৬৫ ঘন্টায় ৭২ জন ধর্ষণের শিকার হওয়ার তথ্যটি ভিত্তিহীন
বুম বাংলাদেশ দেখেছে, ২০ থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি সবধরণের গ্রহণযোগ্য মাধ্যমের খবর অনুযায়ী দেশে প্রায় ৮টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে গত ৬৫ ঘন্টায় ৭২ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এছাড়াও কিছু ফেসবুক ব্যবহারকারী ৭২ জনের স্থলে ৭৪ কিংবা ৭৪ জনেরও বেশি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে পোস্ট করেছেন। এরকম কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে ও এখানে।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ‘Anupam Fakir’ নামক ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে এরকম একটি তথ্য পোস্ট করা হয়। পোস্টটিতে দৈনিক জনকণ্ঠের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে "গত ৬৫ ঘন্টায় ৭২ ধর্ষণ বিস্তারিত কমেন্টে" শীর্ষক সংবাদের পোস্টের স্ক্রিনশট যুক্ত করা হয়েছে। পোস্টটির স্ক্রিনশট দেখুন--
ফ্যাক্ট চেক:
বুম বাংলাদেশ যাচাই করে দেখেছে, আলোচ্য পোস্টের দাবিটি বিভ্রান্তিকর। গত ২০ থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি সময়কালে গণমাধ্যম সহ সব ধরণের গ্রহণযোগ্য মাধ্যমের খবর অনুযায়ী ৮টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর বাইরে যে সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে তার কোনো প্রমাণ কোথাও দেওয়া হয়নি এবং গ্রহণযোগ্য কোনো মাধ্যমে খুঁজেও পাওয়া যায়নি।
ফেসবুকে প্রচারিত জনকণ্ঠের পোস্টটি এবং তাদের অনলাইন প্রতিবেদনটি সরিয়ে নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছে। মূল প্রতিবেদনটি সরিয়ে নেওয়া হলেও গণমাধ্যমটির অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত আলোচ্য তথ্য সংক্রান্ত "গত ৬৫ ঘন্টায় ৭২ ধর্ষণ" শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনের একটি আর্কাইভ কপি পাওয়া গেছে। আর্কাইভ কপি থেকে দেখা যায় সংবাদটির তথ্যসূত্র হিসেবে তারা একটি ফেসবুক পোস্টের লিংক উল্লেখ করেছে। যদিও লিংকটি এখন অকার্যকর তথা উক্ত পোস্টটিও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
হুবহু একই কি-ওয়ার্ড (বাক্য) ব্যবহার করে "৬৫ ঘন্টায় ৭২ ধর্ষণ" দাবিটি ২৩ ফেব্রুয়ারির আগে পাওয়া যায়নি। সেক্ষেত্রে এই দাবিটিতে ২১, ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যকার তথ্য নির্দেশনা করা হয়েছে।
জনকণ্ঠের প্রতিবেদনটিতে সারাদেশের এ সংক্রান্ত ৮ টি খবরের কথা উল্লেখ করা হয়। খবরগুলো হলো, সিংগাইরে দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীকে বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ (গতবছরের আগস্টের ঘটনা), অটোরিকশা থেকে নামিয়ে গৃহবধূকে দলবদ্ধ ধর্ষণ (৬ ফেব্রুয়ারির ঘটনা), অবকাশ কেন্দ্রে বেড়াতে গিয়ে ধ'র্ষণের শিকার মাদ্রাসাছাত্রী (১৪ ফেব্রুয়ারির ঘটনা)।
এছাড়াও আরো উল্লেখ করা হয়েছে- চলন্ত বাসে ডাকাতি-ধর্ষণ (১৭ ফেব্রুয়ারির ঘটনা যদিও বিষয়টি নিয়ে দুই ধরণের মন্তব্য পাওয়া যাচ্ছে), শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে ফুল আনতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী (২১শে ফেব্রুয়ারির ঘটনা), স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া মেটানোর আশ্বাস দিয়ে নারীকে ধর্ষণ- ভিডিও ধারণ (গত বছরের ১১ নভেম্বরের ঘটনা), ট্রলারে মাওয়া ঘাট পার হতে গিয়ে গৃহবধূ সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার (১৭ ফেব্রুয়ারির ঘটনা), বাবা কর্তৃক ধর্ষণের শিকার (এর আগেও ধর্ষনের শিকার হলেও গত ১৯ ফেব্রুয়ারি পুনরায় একই কাজ করতে গিয়ে এলাকাবাসীর কাছে আটক হন)। আর্কাইভ কপির স্ক্রিনশট দেখুন--
দেখা যাচ্ছে, প্রতিবেদনে উল্লিখিত খবরগুলোর (৮ টি) কেবল একটি ঘটনা আলোচ্য সময়ের মধ্যকার (২১শে ফেব্রুয়ারি সহ গণনা করলে)। বাকিগুলো অল্প অথবা বেশ পুরোনো ঘটনা। এছাড়াও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে ঘটনাগুলো ঘটেছে বলে দাবি করা হলেও দুইটি ঘটনা ছিল ব্যক্তিগত পর্যায়ের সম্পর্কের সাথে সম্পর্কিত।
এছাড়াও বিভিন্নভাবে অনুসন্ধান করে আলোচ্য সময়ে ধর্ষণের ঘটনার কোনো পরিসংখ্যান গণমাধ্যম কিংবা এনজিও রিপোর্ট সহ গ্রহণযোগ্য কোনো মাধ্যমে পাওয়া যায়নি।
গত ২০ থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি কতগুলো ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে?
