ইসলাম গ্রহণ করা গ্যারি মিলার ও ছবির গ্যারি মিলার ভিন্ন ব্যক্তি
বুম বাংলাদেশ দেখেছে, ইসলাম গ্রহণ করা টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গ্যারি মিলারের গল্পের সাথে যুক্ত ছবিটি একই নামের ভিন্ন ব্যক্তির।
সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকের একাধিক আইডি, পেজ ও গ্রুপে একটি ছবি পোস্ট করে টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গ্যারি মিলার ইসলাম গ্রহণের গল্প প্রচার হচ্ছে। এরকম কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে ও এখানে।
গত ২৬ জুলাই "লাবিব আহসান" নামে একটি ফেসবুক আইডি থেকে একটি ছবি পোস্ট করে বলা হয়, "কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত ও যুক্তিবিদ্যার অধ্যাপক ড. গ্যারি মিলার। অত্যন্ত সৌম্যদর্শন ফর্সা চেহারার অধিকারী মানুষ। খ্রিস্টধর্মের একজন সক্রিয় প্রচারক ছিলেন তিনি। বাইবেল বিষয়ে ছিল তার অগাধ পাণ্ডিত্য। বিশিষ্ট দাঈ শায়খ আহমদ দিদাতের সঙ্গে কুরআন ও বাইবেল ইস্যুতে ডিবেট হয়েছিল ড. গ্যারির। কেবল ভুল খুঁজে বের করবার অভিপ্রায় নিয়েই কুরআন অধ্যয়নে ব্যাপৃত হয়েছিলেন তিনি। তার ধারণা ছিল—আল কুরআন যেহেতু চৌদ্দশ বছরের প্রাচীন গ্রন্থ, কাজেই সেখানে নিশ্চয় মরুভূমি বিষয়ক কোনো কথাবার্তাই থেকে থাকবে! নিজের পাণ্ডিত্যের ওপর অগাধ বিশ্বাসের কারণেই তিনি ধরে নিয়েছিলেন—আল কুরআনের ঐতিহাসিক, ব্যাকরণগত এবং ম্যাথম্যাটিক্যাল অনেক ভুল তিনি খুঁজে পাবেন। ফলে মুসলিমদের কুপোকাত করার মোক্ষম অস্ত্র চলে আসবে তার হাতে। কিন্তু আল কুরআন যে তার পাণ্ডিত্যকেই প্রশ্নের মুখোমুখি করবে, তা তিনি কল্পনাও করেননি৷ কুরআন অধ্যয়নের একদম শুরুতেই ধাক্কা খেলেন তিনি। পৃথিবীর কোনো লেখকই আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলতে পারে না—তার লেখা বইয়ে কোনো ভুল নেই। আল কুরআনই একমাত্র ব্যতিক্রমী গ্রন্থ, যার শুরুতেই বলা হচ্ছে—'This is the book, there is no doubt about it.' [Surah Bakarah : 02] অর্থাৎ, এটি এমন একটি গ্রন্থ, যাতে সন্দেহের লেশমাত্র নেই। ড. গ্যারি মিলার আগে কখনো এত আত্মবিশ্বাস নিয়ে নিজের বইকে নির্ভুল বলতে দেখেননি কোনো লেখককে। তার বিস্ময়ের সীমা রইল না। শুধু তা-ই নয়, এর বিভিন্ন আয়াতে কুরআনের প্রতি সন্দেহ পোষণকারীদের উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া হচ্ছে। কুরআনের ভুল খুঁজতে বসে ড. গ্যারির মনে হলো—স্বয়ং কুরআনই যেন চ্যালেঞ্জ করছে তাকে। সূরা নিসার একটি আয়াতে বলা হচ্ছে, 'Do they not then reflect on the Quran? Had it been from anyone other than Allah, they would have certainly found in it many inconsistencies. [Surah Nisa : 82] অর্থাৎ, তবে কি তারা কুরআন সম্পর্কে অনুধাবন করে না? এটা যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো পক্ষ থেকে আসত, তবে তারা তাতে বহু অসংগতি খুঁজে পেত। ড. গ্যারি মিলার এবার নড়েচড়ে বসলেন। গভীর বিস্ময় নিয়ে তিনি এগিয়ে যেতে থাকলেন সামনের দিকে। তাকে আরও অবাক করল, যখন দেখলেন—সমগ্র কুরআনে নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যক্তিগত জীবন প্রায় অনুল্লিখিত। তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজা রাদিআল্লাহু আনহা, প্রাণপ্রিয় চাচা আবু তালিব এবং ছেলে-মেয়েদের ইন্তেকাল; কোনোকিছুই এখানে স্থান পায়নি। যদি এটা তাঁর নিজের লিখিত কোনো গ্রন্থ হতো, তাহলে তো তাঁর দৈনন্দিন জীবনের অনেককিছুই স্থান পেতো এতে! তিনি আরও অনেকগুলো বিষয় অবলোকন করে যুক্তির সঙ্গে যুক্তি মিলিয়ে নিঃসন্দেহ হলেন—এটি কোনোভাবেই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লিখিত কোনো গ্রন্থ নয়। বিশেষত কিছু যুদ্ধে পরাজয়ের পর মুসলিমদের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে