না, তিনি ইরানের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি নন
বুম বাংলাদেশ দেখেছে, ইরাকের আহদ আল্লাহ মুভমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা সাইয়িদ হাশিম আল হায়দারির বক্তব্যের ভিডিও এটি।
সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকের একাধিক আইডি থেকে একটি বক্তব্যের ভিডিও শেয়ার করে দাবি করা হচ্ছে, তিনি ইরানের সদ্যপ্রয়াত প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। এরকম কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে ও এখানে।
গত ২০ মে 'Md Moinur Rashid' নামে একটি ফেসবুক একাউন্ট থেকে একটি ভিডিও শেয়ার করে বলা হয়, "মুসলিম বিশ্বের অন্যতম মুখপাত্র ও ইরানী প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির অগ্নিঝরা বক্তব্য। তিনি মজলুম ফিলিস্তিনবাসীর জন্য বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর ছিলেন। হে আল্লাহ প্রিয় রাহবারের এই মৃত্যু শাহাদাৎ হিসাবে কবুল করুন।" ফেসবুক পোস্টটির স্ক্রিনশট দেখুন--
ফ্যাক্ট চেক:
বুম বাংলাদেশ যাচাই করে দেখেছে, দাবিটি সঠিক নয়। ভিডিওটিতে বক্তব্য দেওয়া ব্যক্তি ইরানের সদ্যপ্রয়াত প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি নন বরং তার নাম সাইয়িদ হাশিম আল হায়দারি, তিনি ইরাকের একজন শিয়া নেতা।
আলোচ্য ভিডিওটির উৎস
আলোচ্য ভিডিওটি থেকে কি-ফ্রেম নিয়ে সার্চ করে ভিডিওর বক্তব্যকে বাংলায় অনুবাদ করে সাবটাইটেল বসানো অরিজিনাল ভিডিওটি 'উসমানীয়া টিভি' নামের একটি ফেসবুক পেজে খুঁজে পাওয়া যায়। গত ১৭ এপ্রিল পোস্ট করা ভিডিওটিতে অনুবাদকের নাম লেখা রয়েছে 'ওসমান গনি'। বাংলায় অনুবাদ করা অরিজিনাল এই ভিডিওটিকে এডিট করে উক্ত পেজের (উসমানিয়া টিভি) লোগো এবং অনুবাদকের নামের অংশ ফেলে দিয়ে ভিন্ন একটি নাম বসিয়ে সাদাকালো মুডে ভিডিওটি তৈরি করা হয়। অনুবাদ করা অরিজিনাল ভিডিওটি রঙিন ভার্সনে রয়েছে যা আলোচ্য ভিডিও থেকে স্পষ্ট। তবে উক্ত পোস্টে লেখা হয়, "ফলো করুন- ইবাদত 彡 জানিনা তাদের উদ্দেশ্য কি!! যদি ভালো উদ্দেশ্য হয় তবে তাদের জন্য দোয়া, আর যদি খারাপ উদ্দেশ্য হয় তবে আল্লাহ্ই তাদের শাস্তি দেবে।" অর্থাৎ পোস্টে বক্তব্য দেয়া ব্যক্তির পরিচয় নিয়ে কোনো তথ্য উল্লেখ করা নেই। এই পেজ ঘুরে দেখা যায়, পেজটি ভিন্ন ভাষায় দেয়া বিভিন্ন ব্যক্তিদের বক্তব্য বাংলা অনুবাদে সাবটাইটেল দিয়ে প্রকাশ করে থাকে। 'উসমানীয়া টিভি' পেজের ভিডিওটি দেখুন--
উক্ত ভিডিওটি ও আলোচ্য ভিডিওটির সময় অনুযায়ী অনুবাদের সাবটাইটেল, বানান, লেখার ফন্ট ও প্যাটার্ন হুবহু একই রকম। আলোচ্য ভিডিওটির ২৩ সেকেন্ড থেকে নেয়া একটি ফ্রেম (বামে) ও 'উসমানীয়া টিভি' ফেসবুক পেজে পাওয়া ভিডিওটির ২৩ সেকেন্ড থেকে নেয়া একটি ফ্রেমের (ডানে) তুলনা দেখুন পাশাপাশি--
আলোচ্য ভিডিওটিতে বক্তব্য দেয়া ব্যক্তি কে?
