ভারতীয় নৌবাহিনীর বাংলাদেশি জাহাজ উদ্ধারের তথ্যটি সঠিক নয়
বাংলাদেশি জাহাজ নয় বরং সোমালি জলদস্যুদের হাতে জিম্মি থাকা মাল্টিজ পতাকাবাহী একটি জাহাজ উদ্ধার করেছে ভারতীয় নৌবাহিনী।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের একাধিক আইডি, পেজ ও গ্রুপ থেকে একটি জাহাজের ছবি পোস্ট করে দাবি করা হচ্ছে, সোমালিয়ার জলদস্যুদের ছিনতাইকৃত বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ উদ্ধার করেছে ভারতীয় নৌবাহিনী। এরকম কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে ও এখানে।
গত ১৬ মার্চ 'MD Sojib' নামের একটি আইডি থেকে একটি জাহাজের ছবি পোস্ট করে লেখা হয়, "ভারতীয় নৌবাহিনী সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবলে পড়া বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ উদ্ধার করেছে!"। নিচে পোস্টটির স্ক্রিনশট দেখুন--
ফ্যাক্ট চেক:
বুম বাংলাদেশ যাচাই করে দেখেছে, আলোচ্য দাবিটি সঠিক নয়। বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ নয় বরং গতবছরের ১৪ ডিসেম্বর থেকে সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে আটক থাকা রুয়েন নামে মাল্টিজ পতাকাবাহী একটি কার্গো জাহাজ উদ্ধার করেছে ভারতীয় সেনাবাহিনী।
বাংলাদেশি জিম্মি জাহাজের সবশেষ পরিস্থিতি
কি-ওয়ার্ড সার্চ করে সোমালি জলদস্যুদের হাতে আটক থাকা বাংলাদেশি জাহাজ উদ্ধারের ব্যাপারে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কোনো প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে কি-ওয়ার্ড সার্চ করে গত ২০ মার্চ প্রকাশিত বিবিসি বাংলার ওয়েবসাইটে "এমভি আব্দুল্লাহর মালিকপক্ষের সাথে যোগাযোগ করলো সোমালি জলদস্যুরা" শিরোনামে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। এতে বলা হয়, জলদস্যুরা জাহাজটির বাংলাদেশি মালিকপক্ষের সাথে যোগাযোগ করেছে, মালিকপক্ষও জাহাজটি উদ্ধারে জলদস্যুদের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। স্ক্রিনশট দেখুন--
একইভাবে সার্চ করে গত ১৬ মার্চ "অপারেশন আটলান্টা নজরে রেখেছে বাংলাদেশি জাহাজটিকে" শিরোনামে মানবজমিন পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুুঁজে পাওয়া যায়। এতে বলা হয়, "সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজকে উদ্ধারে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের বাংলাদেশ সহায়তা চাওয়ার পর এগিয়ে আসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেভাল ফোর্স (ইইউএনএভিএফওআর)। তারা এমভি আব্দুল্লাহকে পর্যবেক্ষণে রেখেছে। বাংলাদেশের এই জাহাজকে উদ্ধারে তাদের এই পুরো কার্যক্রমের নাম দেয়া হয়েছে ‘অপারেশন আটলান্টা’। ইইউএনএভিএফওআর বৃহস্পতিবার এমভি আব্দুল্লাহকে উদ্ধারে তাদের প্রচেষ্টার বিষয় জানিয়ে এক বিবৃতিতে বলে, ছিনতাই হওয়া জাহাজের পরিস্থিতি এখনো একই অবস্থায় আছে এবং নাবিকরা নিরাপদে আছে। জিম্মি জাহাজে অন্তত ১২ জন জলদস্যুকে নিশ্চিত করা হয়েছে। যদিও ছিনতাইয়ের সময় ২০ জন সশস্ত্র ব্যক্তির কথা বলা হয়েছিল।" অর্থাৎ জাহাজটি এখনো উদ্ধার করা হয়নি। স্ক্রিনশট দেখুন--
ভারতীয় নৌবাহিনী কি বাংলাদেশি জাহাজ উদ্ধার করেছে?
