সম্প্রতি বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলেনি কানাডার আদালত
রায়ে আদালত বলেছে, বিএনপি সন্ত্রাসবাদে যুক্ত বিশ্বাস করার মত কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পায়নি কানাডার ইমিগ্রেশন বিভাগ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের একাধিক পেজ ও আইডি থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরের লিংক শেয়ার করে দাবি করা হচ্ছে, কানাডার আদালত বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপিকে পঞ্চমবারের মতো সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে অভিহিত করেছে। এরকম কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
গত ৩১ জুলাই মূলধারার গণমাধ্যম কালের কণ্ঠের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ 'Kaler Kantho' থেকে একটি খবরের লিংক শেয়ার করে দাবি করা হয়, "এ নিয়ে কানাডার আদালতে পঞ্চমবারের মতো বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করা হলো।" খবরটির শিরোনাম, "বিএনপিকে আবারো সন্ত্রাসী সংগঠন বলল আদালত"। পোস্টটির স্ক্রিনশর্ট দেখুন--
কালের কণ্ঠ ছাড়াও বাংলাদেশের আরো বেশ কয়েকটি মূলধারার গণমাধ্যমে খবরটি প্রকাশিত হতে দেখা যায়। এসব প্রতিবেদনের আর্কাইভ লিংক দেখুন--
বাংলানিউজ: বিএনপিকে ফের সন্ত্রাসী সংগঠন আখ্যা কানাডার আদালতের
যুগান্তর: নাশকতা করে সরকার উৎখাত করতে চেয়েছিল বিএনপি: কানাডার আদালত
কালের কণ্ঠ: বিএনপিকে আবারও সন্ত্রাসী সংগঠন বললেন কানাডার আদালত
নিউজবাংলা: বিএনপিকে পঞ্চমবারের মতো সন্ত্রাসী সংগঠন বলল কানাডার আদালত
সারাবাংলা: বিএনপি সন্ত্রাসী সংগঠন, রিভিউ আদেশেও কানাডার ফেডারেল কোর্ট
আজকের পত্রিকা: বিএনপিকে ফের 'সন্ত্রাসী সংগঠন' বললেন কানাডার একটি আদালত
দেশ রুপান্তর: কানাডার আদালতে আবারও বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন আখ্যা
দৈনিক বাংলা: বিএনপিকে আবারও সন্ত্রাসী সংগঠন বলল কানাডার আদালত
একাত্তর টিভি অনলাইন: বিএনপিকে আবারো সন্ত্রাসী সংগঠন বললো কানাডার
বাংলা ট্রিবিউন: বিএনপিকে আবারও সন্ত্রাসী সংগঠন বললো কানাডার আদালত
সমকাল: বিএনপিকে কানাডার আদালতে আবারও সন্ত্রাসী সংগঠন আখ্যা
প্রতিদিনের বাংলাদেশ: বিএনপিকে আবারও সন্ত্রাসী সংগঠন বললেন কানাডার আদালত
প্রতিবেদনগুলোতে দাবি করা হয়, কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে মোহাম্মদ জিপসেদ ইবনে হক নামে বিএনপির এক কর্মীর করা আবেদন গত ১৫ জুন বাতিল করে দেয়, টরোন্টোর একটি আদালত। কারণ হিসেবে আদালত বলেছে, বিএনপি বল প্রয়োগ এবং সন্ত্রাসের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাতের চেষ্টা করছে। মামলার রায়ে বিচারক বিএনপিকে পঞ্চমবারের মতো সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে অভিহিত করেন এবং সন্ত্রাসী দলের সদস্য হওয়ায় বিএনপির ওই কর্মীর রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন বাতিল করে দেয় কানাডার আদালত।
ফ্যাক্ট চেক:
বুম বাংলাদেশ যাচাই করে দেখেছে, বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রচারিত খবরটি ভিত্তিহীন। গত ১৫ জুন প্রকাশিত কানাডার ফেডারেল কোর্টের রায় পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কানাডার আদালত বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে অভিহিত করেনি। বরং রায়ে বলা হয়েছে, বিএনপি সন্ত্রাসবাদের সাথে যুক্ত বিশ্বাস করার মতো কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পায়নি দেশটির ইমিগ্রেশন বিভাগ।
কি-ওয়ার্ড সার্চ করে কানাডার ফেডারেল কোর্টের ওয়েবসাইটে গত ১৫ জুন প্রকাশিত বাংলাদেশের বিএনপি কর্মী মোহাম্মদ জিপসেদ ইবনে হক ও দ্য মিনিস্টার অব পাবলিক সেফটি অ্যান্ড ইমার্জেন্সি প্রিপেয়ার্ডনেস এর মধ্যকার মামলার রায়ের কপিটি খুঁজে পাওয়া যায়। ২৬ পৃষ্ঠার রায়ের প্রথম পৃষ্ঠার স্ক্রিনশট দেখুন--
২৬ পৃষ্ঠার রায় পর্যালোচনা করে দেখা যায়, রায়ের [3] এবং [15] প্যারাগ্রাফে BNP (বিএনপি) এবং terrorism (সন্ত্রাসবাদ) শব্দের উল্লেখ রয়েছে। তবে ওই দুটি প্যারাগ্রাফে বিএনপি সন্ত্রাসী সংগঠন বা বিএনপি সন্ত্রাসবাদে যুক্ত এমন কোনো বক্তব্য উপস্থাপন করেনি কানাডার আদালত বরং ভিন্ন কথা বলেছে।
