ছবির ছেলেটি জুলাই আন্দোলনে শহিদ হয়েছেন এমন দাবি করা হয়নি
বুম বাংলাদেশ দেখেছে, ছবির ব্যক্তির নাম অহিদুজ্জামান সাকিব, ভিত্তিহীন দাবিতে তার বিয়ের ছবিটি প্রচার করা হচ্ছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দুইটি ছবির কোলাজ পোস্ট করে বলা হচ্ছে, ছবির ব্যক্তি জুলাই আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন বলে এতদিন প্রচার করা হয়েছিল এখন সাত মাস পরে তিনি ফিরে এসেছেন। এরকম কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে ও এখানে।
গত ১৯শে মার্চ ‘নূরুল আজিম রনি’ নামক পেজ থেকে কোলাজ ছবিটি পোস্ট করা হয়। পোস্টে উল্লেখ করা হয়, “ছেলেটি জুলাই প্রতারণার আন্দোলনে শহীদ হয়েছিল। শহীদ বাবদ পাওয়া ৫ লক্ষ টাকা নিয়ে দীর্ঘ ৭ মাস পর ফিরে এসে বিয়ে করলেন। প্রতিমাসে ভাতাও পাবেন। আর সাথে কোটায় সরকারি চাকরিও পেয়েছেন তার বউ।” পোস্টটির স্ক্রিনশট দেখুন--
ফ্যাক্ট চেক:
বুম বাংলাদেশ যাচাই করে দেখেছে, দাবিটি সঠিক নয়। সামাজিক মাধ্যমে ভোলা জেলা প্রশাসনের ভুলের সুযোগ নিয়ে ভিন্ন এক ব্যক্তির ছবি দিয়ে শহীদ নয়ন ফিরে এসেছে বলে ভুয়া তথ্য প্রচার করা হয়েছে। ছবির ব্যক্তির নাম অহিদুজ্জামান সাকিব। তিনি জুলাই আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন এমন প্রচারণা তাদের সহ সংশ্লিষ্ট কোনো পক্ষ থেকেই কখনো দাবি করা হয়নি।
মূলত, ২০২৪ সালের নভেম্বর ভোলা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ভোলার আহত ও শহীদদের স্মরণে তাদের পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে স্মরণসভায় উপস্থিত হওয়ার জন্য অনুরোধ করে পাঠানো এক চিঠিতে ভুলক্রমে শহীদ নয়নের বাবার এবং মায়ের নামের জায়গায় স্থানীয় আরেক প্রবাসী নয়নের বাবা-মায়ের নাম উল্লেখ করা হয়। এই বিভ্রান্তির সুযোগে আরেক ব্যক্তির ছবি ব্যবহার করে শহীদ নয়ন ফিরে এসেছে বলে প্রচার করা হয়।
কোলাজ ছবিটি রিভার্স ইমেজ সার্চ এর মাধ্যমে ফেসবুকে একটি অ্যাকাউন্ট থেকে ২০২৪ সালের ৪ ডিসেম্বর ছবির পুরুষ ব্যক্তিকে বন্ধু সম্বোধন করে এবং তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট উল্লেখ করে আলোচ্য ছবির দিয়ে তৈরি একটি ভিডিও (শেয়ার পোস্ট) পাওয়া যায়। পোস্টটির স্ক্রিনশট দেখুন--
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সার্চ করে বেশকিছু ফেসবুক পোস্টে (১, ২, ৩) আলোচ্য ছবিটি কিংবা ছবিটি দিয়ে তৈরি ভিডিওতে ছবির পুরুষ ব্যক্তিকে অহিদুজ্জামান সাকিব বলে উল্লেখ করা হয়েছে তার এই নামের একটি প্রোফাইল মেনশন করে। এই ফেসবুক প্রোফাইলে পাওয়া তার নিজের অন্যান্য ছবির সাথে আলোচ্য প্রচারিত ছবির চেহারার মিল পাওয়া গেছে। অর্থাৎ ছবির ব্যক্তির নাম অহিদুজ্জামান সাকিব।
তবে অহিদুজ্জামান সাকিবের নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে আলোচ্য ছবিটি (অনলি মি) করে দেওয়ায় সেটি এখন আর সবার জন্য উপলব্দ্ধ নয়। ছবিতে বিয়ের সময়কার দৃশ্য মনে হয়েছে এবং সার্চ করে ২০২৪ সালের ২৫ নভেম্বর অহিদুজ্জামান সাকিবের বিয়ের তথ্যও পাওয়া গেছে।
বিষয়টি নিয়ে অহিদুজ্জামান সাকিবের সাথে কথা হয় বুম বাংলাদেশের। তিনি জানান, আমার ছবিটি ব্যবহার করে কোথাও আমাকে জুলাই আন্দোলনের শহীদ বানিয়ে দিচ্ছে আবার কোথাও আমাকে বলা হচ্ছে, ছিনতাই করতে গিয়ে পরিচয় অতঃপর বিয়ে। আমার বাসা ফরিদপুরে এবং আমি ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজের ফাইনাল ইয়ারের পড়াশোনা করছি। ভোলার শহীদ নয়নের তথ্যের সাথে আমার ছবি জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
অহিদুজ্জামান সাকিব জুলাই আন্দোলনে শহীদ হয়েছে এমন প্রচারণার স্বপক্ষে কী পাওয়া যায়?