কি-ওয়ার্ড সার্চ করে "Indian navy intercepts Somali pirates on cargo ship Ruen" শিরোনামে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সে গত ১৬ মার্চ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুজে পাওয়া যায়। যেখানে বলা হয়, গতবছরের ১৪ ডিসেম্বর রুয়েন নামে মাল্টিজ পতাকাবাহী একটি কার্গো জাহাজ জিম্মি করে নেয় সোমালি জলদস্যুরা। সেই জাহাজটি আটকে দেয় ভারতীয় নৌবাহিনী। তাদের আত্মসমপর্ণের জন্য আহ্বান জানানো হয়। এ সময় জাহাজে থাকা বেসামরিক নাগরিকদের ছেড়ে দেয়ারও আহ্বান জানানো হয় নৌবাহিনীর পক্ষ থেকে। একই প্রতিবেদনে, ব্রিটিশ মেরিটাইম সিকিউরিটি ফার্ম অ্যামব্রে বলছে, এমভি আবদুল্লাহকে যখন ছিনতাই করা হয়, তখন রুয়েন মাত্র ২৯৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছিল এবং পূর্বদিকেই যাচ্ছিল। ফলে তাদের ধারণা, মাল্টিজ জাহাজ রুয়েনকে জলদস্যুরা ছিনতাইয়ের কাজে মাদার ভ্যাসেল হিসেবে ব্যবহার করছে। (অনূদিত) স্ক্রিনশট দেখুন--
একইভাবে সার্চ করে "এমভি আব্দুল্লাহ নয়, রুয়েন উদ্ধার করেছে ভারতীয় নৌ বাহিনী" শিরোনামে দেশ রুপান্তরের একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। এতে বলা হয়, "গত মঙ্গলবার বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ জিম্মি করে নেয় সোমালি জলদস্যুরা। আজ বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে ভারতীয় নৌবাহিনী জাহাজটি উদ্ধার করেছে বলে সংবাদ প্রচার করেছে ভারতীয় বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম। তবে তথ্যটি সঠিক নয়। শনিবার ভারতীয় নৌবাহিনীর মুখপাত্র রয়টার্সকে জানান, গতবছরের ১৪ ডিসেম্বর রুয়েন নামে মাল্টিজ পতাকাবাহী একটি কার্গো জাহাজ জিম্মি করে নেয়। সেই জাহাজটি আটকে দিয়েছে ভারতীয় নৌবাহিনী।" স্ক্রিনশট দেখুন--
অর্থাৎ এমভি আবদুল্লাহ নয় বরং রুয়েন নামে মাল্টিজ পতাকাবাহী একটি কার্গো জাহাজ ভারতীয় নৌবাহিনী উদ্ধার করেছে বলে গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে।
বিভ্রান্তিমূলক সংবাদের উৎস:
কি-ওয়ার্ড সার্চ করে বাংলাদেশি জাহাজ উদ্ধার করেছে ইন্ডিয়ান নৌবাহিনী এমন শিরোনাম দিয়ে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, নিউজ ১৮, ইন্ডিয়া টুডে, দ্য নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ভারতীয় বার্তা সংস্থা ইন্দো এশিয়া নিউজ সার্ভিস (আইএএনএস), ফার্স্ট পোস্ট-সহ দেশটির কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন খুজে পাওয়া যায়। কিন্তু প্রতিবেদনগুলোর শিরোনামে ভারতীয় নৌবাহিনীর বাংলাদেশি জাহাজ উদ্ধার করেছে দাবি করলেও এর বিস্তারিত বিবরণে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্যই পাওয়া যায়নি। নিচে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলোর লিংক দেখুন--
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস: Navy rescues hijacked Bangladesh-flagged ship
নিউজ ১৮: Indian Navy Rescues Bangladeshi Ship Hijacked by Pirates
ফার্স্ট পোস্ট: Indian Navy saves Bangladesh-flagged ship from pirate attack off Somalia coast
দ্য নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস: Navy rescues Bangladeshi ship in Gulf of Aden
ইন্ডিয়া টুডে: Indian Navy thwarts pirates' attack on Bangladeshi vessel near Somalia
এসব শিরোনামগুলোতে বাংলাদেশি জাহাজ উদ্ধার নিয়ে তথ্য থাকলেও প্রতিবেদনগুলোর বিবরণে এই দাবির ব্যাপারে কোনো সত্যতা নিশ্চিত করতে পারেনি।
এদিকে, ভারতীয় প্রতিবদনগুলোর ব্যাপারে জানতে সংশ্লিষ্ট কি-ওয়ার্ড সার্চ করে ‘এমভি আব্দুল্লাহকে উদ্ধার করেছে ভারতীয় নৌবাহিনী?’ শিরোনামে ঢাকা পোস্টের একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, "আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাওয়ার পথে ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে ছিনতাইয়ের শিকার হওয়া বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে উদ্ধার করা হয়েছে জানিয়ে ভারতীয় প্রথম সারির বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয়েছে। ভারতের নৌবাহিনীর রণতরী ও টহল বিমান অভিযান চালিয়ে এমভি আব্দুল্লাহকে উদ্ধার করেছে বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দেশটির এসব সংবাদমাধ্যম। তবে এমভি আব্দুল্লাহকে উদ্ধারের বিষয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের দাবির সত্যতা নিশ্চিত হতে পারেনি ঢাকা পোস্ট। এমনকি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনের শিরোনামে এমভি আব্দুল্লাহকে ভারতীয় নৌবাহিনী উদ্ধার করেছে বলে জানানো হলেও প্রতিবেদনে এ সংক্রান্ত কোনও তথ্যই দেওয়া হয়নি।" স্ক্রিনশট দেখুন--
অর্থাৎ সোমালি জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহকে উদ্ধার করেনি ভারতীয় নৌবাহিনী। তারা মূলত রুয়েন নামে মাল্টিজ পতাকাবাহী একটি কার্গো জাহাজ উদ্ধার করেছে।
প্রসঙ্গত গত ১২ মার্চ বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে জিম্মি করে সোমালি জলদস্যুরা। মোজাম্বিকের রাজধানী মাপুতো থেকে কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দিকে যাচ্ছিল জাহাজটি। পরে সেটি সোমালিয়ার উপকূলে পৌঁছালে জাহাজটিসহ এর ২৩ সদস্যের ক্রুদের জিম্মি করে তারা।
সুতরাং ভারতীয় নৌবাহিনী সোমালি জলদস্যুদের হাতে জিম্মি থাকা বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহকে উদ্ধার করেছে বলে ফেসবুকে পোস্ট করা হচ্ছে, যা বিভ্রান্তিকর।