রায়ের [3] নং প্যারাগ্রাফে বলা হয়, From 2011 to 2015, the applicant was a member of the Bangladesh National Party (the “BNP”). The ID found reasonable grounds to believe the BNP was an organization that had engaged in or instigated the subversion by force of the Awami League government in Bangladesh. The ID did not find reasonable grounds to believe that the BNP was an organization that had engaged in terrorism. অর্থ্যাৎ ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত, আবেদনকারী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সদস্য ছিলেন। কানাডার ইমিগ্রেশন বিভাগ (ID) বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পেয়েছে যে, বিএনপি এমন একটি সংগঠন যা বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে উৎখাতে উস্কানি দিয়েছিল বা জড়িত ছিল। তবে বিএনপি সন্ত্রাসবাদে জড়িত সংগঠন বলে বিশ্বাস করার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পায়নি ইমিগ্রেশন বিভাগ (ID)। নিচে রায়ের [3] নং প্যারাগ্রাফের স্ক্রিনশর্ট দেখুন--
রায়ের [15] নং প্যারাগ্রাফে বলা হয়, In addition, the Minister has not challenged the ID’s conclusion that the applicant was not a member of an organization for which there are reasonable grounds to believe engaged in terrorism under paragraphs 34(1)(f) and (c). (উপরন্তু, মিনিস্টার (বিবাদী পক্ষ বা রাষ্ট্রপক্ষ) ইমিগ্রেশন বিভাগের এমন সামগ্রিক বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করেনি যেখানে বলা হয়েছে, ইমিগ্রেশন ও শরনার্থী সুরক্ষা আইনের ৩৪ ধারার (f) এবং (c) উপধারার অধীনে আবেদনকারী এমন কোনো সংগঠনের সদস্য ছিলেন না যা সন্ত্রাসবাদে জড়িত বলে বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। [15] নং প্যারাগ্রাফের স্ক্রিনশর্ট দেখুন--
অর্থাৎ কানাডার আদালত বলেছে, বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে উৎখাত করতে বিএনপি উস্কানি দিয়েছিল বা জড়িত ছিল বলে বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পেয়েছে দেশটির ইমিগ্রেশন বিভাগ (ID)। তবে বিএনপি কোনো সন্ত্রাসবাদে লিপ্ত ছিল এটা বিশ্বাস করার মত কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। এছাড়া, আবেদনকারী (বিএনপি কর্মী) যে সংগঠনের (বিএনপি) সাথে জড়িত ছিল তা সন্ত্রাসবাদে লিপ্ত ছিল না বলে ইমিগ্রেশন বিভাগের দেয়া এমন বক্তব্যকেও চ্যালেঞ্জ করেনি ওই মামলার বিবাদীপক্ষ বা রাষ্ট্রপক্ষ (মিনিস্টার)।
এদিকে, কেনো বাদী মোহাম্মদ জিপসেদ ইবনে হকের আবেদন খারিজ করে দেয়া হয়েছে তা রায়ের [2] নং প্যারাগ্রাফে স্পষ্ট বলা হয়েছে। The ID concluded that the applicant was inadmissible to Canada on security grounds under paragraph 34(1)(f) of the Immigration and Refugee Protection Act, S.C. 2001, c 27 (the “IRPA”) because he was a member of an organization that there were reasonable grounds to believe engages, has engaged or will engage in acts referred to in IRPA paragraph 34(1)(b), namely, engaging in or instigating the “subversion by force of any government”. অর্থাৎ ইমিগ্রেশন বিভাগ এই উপসংহারে পৌঁছেছে যে আবেদনকারী কানাডার ইমিগ্রেশন ও শরনার্থী সুরক্ষা আইনের ৩৪ ধারার (১) (f) উপধারার অধীনে নিরাপত্তাজনিত কারণে কানাডায় আশ্রয় পাবার যোগ্য নন, কারণ তিনি এমন একটি সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন, যে সংগঠনটি একই আইনের ৩৪ ধারার (১) (b) উপধারায় উল্লেখিত কোন সরকারকে জোরপূর্বক উৎখাতে (subversion by force of any government) উস্কানি দিয়েছিল বা জড়িত ছিল বলে বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। দেখুন--
