ছবিটি বাস্তব মানুষের নয় বরং ভাস্কর্যের
বুম বাংলাদেশ দেখেছে, আলোচ্য ছবিটি জার্মানির একটি যাদুঘরে থাকা ভাস্কর্যের যা কাল্পনিক চরিত্রের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে।
সামাজিক মাধ্যমে একাধিক আইডি ও গ্রুপে একটি ছবি পোস্ট করে বলা হচ্ছে, ছবিটি এডওয়ার্ড মরড্রেক নামের এক ব্যক্তির, যার দুটি মুখ ছিল। এরকম কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে ও এখানে।
গত ২২ মার্চ 'বিশ্ব ও মহাকাশ' নামের একটি ফেসবুক গ্রুপে 'Md Azizul' নামের একটি একাউন্ট থেকে দুটি ছবি পোস্ট করে বলা হয়, "এই ব্যাক্তিকে চেনেন? এই ব্যাক্তির নাম এডওয়ার্ড মরড্রের্ক,যিনি ১৯ শতকে পৃথিবীর মুখ দেখেছিলেন। কিন্তু সবার মতো তার মুখ একটি ছিলোনা,বরং উভয় দিকে মাথার সামনে ও পিছনের দিকে ছিলো।তাঁর মুখ ছিলো দুইটি, ওনার ধারণা ছিলো তার অন্য মুখটি ছিলো শয়তানের মুখ। কারন,সেটি নাকি রাতের বেলায় ঘুমোতে দিতো না,কানের কাছে ফিস ফিস করতো। তাঁর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিলোনা সে মুখের উপর। অনেক সুত্র অনুযায়ী, অবাঞ্ছিত মুখটি খাওয়া দাওয়া করতে পারতো না। এডওয়ার্ড যখন খুশি থাকতেন,তখন অন্য মুখটি নাকি কাঁদতো,আর তিনি যখন কাঁদতেন তখন অন্যটি আনন্দে হাসতো।। তার মানে আবেগ অনুভুতি সম্পুর্ন বিপরীত। =>কি মারাত্মক তাই না?? এতে তিনি অতিষ্ট হয়ে অনেক ডাক্টারকে অস্ত্র পচার করে তার অন্য মাথাটি কেটে ফেলার অনুরোধ করেন, কিন্তুু কেউ সাহস করেনি। সব শেষ তিনি প্রচন্ড ডিপ্রেশনে ভুগে মাত্র ২৩-বছর বয়সে আত্মহত্যা করেন।। #collected"। পোস্টে যুক্ত দুটি ছবির মধ্যে একটি ছবিতে একজন দুই মুখবিশিষ্ট মানুষের ছবি দেখা যায়। অন্য ছবিটিতে দুই মুখবিশিষ্ট একজন ব্যক্তির মমি করা মাথা দেখতে পাওয়া যায়। ফেসবুক পোস্টটির স্ক্রিনশট দেখুন--
ফেসবুক পোস্টে যুক্ত ছবি দুটি দেখুন আলাদাভাবে--
অর্থাৎ ফেসবুক পোস্টে দেখানো দুটি ছবির একটিকে এডওয়ার্ড মরড্রেক নামে এক ব্যক্তির ছবি এবং দ্বিতীয় ছবিটিকে তার মমি করা মাথার ছবি বলে দাবি করা হচ্ছে।
ফ্যাক্ট চেক:
বুম বাংলাদেশ যাচাই করে দেখেছে, আলোচ্য দাবিটি সঠিক নয়। পোস্টের ছবি দুটি বাস্তব মানুষের নয় বরং কাল্পনিক চরিত্রের উপর ভিত্তি করে নির্মিত ভাস্কর্যের। প্রথম ছবিটি একটি মোমের ভাস্কর্য, যা এডওয়ার্ড মরড্রেক নামে একটি কাল্পনিক চরিত্রের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়, ভাস্কর্যটি জার্মানির হামবুর্গ শহরের পানোপতিকুম যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এছাড়া মমি দাবি করা দ্বিতীয় ছবিটিও একটি ভাস্কর্যের।
কি-ওয়ার্ড সার্চ করে 'Panoptikum' নামে একটি ইউটিউব চ্যানেলে ২০১৬ সালের ১৫ জুন "Panoptikum - Das Wachsfigurenkabinett in Hamburg" শিরোনামে একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। ওই ভিডিওটির ১ মিনিট ৬ সেকেন্ড থেকে ১ মিনিট ১৫ সেকেন্ড পর্যন্ত অংশে আলোচ্য পোস্টের প্রথম ছবিটির মত দেখতে একটি ভাস্কর্য খুঁজে পাওয়া যায়। উল্লেখ্য পানোপতিকুম জার্মানির হামবুর্গ শহরে অবস্থিত একটি ওয়াক্স জাদুঘর। জাদুঘরটিতে মোম নির্মিত ভাস্কর্য রাখা হয়। অর্থাৎ আলোচ্য পোস্টের প্রথম ছবিটি একটি মোম নির্মিত ভাস্কর্য। ইউটিউব ভিডিওটি দেখুন--
উপরের ইউটিউব ভিডিওটিতে দেখানো ভাস্কর্যের স্ক্রিনশট দেখুন--
এবারে, আলোচ্য পোস্টের প্রথম ছবিটি (বামে) এবং ইউটিউব ভিডিওটি থেকে নেয়া স্ক্রিনশট (ডানে) দেখুন পাশাপাশি--