এবং বিজয়ের পর দম্ভ-অহংকারের পরিবর্তে আরো বেশি প্রচেষ্টা ও আত্মত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যদি তা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রচিত কোনো গ্রন্থ হতো, তাহলে তাতে জয়-পরাজয়ের নানা কারণ বর্ণনা করতেন তিনি। অথচ ব্যক্তিগত প্রশংসা সংক্রান্ত কোনো কথাই সেখানে বলা নেই। কুরআনের একটি জায়গায় বলা হচ্ছে, 'Say, "I only advise you of one [thing] that, you stand for Allah, [seeking truth] in pairs and individually and then give thought. There is not in your companion any madness. He is only a warner to you before a severe punishment.'" [Surah Saba : 46] অর্থাৎ, বলুন! 'আমি তোমাদের একটি বিষয়ে উপদেশ দিচ্ছি—তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে দুজন-দুজন অথবা একজন একজন করে দাঁড়াও, অতঃপর তোমরা চিন্তা করে দেখ—তোমাদের সঙ্গী আদৌ পাগল নয়। সে তো কঠিন শাস্তি সম্পর্কে তোমাদের সতর্ককারী মাত্র।’ এই আয়াতে আল্লাহ সম্মিলিত আলোচনার কথা বলেছেন। অর্থাৎ কাফেরদের বিনা চিন্তা-ভাবনায় নবির অনুসরণ করতে হবে না। বরং তাঁর সম্পর্কে তারা চিন্তা করে দেখুক—তিনি কীসের আহবান জানাচ্ছেন? এতে তার লাভ কী? তিনি কী আসলেই পাগলদের মতো কিছু বলছেন? যদি তারা এককভাবে চিন্তা করে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে না পারে, তাহলে দুজন পরস্পর আলোচনা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছুক। ড. গ্যারি নিজেই ‘সম্মিলিত আলোচনার প্রভাব ও ফলাফল সম্পর্কে’ গবেষণা করেছিলেন। কুরআন পড়তে এসে দেখলেন—এ ব্যাপারে চৌদ্দশ বছর আগেই কথা বলা হয়েছে। গ্যারি মিলারের চোখে আরেকটি বিস্ময় ছিল কুরআনের সূরা মারিয়াম। মারিয়াম আলাইহাস সালাম খ্রিষ্টধর্মে 'মাদার মেরি' নামে সম্মানিত। বাইবেলে তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু দেখা গেল—তাঁকে সম্মানিত করার ক্ষেত্রে আল কুরআন বাইবেলকেও ছাড়িয়ে গেছে। যেখানে আয়েশা এবং ফাতিমা রাদিআল্লাহু আনহুমার নাম কুরআনে একবারও আসেনি, সেখানে মারিয়াম আলাইহাস সালামের নামে স্বতন্ত্র একটি সূরাই নাযিল করা হয়েছে। যেখানে নবিজির নিজের নাম এসেছে মাত্র ৪ বার, সেখানে ঈসা আলাইহিস সালামের নাম এসেছে ২৫ বার। ড. গ্যারি মিলার সমকালীন ক্যাথলিক বিশ্বকোষ দেখেছেন। তাঁর মনে হয়েছে—কুরআনের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এখানে আনা হয়েছে, তা যুক্তিতে টেকে না। চার্চ নিজেও এসব অভিযোগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি, সাহস করেনি। আবার চিরন্তন সত্যও স্বীকার করেনি। এসবই হৃদয়ের চোখ খুলে দিয়েছে তার। এরপরই ইসলাম গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন। এই একটি গ্রন্থই তাকে বদলে দেয় আপাদমস্তক। মুসলিম হওয়ার পর তার নাম হয় আবদুল আহাদ ওমর। 'কুরআন সাধকদের গল্প-৫'/ লাবিব আহসান-তথ্যসূত্র : 1. Islamhashtagdotcom, 2. Mindfullmuslimdotcom, 3. The Daily Kalerkantha"। পোস্টটির স্ক্রিনশট দেখুন--
পোস্টে যুক্ত ছবিটি দেখুন আলাদাভাবে--
অর্থ্যাৎ আলোচ্য পোস্টে যুক্ত ছবির ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণকারী অধ্যাপক গ্যারি মিলার বলে দাবি করা হচ্ছে।
ফ্যাক্ট চেক:
বুম বাংলাদেশ যাচাই করে দেখেছে, আলোচ্য পোস্টের দাবিটি সঠিক নয়। ইসলাম গ্রহণ করা টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গ্যারি মিলার এবং আলোচ্য ছবির গ্যারি মিলার ব্যক্তি ভিন্ন।
