্রাণীর মধ্যে দ্বন্দ্ব খুবই সাধারণ কারণ কিছু কৃষক বাফার জোনে শস্য চাষ করেন। তিনি জানান, কৃষকেরা বন্য প্রাণীকে দূরে রাখার জন্য আগুন ও গর্ত ইত্যাদি ব্যবহার করেন। তার ভাষ্য অনুয়ায়ী, বন বিভাগের কর্মকর্তারা নিয়মিত ওই এলাক্য টহল দেন এবং গর্তসহ অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে রাখেন।
মোহন কৃষ্ণ, যিনি হাতিটিকে উদ্ধার করার জন্য পাঠানো রেসপন্স টিমের একজন ছিলেন, তিনি বুমকে বলেন যে, স্থানীয়রা বন্য প্রাণীকে ভয় দেখিয়ে দূরে রাখার জন্য পটকা ভর্তি ফল ব্যবহার করেন। তার মতে, 'বিশেষ করে বন্য শূকরকে দূরে রাখার জন্য এসবের ব্যবহার হয় কারণ শূকর ক্ষেতে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে।'
যেখান থেকে হাতিটি বেরিয়ে এসেছিল বলা হচ্ছে সেই সাইলেন্ট ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক মান্নারকাড় থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে। কর্মকর্তারা আমাদের জানান, প্রায়ই হাতিগুলো তাদের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ঘ্রাণ পেয়ে কলা ও আনারসের মত ফলের সন্ধানে কয়েক কিলোমিটার দূরের বাফার জোনে চলে আসে।
ঘটনাটিকে সাম্প্রদায়িক রূপ দেয়ার চেষ্টা:
বিজেপির ক্যাবিনেট মন্ত্রী প্রকাশ জাভাদেকার বলেছেন ঘটনাটি মালাপ্পুরামে ঘটেছে যা সত্য নয়। জাভাদেকার আরো বলেন, এই ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের ধরতে কোন চেষ্টার কমতি হবেনা।
বিজেপি নেত্রী ও প্রাণী অধিকার কর্মী মানেকা গান্ধী সংবাদ মাধ্যম ANI এর সাথে কথা বলার সময় মালাপ্পুরামে সংঘটিত 'সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ' এর অধিক সংখ্যার কথা উল্লেখ করেছেন।
তিনি কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীকে ওই এলাকার অলে উল্লখ করে রাহুলের কাছ থেকে ব্যবস্থার দাবী জানান। যদিও রাহুল আসলে ওয়াইয়ানাড় থেকে নির্বাচিত একজন সংসদ সদস্য, মালাপ্পুরামের নয়।
মালাপ্পুরামকে এই ঘটনার সাথে জড়ানোর প্রচেষ্টা সামাজিক মাধ্যমেও হয়েছে। বুম একইরকম অসত্য দাবীর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক টুইট ও ফেসবুক পোস্ট পেয়েছে।
হিন্দি শিরোনামে হাতির বিরুদ্ধে নির্মমতার চিত্র আঁকা কার্টুনসহ একটি ফেসবুক পোস্ট করা হয় যেখানে বলা হয়েছে, 'যেখানে একটি হাতিকে হত্যা করা হয়েছে সেই মালাপ্পুরামে ৭০ ভাগ জনসংখ্যা শান্তিকামী। হিন্দুরা সেখানে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। যেহেতু হিন্দুরা গনেশের পূজা করে তাই উমা নামের হাতিটিকে হত্যা করা হয়েছে। মালাপ্পুরাম আইএস এর দুর্গ এবং মুসলিম লীগ সেখানে মালাপ্পুরামসহ আরো ৯ টি জেলা নিয়ে পৃথক প্রদেশ করতে চায়'। (শান্তিকামী শব্দটি ভারতে মুসলমানদের ব্যঙ্গ করে বলা হয়)।
বুম মালাপ্পুরামের নীলাম্বর (উত্তর) বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা যোগেশ নিলকান্তের সাথে যোগাযোগ করেছে এবং তিনি জানান ঘটনাটি প্রদেশের পালাক্কাড় জেলার মান্নারকাড় বন বিভাগে ঘটেছে।
বিভাগীয় এই বন কর্মকর্তা জানান, মালাপ্পুরামের দুটি বন রেঞ্জ আছে; নিলাম্বুর উত্তর ও দক্ষিন বিভাগ। অবশ্য যেই সাইলেন্ট ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক থেকে হাতিটি বেরিয়েছে এবং যেখানে মারা গেছে উভয় স্থানই পালাক্কাড় জেলায় পড়েছে।
তিনি জানান, 'যে ব্যক্তি ঘটনাটি ফেসবুকে পোষ্ট করেছেন তিনি নীলাম্বুরের আর এজন্যই হয়তো এই বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে'।
প্রতিবেদনটি বুম লাইভ-এর এই প্রতিবেদন থেকে অনুদিত।