আলোচ্য ভিডিওতে ব্যক্তির বক্তব্য পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, তিনি আরবি ভাষায় বক্তব্য দিচ্ছেন। তাই সাবটাইটেল থেকে তার বক্তব্যের কি-ওয়ার্ড 'আমেরিকা মহা শয়তান, ইসরায়েল অত্যাচারী' আরবি ভাষায় ট্রান্সলেট করে গুগলে কি-ওয়ার্ড সার্চ করলে একই ব্যক্তির ভিন্ন অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তব্যের ছোট ছোট অসংখ্য ভিডিও ক্লিপ খুঁজে পাওয়া যায় ক্ষুদে ভিডিও শেয়ারিং মাধ্যম টিকটকে। এই টিকটক পোস্টের ক্যাপশনের হ্যাশট্যাগ অনুবাদ করে জানা যায়, বক্তব্য দেয়া ব্যক্তির নাম সাইয়িদ হাশিম হায়দারি।
এরপর 'সাইয়িদ হাশিম হায়দারি' এর আরবি অনুবাদ করে কি-ওয়ার্ড সার্চ করে একই ব্যক্তির প্রোফাইল ছবি সহ একই নামে ইউটিউব চ্যানেল ও ইনস্টাগ্রামে প্রোফাইল খুঁজে পাওয়া যায়। ইউটিউব চ্যানেলের অ্যাবাউট সেকশন ও ইনস্টাগ্রামে প্রোফাইলে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এগুলো 'মি. সাইয়িদ হাশিম আল-হায়দারি' এর বক্তব্য, মতামত ও কার্যক্রম প্রচারের অফিশিয়াল মাধ্যম।
উক্ত ইউটিউব চ্যানেলে সার্চ করে আলোচ্য ভিডিওটি হায়দারির যে অনুষ্ঠানের বক্তব্য থেকে কেটে নেয়া হয়েছে, ওই অনুষ্ঠানে তাঁর দেয়া পুরো বক্তব্যের ভিডিওটি খুঁজে পাওয়া যায়। ভিডিওটির শিরোনাম ও ডেস্ক্রিপশন থেকে জানা যায়, গত ১০ মহররম (ইংরেজি ২৮ জুলাই, ২০২৩) ইরাকের বাগদাদে হুসাইনি আশুরা কাউন্সিল আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সাইয়িদ হাশিম আল-হায়দারির দেয়া বক্তব্যের ভিডিও এটি। ইউটিউব ভিডিওটি দেখুন--
উক্ত ইউটিউব ভিডিওর ১ ঘন্টা ৫ মিনিট ৫৭ সেকেন্ড থেকে ১ ঘন্টা ৭ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড পর্যন্ত বক্তব্য থেকে আকর্ষণীয় অংশ কেটে নিয়ে বাংলা অনুবাদের সাবটাইটেল বসিয়ে 'উসমানীয়া টিভি' ফেসবুক পেজের ১ মিনিটের ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে। আর 'উসমানীয়া টিভি' ফেসবুক পেজের ভিডিওটিকে এডিট করে আলোচ্য বিভ্রান্তিকর দাবির ফেসবুক ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে। আলোচ্য ফেসবুক ভিডিওটির ৪৮ সেকেন্ডে নেয়া স্ক্রিনশট (বামে), 'উসমানীয়া টিভি' ফেসবুক পেজের ভিডিওটি থেকে নেয়া স্ক্রিনশট (ডানে) এবং ইউটিউব ভিডিওটি থেকে নেয়া স্ক্রিনশটের (নিচে) মধ্যে তুলনামূলক সাদৃশ্য দেখুন--
অর্থাৎ ভিডিওতে বক্তব্য দেয়া ব্যক্তি ইরানের সদ্য প্রয়াত প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি নন বরং তাঁর নাম সাইয়িদ হাশিম আল-হায়দারি।
সাইয়িদ হাশিম আল-হায়দারি কে?
সাইয়িদ হাশিম আল-হায়দারি সম্পর্কে জানতে কি-ওয়ার্ড সার্চ করে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ও নীতি বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়াশিংটন ইন্সটিটিউটের ওয়েবসাইটে ২০২১ সালের ৫ মে "Profile: Ahd Allah Islamic Movement" শিরোনামে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ খুঁজে পাওয়া যায়। তা থেকে জানা যায়, ২০২০ সালের ৩ নভেম্বর হারাকাত আহদ আল্লাহ আল-ইসলামিয়া বা (HAAI) তথা আহদ আল্লাহ ইসলামিক মুভমেন্ট নামের একটি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সাইয়িদ হাশিম আল-হাইদারি। HAAI সংগঠনটি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির নিয়ন্ত্রণে ও নেতৃত্বে পরিচালিত হওয়ার তথ্য রয়েছে। HAAI প্রতিষ্ঠা করার আগে ২০১৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ইরাকভিত্তিক কাতাইব হিজবুল্লাহ'র সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন হায়দারি। তিনি লেবাননের হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহর ঘনিষ্ঠ বলেও এতে উল্লেখ করা হয়। অর্থাৎ সাইয়িদ হাশিম আল-হায়দারি ইরাকের একজন শিয়া মুসলিম নেতা। স্ক্রিনশট দেখুন--
অর্থাৎ আলোচ্য ভিডিওটি ইরানের সদ্যপ্রয়াত প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি নন বরং তিনি ইরাক ভিত্তিক একটি শিয়া সংগঠনের নেতা সাইয়িদ হাশিম আল-হায়দারি।
সুতরাং ইরাকের এক শিয়া নেতার বক্তব্যের ভিডিও প্রচার করে এটি ইরানের সদ্যপ্রয়াত প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির বক্তব্যের ভিডিও বলে প্রচার করা হচ্ছে, যা বিভ্রান্তিকর।