শেখ হাসিনার পুরোনো সাক্ষাৎকারের ভিডিওকে এডিট করে প্রচার
বুম বাংলাদেশ দেখেছে, বিবিসিকে দেয়া শেখ হাসিনার পুরোনো সাক্ষাৎকারকে প্রযুক্তির সহায়তায় এডিট করে ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছাত্র-জনতার তীব্র বিক্ষোভের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে ভারতের পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনার একটি ভিডিও পোস্ট করা হচ্ছে, যেখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যাচ্ছে তিনি আয়নাঘর তৈরি করেছেন। এরকম কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে ও এখানে।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ফেসবুকের একটি গ্রুপে ‘ياسين الإسلام نوين’ নামক একটি অ্যাকাউন্ট থেকে ভিডিওটি পোস্ট করা হয়। পোস্টে উল্লেখ করা হয়, “হাসিনার স্বীকারোক্তি—কীভাবে আয়নাঘর তৈরি হলো, কীভাবে নির্যাতন ও ভয়ের মাধ্যমে আয়নাঘরে দিনের পর দিন আটকে রাখা হয়। এমন করে একদিন টুক করে জেলে আসবে আপা।” পোস্টটির স্ক্রিনশট দেখুন--
ভিডিওতে শেখ হাসিনাকে বলতে দেখা যায়, 'আয়নাঘরের বুদ্ধি তারেক সিদ্দিকী দিয়েছেন। ক্রসফায়ারে লোক জানাজানি ও সমালোচনা বেশি হওয়ায় আয়নাঘরের পরীক্ষামূলক পরিকল্পনা করা হয়৷ তিন ফুট বাই তিন ফুট ঘর বানিয়ে প্রথমে বিরোধী দলীয় নেতা ও সাংবাদিকদের তুলে আনা হয়।' এছাড়াও ভিডিওটিতে একই বিষয়ে আরো কিছু মন্তব্য করতে শোনা যায়।
ফ্যাক্ট চেক:
বুম বাংলাদেশ যাচাই করে দেখেছে, আলোচ্য পোস্টের দাবিটি সঠিক নয়। প্রচারিত ভিডিওতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে ২০১৯ সালে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া শেখ হাসিনার একটি সাক্ষাতকারের ভিডিও সহ অডিও ক্লোন (নকল) তৈরি করে যুক্ত করা হয়েছে।
এই বিষয়ে সার্চ করে মূলধারার গণমাধ্যম সহ গ্রহণযোগ্য কোনো মাধ্যমেই শেখ হাসিনা কর্তৃক আলোচ্য মন্তব্য সংশ্লিষ্ট কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি। এছাড়াও এই সংক্রান্ত পোস্টগুলোতেও খুঁজে এই মন্তব্যটি কবে, কখন করা হয়েছে সে বিষয়ে বিস্তারিত কোনো তথ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়নি।
আলোচ্য ভিডিওটি থেকে কি-ফ্রেম নিয়ে ছবিগুলো রিভার্স ইমেজ সার্চ এর মাধ্যমে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ‘বিবিসি’-এর বাংলা সংস্করণের ইউটিউব চ্যানেল ২০১৯ সালের ০৬ আগস্ট “শেখ হাসিনা: নির্বাচন, গণতন্ত্র, মানবাধিকারসহ সাম্প্রতিক ইস্যু নিয়ে বিবিসির মুখোমুখি প্রধানমন্ত্রী” শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। ভিডিওটির প্রিভিউ দেখুন--
আলোচ্য ভিডিওর সাথে বিবিসি বাংলার ভিডিওর দৃশ্য, শেখ হাসিনার পোশাক এবং ভিডিওতে উপস্থাপনায় থাকা ভিন্ন নারীর (বিবিসির সাংবাদিক মানসী বড়ুয়া) দৃশ্য সহ সংশ্লিষ্ট সবকিছুর মিল পাওয়া যায়। তবে প্রচারিত দাবির মতো আয়নাঘর সংক্রান্ত হুবহু কোনো মন্তব্য বিবিসি বাংলার ২২ মিনিটের সাক্ষাৎকারের ভিডিওটিতে পাওয়া যায়নি। ফেসবুকে প্রচারিত ভিডিও (বামে) ও বিবিসি বাংলার ইউটিউবে পাওয়া ভিডিওর স্ক্রিনশটের (ডানে) তুলনা দেখুন--
অর্থাৎ ফেসবুকে প্রচারিত ভিডিওর দৃশ্য ২০১৯ সালে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি ভিডিও থেকে তৈরি করা হয়েছে।