আবার [26] নং প্যারাগ্রাফে ওই আইনের "subversion by force" শব্দটির ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্যে। এতে বলা হয়েছে, ইমিগ্রেশন বিভাগের শুনানীতে রাষ্ট্রপক্ষ বলেছে, ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত আওয়ামীলীগ সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে সহিংস হরতাল ও বিক্ষোভ আহ্বানের মাধ্যমে "subversion by force"-এ জড়িত ছিল বিএনপি। আর আবেদনকারী ওই সময়ে বিএনপির সদস্য ছিল। এর বিপরীতে আবেদনকারী (বাদী) বলেছে, বিএনপি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের তত্ত্বাবধান এবং নির্বাচনী জালিয়াতি বন্ধে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। আবেদনকারীর যুক্তি ছিল, সরকার ব্যবস্থাকে উৎখাত করতে চায়নি বিএনপি বরং নির্বাচনী ব্যবস্থার মধ্যে থেকেই আওয়ামী লীগকে নতুন নির্বাচনে বাধ্য করতে চেয়েছিল। দেখুন--
অর্থাৎ কানাডার ইমিগ্রেশন ও শরনার্থী সুরক্ষা আইনের ৩৪ ধারার (১)(b) উপধারার (engaging in or instigating the “subversion by force of any government”.) অধীনে জিপসেদ ইবনে হকের রাজনৈতিক আশ্রয় আবেদন খারিজ হয়ে যায়। আর রায়ের [15] নং প্যারাগ্রাফে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ইমিগ্রেশন বিভাগ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, আলোচ্য আইনের ৩৪ ধারার (১) এর (f) এবং (c) উপধারার অধীনে আবেদনকারী কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন না এবং এই বক্তব্যকে রাষ্ট্রপক্ষও (মিনিস্টার) মেনে নিয়েছে। পাঠকের স্বার্থে ইমিগ্রেশন ও শরনার্থী সুরক্ষা আইনের ৩৪ নং ধারার পুরো স্ক্রিনশট তুলে ধরা হলো--
এখানে ৩৪ ধারার (১) এর (f) উপধারাটি উপরের এক বা একাধিক ক্ষেত্র বোঝানোর জন্য উল্লেখিত হয়েছে, তবে এই মামলার পুরো রায় পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে বাদীর আবেদন খারিজ করে দেয়ার কারণ হিসেবে কেবল (b) উপধারাকেই আমলে নেয়া হয়েছে। আর (c) উপধারাকে রায়ের [15] নং প্যারাগ্রাফে সম্পূর্ণ নাকচ করে দেয়া হয়েছে। সুতরাং এই রায়ে বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন বা সন্ত্রাসবাদের সাথে যুক্ত সংগঠন বলেছে কানাডার আদালত এমন কোনো তথ্য-প্রমাণ খুঁজে পায়নি বুম বাংলাদেশ।
অন্যদিকে, বিএনপিকে পঞ্চমবারের মতো সন্ত্রাসী সংগঠন বললো কানাডার আদালত, এমন খবর গণমাধ্যমে প্রচারিত হলে সামাজিক মাধ্যমে এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। এর প্রেক্ষিতে গত ১ আগস্ট বাংলাদেশের ট্যাবলয়েড পত্রিকা দৈনিক মানবজমিনের অনলাইন ভার্সনে "বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলেনি কানাডার আদালত" শিরোনামে একটি সংবাদ খুঁজে পাওয়া যায়। দেখুন সংবাদটির স্ক্রিনশট--
প্রসঙ্গত, কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেন মোহাম্মদ জিপসেদ ইবনে হক নামের এক ব্যক্তি, যিনি এক সময়ে বিএনপির কর্মী ছিলেন। গত ১৫ জুন কানাডার টরেন্টোর একটি আদালত এই আবেদন খারিজ করে দেয়। রায়ে বলা হয়, আবেদনকারী বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগঠন বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত যুক্ত ছিলেন। তিনি ২০১৩ সালের আগস্টে স্টাডি পারমিট নিয়ে কানাডায় যান এবং ২০১৫ সালে ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার কিছুদিন আগে বাংলাদেশে আসেন এবং কানাডায় পুনরায় প্রবেশ করেন। এরপর স্টাডি পারমিট সংক্রান্ত জালিয়াতির অভিযোগে CBSA (কানাডিয়ান বর্ডার সার্ভিস এজেন্সি) এর প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। ২০১৮ সালের ২ মার্চ কানাডায় শরণার্থী হিসেবে অবস্থান করার চেষ্টা চালালে, তাকে CBSA (কানাডিয়ান বর্ডার সার্ভিস এজেন্সি)-তে রেফার করা হয়। সেখানে সেদিনই তিনি গ্রেফতার হন এবং এর তিনদিন পর ৫ মার্চ মুক্তি পান। একই মাসের ২৩ তারিখে তিনি শরণার্থী সুরক্ষার জন্য আবেদন করেন।
অর্থাৎ সম্প্রতি কানাডার আদালত বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে অভিহিত করেনি।
সুতরাং কানাডার আদালতের একটি রায়ের বরাতে বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে বলে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে ও ফেসবুকে যে খবর প্রচারিত হচ্ছে, তা ভিত্তিহীন ও বিভ্রান্তিকর।
Editor's Note: প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর ৪ জুলাই এটি সামান্য পরিমার্জনসহ প্রয়োজনীয় আপডেট করা হয়েছে।