কি-ওয়ার্ড সার্চ করে দ্য মিউজিয়াম অব হোক্সেস নামের একটি ওয়েবসাইটে ২০১৫ সালের ২৪ এপ্রিল "Edward Mordake—A Mystery Solved" শিরোনামে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত নিবন্ধে বলা হয়, এটি এডওয়ার্ড মরড্রেকের আসল ছবি নয়। বরং এটি মরড্রেককে দেখতে কেমন হতে পারতো সেটি বোঝাতে একজন শিল্পীর বানানো মোমের ভাস্কর্য। এছাড়া এডওয়ার্ড মরড্রেকের এ রকম ভাস্কর্য বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে তৈরি করা হয়েছে বলেও জানানো হয় ওই নিবন্ধে। এই নিবন্ধে যুক্ত ছবিটিও আলোচ্য পোস্টের প্রথম ছবিটির মত দেখতে। স্ক্রিনশট দেখুন--
ওই নিবন্ধ থেকে আরো জানা যায়, আমেরিকান ফিকশন লেখক চার্লস লটিন হিল্ড্রেথের কাল্পনিক লেখা থেকে ধারণা নিয়ে জর্জ এম গোউল্ড এবং ওয়াল্টার এল পাইল নামে দুজন চিকিৎসক তাদের লেখা বইয়ে এডওয়ার্ড মরড্রেককে নিয়ে লেখেন। এডওয়ার্ড মরড্রেক Anomalies and Curiosities of Medicine নামে ওই বইয়ের চরিত্র। এডওয়ার্ড নামের একজন উচ্চবংশীয় ব্যক্তির কথা ওই বইতে বলা হলেও আসলেই এরকম কোনো ব্যক্তি কখনো ছিলেন কি না সেটি নিশ্চিত করা যায়নি। বইতে এডওয়ার্ড মরড্রেক নামের এক ব্যক্তির জীবনকাহিনী উল্লেখ করা হয়েছে যিনি শারীরিক গঠনগত ত্রুটির শিকার ছিলেন। লোকমুখে প্রচলিত সূত্রে ওই কাহিনীতে বলা হয়, ইংল্যান্ডে এডওয়ার্ড মরড্রেক নামে একজন উচ্চবংশীয় ব্যক্তি ছিলেন যার মাথার পিছনে আরেকটি মুখ ছিল। দ্বিতীয় মুখটিকে তিনি 'Devil Twin' হিসেবে উল্লেখ করতেন এবং মাথার ভিতরে তার আওয়াজ পেতেন বলে দাবি করতেন। এডওয়ার্ড চিকিৎসকদেরকে অনুরোধ করতেন যেনো দ্বিতীয় মুখটিকে অপারেশন করে ফেলে দেওয়া হয়। ২৩ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেন এডওয়ার্ড মরড্রেক।
অর্থাৎ আলোচ্য ফেসবুক পোস্টের প্রথম ছবিটি কোনো বাস্তব মানুষের ছবি নয়। এটি মূলত একটি মোমনির্মিত ভাস্কর্যের ছবি।
এদিকে কি-ওয়ার্ড সার্চ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গণমাধ্যম নিউজউইকের ওয়েবসাইটে ২০১৮ সালের ৪ মে "Edward Mordrake's Mummified Head Photo Isn't Real, Two-Faced Skull Created by Artist" শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে আলোচ্য পোস্টের দেখানো দ্বিতীয় ছবিটির মত হুবহু একটি ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ইওয়ার্ট শিন্ডলার নামের একজন শিল্পী ওই ভাস্কর্যটি তৈরি করেছেন। এছাড়া, শিন্ডলার নিউজউইককে জানিয়েছেন, papier-mâché প্রক্রিয়ায় তিনি ওই ভাস্কর্যটি তৈরি করেন। স্ক্রিনশট দেখুন--
নিউজউইকের প্রতিবেদনের সূত্র ধরে কি-ওয়ার্ড সার্চ করে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক বৃহত্তম ভার্চুয়াল আর্ট গ্যালারি 'ডেভিয়ান আর্ট'-এ ২০১৫ সালের ২৭ অক্টোবর পোস্ট করা একটি ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। ডেভিয়ান আর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ছবি এবং আলোচ্য ফেসবুক পোস্টের দ্বিতীয় ছবিটি হুবহু এক। The Head of Edward Mordrake শিরোনামে পোস্টকৃত ওই ছবিটির পোস্টদাতা হিসেবে দেখা যায় ই জে শিন্ডলারের নাম। অর্থাৎ আলোচ্য পোস্টের দ্বিতীয় ছবিটিতে দেখানো মমি করা মাথার ছবিটিও প্রকৃতপক্ষে ই জে শিন্ডলারের তৈরি করা একটি ভাস্কর্যের। স্ক্রিনশট দেখুন--
এবারে আলোচ্য ফেসবুক পোস্টের দ্বিতীয় ছবি (বামে) এবং ই জে শিন্ডলারের বানানো ভাস্কর্যের ছবিটি (ডানে) দেখুন পাশাপাশি--
অর্থাৎ আলোচ্য পোস্টের ছবি দুটি বাস্তব কোনো ব্যক্তির নয় বরং দুটিই ভাস্কর্যের ছবি। দুটি ছবিই কাল্পনিক চরিত্র এডওয়ার্ড মরড্রেককে নিয়ে তৈরি করা শিল্পীদের ভাস্কর্যের ছবি।
সুতরাং এডওয়ার্ড মরড্রেক নামের এক কাল্পনিক চরিত্রের ভাস্কর্যের ছবিকে বাস্তব দাবিতে ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে, যা বিভ্রান্তিকর।