পাশাপাশি, ইউটিউবে ‘RTNews24 BD’ নামক একটি চ্যানেলে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি আলোচ্য ভিডিওটির সম্ভাব্য প্রথম দিকের প্রচারণার পোস্ট পাওয়া গেলেও বিস্তারিত অংশে ভিডিওটি সম্পাদনার মাধ্যমে তৈরি সংক্রান্ত একটি সতর্কতার তথ্য উল্লেখ করা হয়।
যদিও একই চ্যানেলের সাথে সংশ্লিষ্ট ফেসবুক পেজে ভিডিওটি প্রচারের সময়ে সতর্কতামূলক কোনো তথ্য উল্লেখ করা হয়নি। ইউটিউব ভিডিওটির স্ক্রিনশট দেখুন--
অর্থাৎ এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, ভিডিওটি তৈরিতে প্রযুক্তিগত উপায় ব্যবহার করা হয়েছে।
বিষয়টির সত্যতা পাওয়া যায় ভিডিওতেও। ভিডিওতে শেখ হাসিনার কথোপকথনের সময়ে মুখভঙ্গির সাথে কথার অমিল, অস্বাভাবিক মুখভঙ্গি লক্ষ্য করা গেছে। সাধারণত এআই তথা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দ্বারা তৈরি ভিডিওতে এরকম অমিল পাওয়া যায়।
সাধারণ কিছু প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভিডিও থেকে সম্পাদনা করে নতুন ভিডিও তৈরি করা গেলেও পূর্ববর্তী কোনো অডিও (মডেল) থেকে কারো ভয়েস ক্লোন (একই ভয়েসে শব্দ-বাক্য তৈরি) করার ক্ষেত্রে এআই প্রযুক্তি অনেকটাই কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
যেহেতু আয়নাঘর সংক্রান্ত কোনো শব্দ মূল ভিডিওতে নেই সেহেতু ধরণা করা যায় প্রচারিত ভিডিওতে অডিও ক্লোন (নকল) করে যুক্ত করা হয়েছে। এই বিষয়টিকে ডিপফেক প্রযুক্তি এবং এভাবে তৈরি কন্টেন্টকে ডিপফেক কন্টেন্টও বলা হয়।
আলোচ্য ভিডিওটি ডিপফেক এনালাইসিস ইউনিটকে পাঠানো হলে তারা বিভিন্ন টুল এবং এআই কন্টেন্ট বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে নিশ্চিত করেছে যে, ভিডিওটি (অডিও সহ) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে সম্পাদনা করা হয়েছে। এতে ভয়েস ক্লোন ওভারলে এবং তার ঠোঁটের নড়াচড়ার সাথে মিল রেখে একটি লিপ-সিঙ্ক যুক্ত করে ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে।
তারা আরও জানিয়েছেন, অডিও বিশ্লেষণে ভিডিওটির অডিও ক্লিপটি বাস্তব হওয়ার সম্ভাবনা এক শতাংশ বলে পাওয়া গেছে, যা এটিকে অধিকতর সম্ভাব্য ভয়েস ক্লোন হওয়ার বিষয়ে নির্দেশ করে। ভিডিও বিশ্লেষণে ভিডিওটি বাস্তব হওয়ার সম্ভাবনা ৩১ শতাংশ বলে পাওয়া গেছে, যা এটিকে এআই ব্যবহার করে পরিবর্তন/সম্পাদনা করার মাঝামাঝি সম্ভাবনা নির্দেশ করে। কনট্রেইলস এআই-এর বিশেষজ্ঞরা ডিএইউ-কে জানিয়েছে যে "অডিও বন্ধ (কথার মধ্যকার সময়ের থামা) থাকাকালীন ঠোঁটের কাছে স্পষ্ট দৃশ্যমান ম্যানিপুলেশন আর্টিফ্যাক্টগুলিও অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে।
সুতরাং সামাজিক মাধ্যমে শেখ হাসিনার পুরোনো একটি সাক্ষাতকারের ভিডিও থেকে দৃশ্য নিয়ে ডিপফেক প্রযুক্তিতে সম্পাদনার মাধ্যমে তৈরি করা ভিডিও বিভ্রান্তিকর দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে।
Editor’s Note: আলোচ্য ভিডিওটি ডিপফেক এনালাইসিস ইউনিটকে পাঠানো হলে, সেখান থেকে প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী উক্ত প্রতিবেদনটি ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে প্রয়োজনীয় আপডেট করা হয়েছে।