প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে বিভিন্ন নামের এই চেকগুলো এডিটেড
বুম বাংলাদেশ দেখেছে, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে শেখ হাসিনা, সায়মা ওয়াজেদ ও ওবায়দুল কাদেরের নামে চেকগুলো এডিটেড।
সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকের একাধিক আইডি থেকে সোনালী ব্যাংকের তিনটি চেক পোস্ট করে দাবি করা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০০ কোটি, তাঁর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ ৫০ কোটি এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিদেশ ভ্রমণের জন্য ৫০ কোটি টাকা নিয়েছেন। এরকম পোস্ট দেখুন এখানে এবং এখানে।
গত ২৮ আগস্ট 'গুপ্তচর গঙ্গোপাধ্যায়' নামের একটি আইডি থেকে সোনালী ব্যাংকের তিনটি চেক পোস্ট করে দাবি করা হয়, "To Whom It May Concern. পিও আওয়ামী শুভাখাঙ্ক্ষীর ছেলেদের জন্য উৎসর্গ কল্লাম।" পোস্ট করা তিনটি চেকের প্রথম ও দ্বিতীয় ছবির ওপরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা এবং সায়মা ওয়াজেদের ছবি যুক্ত করা হয়েছে। ছবির নিচের অংশে লেখা রয়েছে, "পারিবারিক ভাবে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল লুট। হাসিনা হাতিয়ে নিয়েছে ১০০ কোটি টাকা, রেহানা ১০০ কোটি টাকা এবং পুতুল ৫০ কোটি টাকা"। তৃতীয় ছবিতে ওবায়দুল কাদেরের ছবি যুক্ত করে নিচে লেখা রয়েছে, "প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল লুট কাদেরের ভ্রমণ বিলাসে ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ"। নিচে স্ক্রিনশট দেখুন--
ফ্যাক্ট চেক:
বুম বাংলাদেশ যাচাই করে দেখেছে, আলোচ্য পোস্টে চেক তিনটি এডিটেড। করোনাকালীন সময়ে আইনজীবী প্রণোদনা তহবিল থেকে ঢাকা আইনজীবী সমিতিকে দেওয়া সোনালী ব্যাংকের একটি চেক এডিট করে আলোচ্য চেকটি তৈরি করা হয়েছে।
চেকটির উৎস:
রিভার্স ইমেজ সার্চ করে আলোচ্য পোস্টের চেকটির অরিজিনাল ভার্সন বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ওয়েবসাইটে "ঢাকা আইনজীবী সমিতিকে ছয় কোটি সত্তর লক্ষ পনের হাজার আটশত পঁচাত্তর টাকার আইনজীবী প্রণোদনার চেক প্রদানের মাধ্যমে বার কাউন্সিল হতে প্রণোদনা অর্থ বিতরণ শুরু হল" শিরোনামে খুঁজে পাওয়া যায়। চেকটি বাংলাদেশ বার কাউন্সিল হতে আইনজীবীদের করোনাকালে প্রণোদনার অংশ হিসেবে 'আইনজীবী প্রণোদনা তহবিল' নামের একটি একাউন্ট থেকে ঢাকা আইনজীবী সমিতিকে প্রদান করা হয়। স্ক্রিনশট দেখুন--
ওয়েবসাইট থেকে নেয়া চেকের ছবিটি আলাদাভাবে দেখুন--
একইভাবে সার্চ করে বাংলাদেশের আইন বিষয়ক অনলাইন পোর্টাল লইয়ার্সক্লাব বাংলাদেশ (lawyersclubbangladesh.com)-এ "৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা প্রণোদনা পেল ঢাকা বারের আইনজীবীরা" শিরোনামে ২০২২ সালের ২৪ মে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনেও চেকটি খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, "করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত আইনজীবীদের সাহায্যার্থে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে বার কাউন্সিলের আইনজীবী প্রণোদনা তহবিলে দেওয়া ২০ কোটি টাকা আইনজীবীদের মধ্যে বিতরণ শুরু হয়েছে। ঢাকা আইনজীবী সমিতিকে ছয় কোটি সত্তর লক্ষ পনের হাজার আটশত পঁচাত্তর টাকার আইনজীবী প্রণোদনার চেক প্রদানের মাধ্যমে সোমবার (২৩ মে) বার কাউন্সিল হতে প্রণোদনা অর্থ বিতরণ শুরু হয়।"
ভাইরাল হওয়া চেক তিনটির মধ্যে সাদৃশ্য:
পর্যবেক্ষণ করে ফেসবুকে আলোচ্য ভাইরাল হওয়া তিনটি চেকের মধ্যে গ্রহীতার নাম এবং টাকার পরিমাণ ছাড়া চেকের অন্যান্য অংশের হুবহু মিল পাওয়া গেছে। চেক তিনটিতে দেখা যায়, শেখ হাসিনার নামে ১০০ কোটি টাকা, সায়মা ওয়াজেদের নামে ৫০ কোটি টাকা এবং ওবায়দুল কাদেরের নামে ৫০ কোটি টাকা লেখা হয়েছে। এছাড়া, চেকের নম্বর, স্বাক্ষর, চেকের নিচে ম্যাগনেটিক ইংক ক্যারেক্টার রিকগনিশন বা MICR কোড, একাউন্ট নম্বরের হুবহু মিল পাওয়া গেছে। স্ক্রিনশট দেখুন--