দেশীয় একটি ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিষ্ঠান গত ২১-২৩ ফেব্রুয়ারি মোট ৮ টি ধর্ষণের ঘটনার খবর ও একটি ধর্ষণচেষ্টার সংবাদ পেয়েছে। এছাড়াও গত ২০ ফেব্রুয়ারি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে এমন খবর পাওয়া যায়নি তবে ১৯ তারিখের ঘটনায় ২০ তারিখে খবর প্রকাশ হয়েছে এমনটা দেখা গেছে।
অর্থাৎ ২০ থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে গণমাধ্যমসূত্রে ৮ টি ধর্ষণের ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। এর বাইরে কিছু খবর থাকতে পারে যা গণমাধ্যমে আসেনি তবে সেই সংখ্যাটা বা তথ্যসূত্র পোস্টকারীদের কেউ প্রমাণ সহ উল্লেখ করেনি।
আরো যেসব দাবি ছড়িয়েছে
দাবিটি নিয়ে সার্চ করে সমজাতীয় আরো দুইটি ভিন্ন ভিন্ন দাবি পাওয়া গেছে সামাজিক মাধ্যমে।
- ৬৫ ঘন্টায় ৭৪ ধর্ষণ
- ৪৮ ঘন্টায় ৫০ ধর্ষণ
- ৪৮ ঘন্টায় ১৭ ধর্ষণ
হুবহু একই কি-ওয়ার্ড (বাক্য) "৬৫ ঘন্টায় ৭৪ ধর্ষণ" ব্যবহার করে দাবিটিও ২৩ ফেব্রুয়ারির আগে পাওয়া যায়নি। সেক্ষেত্রে এই দাবিটিতে ২১, ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যকার তথ্য নির্দেশনা করা হয়েছে। কিন্তু ইতোমধ্যেই দেখা গেছে এই সংখ্যাটির কোনো নির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি এবং দাবিটি বিভ্রান্তিকর।
এছড়াও "৪৮ ঘন্টায় ৫০ ধর্ষণ" এবং "৪৮ ঘন্টায় ১৭ ধর্ষণ" দাবি দুইটি ২২ ফেব্রুয়ারির আগে পাওয়া যায়নি। সেক্ষেত্রে এই দাবি দুইটিতেও ২০, ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারির মধ্যকার তথ্য নির্দেশনা করা হয়েছে।
কিন্তু এই সময়ের মধ্যে গণমাধ্যমসূত্রে ৮টি ধর্ষণের খবর পাওয়া গেছে। যদিও বিভিন্ন পোস্টে দেখা গেছে পুরোনো পোস্ট সম্পাদনা করে ধর্ষণ সংক্রান্ত আলোচ্য তথ্যগুলোতে সময়-তারিখ ও সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করা হয়েছে। এরকম একটি পোস্টের স্ক্রিনশট দেখুন--
পোস্টগুলোর একটির সাথে সোর্স (কমেন্টে) হিসেবে বিভিন্ন গণমাধ্যমের এ সংক্রান্ত খবরের ভিডিও প্রতিবেদনের সমন্বিত ভিডিও প্রচার করা হয়েছে। তবে ভিডিওটিতে (৩১ সেকেন্ডে দেখুন) উল্লিখিত খবরের মধ্যে গত ১৬ জানুয়ারির পুরোনো (উল্লিখিত সময়সীমার) খবরের ক্লিপ প্রচার করার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এছাড়াও ভিডিওটিতে গুলি করে হত্যার বেশকিছু ক্লিপও জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও অন্য একটি এজাতীয় পোস্টে সোর্স হিসেবে পুরোনো ঘটনার স্ক্রিনশটের পাশাপাশি ভারতের ধর্ষণের ঘটনার সংবাদের স্ক্রিনশট যুক্ত করতে দেখা গেছে। এজাতীয় আরো কিছু পোস্টে (১, ২, ৩) গত ৬৫ ঘন্টার কথা বলে তার কাছাকাছি কিংবা বেশ পুরোনো সময়ের খবরের লিংক ও স্ক্রিনশট যুক্ত করতে দেখা গেছে। এমনকি গত বছরের খবর, গত বছরের ঘটনা কিন্তু মামলা হয়েছে সম্প্রতি কিংবা কিছুদিন আগের ঘটনা কিন্তু প্রকাশ কিংবা মামলায় দেরি হওয়ায় সংবাদ প্রচার হয়েছে পরে (১৭ তারিখের ঘটনা ২০ তারিখে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে) এমন স্ক্রিনশটগুলোও যুক্ত করে বিভ্রান্তিকর তথ্যসূত্র উল্লেখ করা হয়েছে।
অর্থাৎ ২০-২৩ ফেব্রুয়ারি সময়কালে গণমাধ্যম সহ সব ধরণের গ্রহণযোগ্য মাধ্যমের খবর অনুযায়ী ৮টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর বাইরে যে সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে তার কোনো প্রমাণ কোথাও দেওয়া হয়নি এবং গ্রহণযোগ্য কোনো মাধ্যমে খুঁজেও পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, বুম বাংলাদেশ কেবল ধর্ষণের ঘটনার খবর গণমাধ্যম কিংবা অনলাইনে গ্রহণযোগ্য মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য ও ডাটা থেকে সংগ্রহ করেছে।
সুতরাং সামাজিক মাধ্যমে তথ্য অতিরঞ্জিত করে বিভ্রান্তিকর খবর প্রচার করা হচ্ছে।