ছবিটির রিভার্স ইমেজ সার্চ করে Distance educator নামে একটি ওয়েবসাইটে ২০১৩ সালের ১৩ এপ্রিল "REVIEW OF HANDBOOK OF DISTANCE EDUCATION: THIRD EDITION BY DR. GARY MILLER, EXECUTIVE DIRECTOR EMERITUS OF THE PENN STATE WORLD CAMPUS" শিরোনামে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে আলোচ্য ছবিটি খুঁজে পাওয়া যায়। ওই নিবন্ধ থেকে জানা যায়, ছবির ব্যক্তির নাম গ্যারি ই. মিলার বা ড. গ্যারি মিলার। ২০০৭ সালের জুন মাসে অবসর গ্রহণের আগ পর্যন্ত তিনি পেনসিলভেনিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে আউটরিচের সহযোগী ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে এবং পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির Continuing and Distance Education-এর নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্ক্রিনশট দেখুন--
উক্ত নিবন্ধের শেষে আলোচ্য ছবির ড. গ্যারি মিলারের সংক্ষিপ্ত বায়োগ্রাফি বা পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে। একই নিবন্ধের শেষাংশের স্ক্রিনশট দেখুন--
অন্যদিকে, আলোচ্য পোস্টে বর্ণিত ইসলাম গ্রহণ করা অধ্যাপক গ্যারি মিলারের গল্প অনুযায়ী কি-ওয়ার্ড সার্চ করে দ্য ইসলামিক ইনফরমেশন নামের একটি ওয়েবসাইটে ২০২০ সালের ১১ জানুয়ারি "Mathematician, Gary Miller Who Tried to Prove Quran Wrong, Accepted Islam" শিরোনামে একটি নিবন্ধ খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত নিবন্ধে গ্যারি মিলার নামে টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গণিতের অধ্যাপকের ইসলাম গ্রহণের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। এই নিবন্ধে ইসলাম গ্রহণ করা টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গ্যারি মিলারের ছবি যুক্ত করা আছে। তবে, এই গ্যারি মিলারের ছবি ও আলোচ্য পোস্টে যুক্ত গ্যারি মিলারের ছবি ভিন্ন ব্যক্তির হিসেবে দেখা যায়। স্ক্রিনশট দেখুন--
আরো সার্চ করে islamhashtag নামে একটি ওয়েবসাইটে ২০১৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর "Dr Gary Miller and his journey to Islam" শিরোনামে প্রকাশিত আরেকটি নিবন্ধ থেকে জানা যায়, ড. গ্যারি মিলার একজন গণিতবিদ এবং একজন ধর্মতত্ত্ববিদ। তিনি তাঁর জীবনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে খ্রিস্টান মিশনারি কাজে সক্রিয় ছিলেন কিন্তু তিনি বাইবেলে অনেক অসঙ্গতি আবিষ্কার করতে শুরু করেন। ১৯৭৮ সালে তিনি কুরআন শরীফেও সত্য এবং মিথ্যার মিশ্রণ থাকতে পারে ভেবে কুরআন পাঠ করতে শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি মুসলিম হন এবং তারপর থেকে রেডিও এবং টেলিভিশনে ইসলাম নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বক্তব্য দিতেন। এই নিবন্ধেও আগের নিবন্ধের মত ইসলাম গ্রহণকারী অধ্যাপক গ্যারি মিলারের একই রকম ছবি যুক্ত করা হয়েছে, যা আলোচ্য পোস্টে যুক্ত ছবির চেয়ে ভিন্ন। স্ক্রিনশট দেখুন--
এছাড়াও, আরো সার্চ করে New England Muslims নামে একটি ওয়েবসাইটে ২০১৭ সালের ৬ নভেম্বর "Gary Miller: The Man Who Challenged the Qur’an" শিরোনামে একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। ওই প্রতিবেদন থেকেও জানা যায় একই রকম তথ্য। স্ক্রিনশট দেখুন--
এবারে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষক ড. গ্যারি মিলারের ছবি (বামে) ও ইসলাম গ্রহণকারী কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত ও ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক গ্যারি মিলারের ছবি (ডানে) দেখুন পাশাপাশি--
অর্থ্যাৎ কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত ও ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক গ্যারি মিলারের ইসলাম গ্রহণের গল্পের সাথে যুক্ত ছবিটি তাঁর নয় বরং যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষক ড. গ্যারি মিলারের।
সুতরাং ভিন্ন এক গ্যারি মিলারের ছবি দিয়ে কানাডার অধ্যাপক গ্যারি মিলারের ইসলাম গ্রহণের গল্প প্রচার করা হচ্ছে, যা বিভ্রান্তিকর।