বার কাউন্সিলের ওয়েবসাইটের চেক এবং ভাইরাল হওয়া চেকগুলোর মধ্যে সাদৃশ্য:
চেক তিনটির মধ্যে নাম এবং টাকার অংক ছাড়া অন্যসব বিষয়গুলো মিল থাকায় প্রতিটি চেকের সঙ্গে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ওয়েবসাইট ও লইয়ার্সক্লাব বাংলাদেশের প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত চেকের মধ্যে অন্তত দুটি স্থানে হুবহু মিল রয়েছে। চেকটি দুটি স্বাক্ষর (১) এবং চেকের নিচে ম্যাগনেটিক ইংক ক্যারেক্টার রিকগনিশন বা MICR কোড (২) যেখানে বিশেষায়িত প্রযুক্তিতে চেক নম্বর, রাউটিং নম্বর ও সংশ্লিষ্ট একাউন্ট নম্বর পাশাপাশি একটু স্পেস দিয়ে উল্লেখ থাকে তাতে হুবহু মিল রয়েছে। অরিজিনাল চেকটি (উপরে) ও ভাইরাল চেকগুলোর (নিচে) মধ্যে তুলনামূলক মিল দেখুন--
বার কাউন্সিলের ওয়েবসাইটের চেক এবং ভাইরাল হওয়া চেকগুলোর মধ্যে বৈসাদৃশ্য:
বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ওয়েবসাইট ও লইয়ার্সক্লাব বাংলাদেশের প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত চেক এবং ফেসবুকে আলোচ্য ভাইরাল হওয়ায চেক বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল থেকে ঢাকা আইনজীবী সমিতিকে দেয়া চেকটির অন্তত দশটি স্থানে এডিট করে ফেসবুকে শেখ হাসিনা, সায়মা ওয়াজেদ ও ওবায়দুল কাদেরের নামে ভাইরাল চেকটি তৈরি করা হয়েছে। সোনালী ব্যাংকের উক্ত চেকটির শাখার নাম (১), চেক নম্বর (২), ইস্যু তারিখ (৩), রাউটিং নম্বর (৪), প্রাপকের নাম (৫), টাকার পরিমাণ কথায় (৬), টাকার পরিমাণ অংকে (৭), একাউন্টের নাম (৮), একাউন্ট নম্বর (৯) ও দুটি স্বাক্ষরের নীচে দেওয়া সীল (১০), এই দশটি স্থানে এডিট করে পরিবর্তন করা হয়েছে। চেকটি কোথায় কোথায় এডিট করে কী কী পরিবর্তন আনা হয়েছে তা বুঝতে নিচে দেয়া দুটি চেকের মধ্যে তুলনা দেখুন (উপরের চেকটি অরিজিনাল ও নিচের চেকটি এডিটেড)--
আলোচ্য চেকের মধ্যে অসঙ্গতি:
এবারে বুম বাংলাদেশের বিশ্লেষণে ভাইরাল হওয়া চেকগুলোর মধ্যে কয়েকটি অসঙ্গতিও ধরা পড়েছে। ব্যাংকের চেকে চেক নম্বর, রাউটিং নম্বর ও একাউন্ট নম্বর ভিন্ন ভিন্ন স্থানে উল্লেখ থাকে এবং চেকের নিচে ম্যাগনেটিক ইংক ক্যারেক্টার রিকগনিশন বা MICR কোডে বিশেষায়িত প্রযুক্তিতে এই তিনটি নম্বর পাশাপাশি একটু স্পেস দিয়ে পুনরায় উল্লেখ থাকে। এখানে দেখা যাচ্ছে, চেক নম্বর, রাউটিং নম্বর ও একাউন্ট নম্বর তিনটিই ভিন্ন। অর্থাৎ উপরে পৃথকভাবে লেখা চেক নম্বর, রাউটিং নম্বর ও একাউন্ট নম্বরটি এডিট করা হয়েছে। দেখুন--
এদিকে আলোচ্য চেকের তথ্য অনুযায়ী চেকটি সোনালী ব্যাংকের তেজগাঁও ব্রাঞ্চের। কি-ওয়ার্ড সার্চ করে সোনালী ব্যাংকের 'তেজগাঁও ব্রাঞ্চ' নামের কোনো ব্রাঞ্চের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তবে 'তেজগাঁও ইডাস্ট্রিয়াল এরিয়া ব্রাঞ্চ' নামে সোনালী ব্যাংকের একটি ব্রাঞ্চ রয়েছে। ব্যাংকবিডি ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী ব্রাঞ্চটির রাউটিং নম্বর 200264512 যদিও চেকের মধ্যে রাউটিং নম্বর উল্লেখ করা 200276678. এছাড়া, ভাইরাল চেকে উল্লেখিত এই রাউটিং নম্বরের সাথে মিল রয়েছে সোনালী ব্যাংকের কোনো ব্রাঞ্চ খুঁজে পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ রাউটিং নম্বরটি বানোয়াট। স্ক্রিনশট দেখুন--
অর্থাৎ কারোনাকালে আইনজীবী প্রণোদনা তহবিল নামের সোনালী ব্যাংকের একটি একাউন্ট থেকে ঢাকা আইনজীবী সমিতির নামে ইস্যু করা একটি চেক এডিট করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে টাকা আত্মসাৎ করছেন বলে প্রচার করা হচ্ছে।
সুতরাং একটি এডিটেড চেক জুড়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে শেখ হাসিনা, সায়মা ওয়াজেদ ও ওবায়দুল কাদের টাকা আত্মসাৎ করছেন বলে যে দাবি করা হচ্ছে ফেসবুকে, তা ভিত্তিহীন ও বিভ্রান্তিকর।