আলোচ্য প্রচারিত ছবির ব্যক্তির নাম অহিদুজ্জামান সাকিব এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে। কিন্তু তিনি জুলাই আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন এমন প্রচারণা তাদের পক্ষ সহ সংশ্লিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কেউ কখনো করেছে কিনা সে বিষয়ে সার্চ করে প্রাথমিকভাবে কোনো গ্রহণযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি।
তবে কিছু ফেসবুক পোস্টে অহিদুজ্জামান সাকিবের ছবি ব্যবহার করে আন্দোলনে ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার শহীদ নয়ন দাবি করা হয়েছে। এরকম একটি ফেসবুক পোস্টের স্ক্রিনশট দেখুন--
এ বিষয়ে সার্চ করে ভোলার স্থানীয় সংবাদমাধ্যম 'দৈনিক আজকের ভোলা'-তে সেসময়ে (২০২৪ সালের ৪ ডিসেম্বর) "ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে জুলাই বিপ্লবের শহীদকে জীবিত করার চেষ্টা" শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
এতে উল্লেখ করা হয়, ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার টবগী ইউনিয়নের নুরুল ইসলাম এর পুত্র নয়ন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন ঢাকার লালবাগে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও পরে একটি প্রাইভেট হসপিটালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ৯ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। গত ২ ডিসেম্বর কিছু লোক ফেসবুকে একটি পোস্ট করে লেখেন তার এলাকার জুলাই বিপ্লবের শহীদ নয়ন ফিরে এসেছে। ফেসবুক পোস্টের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি ফেসবুক পোস্টে যার কথা বলা হয়েছে তিনি ওমান প্রবাসী নয়ন তার পিতার নাম আনসারুল্লাহ তিনি ৮ বছর যাবৎ ওমানে আছেন। গত ৬ মাস আগে ছুটিতে বাড়ি এসে পরিবারের সাথে সময় কাটিয়ে গেছেন।
এতে আরো উল্লেখ করা হয়, জীবিত প্রবাসী নয়নের মা জানান, নিহত নয়নের বাড়ি আর আমার বাড়ি কাছাকাছি হওয়াতে ভুলে নিহত নয়নের বাবার নামের পরিবর্তে আমার স্বামীর নাম চলে এসেছে, তবে কোন টাকা পয়সা আমরা পাইনি। কে বা কারা গুজব ছড়াচ্ছে যে নিহত নয়ন বেঁচে ফিরছে। যারা গুজব রটাইছে তাদের বিচার দাবি করছি। টবগী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি নেসারউদ্দিন বাহার মিয়া জানান, জুলাই বিপ্লবে শহীদ নয়নকে নিজ হাতে দাফন-কাপনের ব্যবস্থা করেছি (সংক্ষেপিত)।
এদিকে আরো সার্চ করে ফেসবুকে ভোলার একজন ব্যবহারকারীর এ-সংক্রান্ত একটি পোস্ট পাওয়া যায়। পোস্টে ভোলা জেলা প্রশাসনের একটি চিঠি, শহীদ নয়নের জন্মসনদ ও তার পিতার জাতীয় পরিচয়পত্রের ছবি যুক্ত করে জানানো হয়, ভোলা জেলা প্রশাসন শহীদ নয়নের নামে চিঠি ইস্যু করতে গিয়ে আরেক নয়নের (প্রবাসী) নামে ইস্যু করে ফেলেছে (সংক্ষেপিত)।
তিনি আরো উল্লেখ করেন, ২০২৪ সালের ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে ৭নং টবগী ইউনিয়ন থেকে শহীদ হন, শহীদ নয়ন যার পিতা নুরুল ইসলাম এবং মাতা মমতাজ বেগম, ঠিকানা মুলাইপত্তন ৯ নং ওয়ার্ড। রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা মর্যাদা দানের জন্য মনোনয়ন করে চিঠি দেওয়া হয়েছে, প্রবাসী নয়ন'কে যার পিতার নাম আনসার মিয়া এবং মাতার নাম রিজিয়া বেগম টবগী ৯নং ওয়ার্ড বোরনহানউদ্দিন, ভোলা। অথচ উক্ত ব্যাক্তি জীবিত ও সৌদি প্রবাসী। পোস্টটির স্ক্রিনশট কোলাজ দেখুন--
অর্থাৎ শহীদ মো: নয়ন ও প্রবাসী নয়ন দুইজন আলাদা ব্যক্তি।
উল্লেখ্য ভোলা জেলা প্রশাসনের ভুলের কথা উল্লেখ করে দেওয়া এক পোস্টের সাথে শহীদ নয়নের বাবার একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে একজন ব্যবহারকারী। যেখানে নয়নের বাবাকে প্রমাণ হিসেবে তার ছেলের বিভিন্ন কাগজপত্র প্রদর্শন করতে দেখা যায়। জুলাই আন্দোলনে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ৯ আগস্ট তিনি মারা গেলে তার মৃত্যুর খবর সেসময়ে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ফেসবুক ব্যবহারকারীর পোস্টে পাওয়া যায় (১, ২, ৩)। পোস্টগুলোতে তার চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থার ছবি সহ পূর্ববর্তী ছবিও উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি সামাজিক মাধ্যমে নয়নের জানাজা'র ছবি ও ভিডিও পাওয়া যায়।
সুতরাং সামাজিক মাধ্যমে ভোলা জেলা প্রশাসনের ভুলের সুযোগ নিয়ে, ফরিদপুরের ভিন্ন একটি ছেলের বিয়ের ছবিকে ভোলার শহীদ নয়ন ফিরে এসেছে বলে বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চালানো হচ্ছে।