নরসিংদীর অগ্নি দুর্ঘটনার ভিডিও সাম্প্রদায়িক দাবিতে প্রচার
বুম বাংলাদেশ দেখেছে, ভিডিওটি নরসিংদীর পলাশ উপজেলার ধলাদিয়া বাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার, এর সাথে সাম্প্রদায়িক যোগসূত্র নেই।
সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকের একাধিক আইডি ও পেজ থেকে একটি ভিডিও ক্লিপ সাথে কয়েকটি ছবি শেয়ার করে দাবি করা হচ্ছে, হিন্দু সম্প্রদায়ের বেশ কিছু বাড়িঘরে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে, ভিডিওটি এবং ছবিগুলো উক্ত ঘটনার। ফেসবুক পোস্টগুলোর কোথাও ঘটনাটি কিশোরগঞ্জ জেলার আবার কোথাও নরসিংদী জেলার নাম উল্লেখ করা হচ্ছে। এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে।
গত ২৩ আগস্ট 'জয় শ্রীকৃষ্ণ' নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে ভিডিও ক্লিপ শেয়ার করে লেখা হয়, "এইবার মহামান্য রাষ্ট্রপতির জেলা কিশোরগঞ্জের ভৈরবে চণ্ডিবের গ্রামে রাতের আধারে ৮ টি হিন্দু বাড়িঘর ও দোকানে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করেছে দুর্বৃত্তরা। বর্তমানে দেশে সংখ্যালঘুদের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে গেছে। সরকার যদি এখানে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে না পারেন, তাহলে যেখানে সংখ্যালঘুরা নিরাপত্তা পাবো সেখানে স্থানান্তর করুন। এইভাবে জীবন যাপন করা যায় না।" পোস্টের স্ক্রিনশট দেখুন--
আবার গত ২৩ আগস্ট 'Minority Voice 24 - মাইনরিটি ভয়েস 24' নামের অন্য আরেকটি পেজ থেকে ঘটনাটিকে কিশোরগঞ্জের সাথে নরসিংদীর ঘটনাও উল্লেখ করে ভিডিও ক্লিপ শেয়ার দিয়ে লেখা হয়, "এবার কিশোরগঞ্জের ভৈরবে চণ্ডিবের গ্রামে রাতের আধারে ৮ টি হিন্দু বাড়িঘর ,দোকানে হামলা ,ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ এবং নরসিংদীর পলাশ উপজেলার ধলাদিয়া মন্দিরের পাশের রাস্তার মোড়ে হিন্দু ব্যাবসায়ী পঙ্কজ ধর ও ঝন্টু ভক্তের পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস চারটি দোকানে রাতের আঁধারে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।" স্ক্রিনশট দেখুন--
একই দাবিতে ভিডিওটি টুইটারেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে। স্ক্রিনশট দেখুন--
ফ্যাক্ট চেক:
বুম বাংলাদেশ যাচাই করে দেখেছে, আলোচ্য পোস্টে ভিডিও এবং ছবির সাথে করা দাবিটি সত্যি নয়। ভিডিওটি কিশোরগঞ্জ কিংবা নরসিংদীতে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের বাড়িঘর ও দোকানপাটে অগ্নিসংযোগের নয়। বরং ভিডিওটি নরসিংদীর পলাশ উপজেলার একটি বাজারে অগ্নি দুর্ঘটনার, যার সাথে সাম্প্রদায়িকতার কোনো যোগসূত্র নেই।
প্রথমত,
ঘটনাটি কিশোরগঞ্জের ভৈরবের নয়।
ভিডিও থেকে কী ফ্রেম কেটে রিভার্স সার্চ করার পর, 'Narsingdir Konthosor' নামের স্থানীয় একটি সংবাদমাধ্যমের ফেসবুক পেজে ভিডিওটি খুঁজে পাওয়া যায়, যা ২২ আগস্ট পোস্ট করা হয়েছে। ভিডিওটি দেখুন--
ভিডিও বিবরণে লেখা হয়েছে, "নরসিংদীর ঘোড়াশাল অগ্নিকাণ্ডে ৪ দোকান পুড়ে ছাই! নরসিংদীর ঘোড়াশালে অগ্নিকাণ্ডে ৪টি দোকান পর ছাই হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের দাবি এ আগুনে তাদের প্রায় ৮ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সোমবার রাত সোয়া ৩টার দিকে পৌর এলাকার ধলাদিয়া বাজারে এ ঘটনা ঘটে। জানা যায়, রাতে বাজারের একটি দোকান থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। রাতেই খবর পেয়ে পলাশ উপজেলা ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট প্রায় এক ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। অগ্নিকাণ্ডে ওই বাজারের একটি মুদী দোকান ও প্লোট্রি ফিডের দোকানসহ ৪টি দোকান ও মালামাল সম্পূর্ণ পুড়ে যায়।"
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বিবরণে সাম্প্রদায়িকতা বা দুর্বৃত্ত কর্তৃক আগুন ধরিয়ে দেয়ার কোনো তথ্য নেই।
এই সূত্র ধরে সার্চ করার পর, স্থানীয় সংবাদমাধ্যম 'দ্য নরসিংদী টাইমস' এ গত ২২ আগস্ট "ঘোড়াশালে আগুনে পুড়লো ৪ দোকান, ৮ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি" শিরোনামে এই ঘটনা সম্পর্কিত একটি খবর খুঁজে পাওয়া যায়, যেখানে আলোচ্য ভিডিওতে দেখতে পাওয়া আগুনের ছবিটিও যুক্ত আছে। খবরে পলাশ উপজেলা ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার সাদিকুল বারীর বরাতে জানানো হয়, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে ওই আগুনের সূত্রপাত বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। স্ক্রিনশট দেখুন--
বুম বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পলাশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ ইলিয়াছের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনিও দোকানগুলোতে কেউ আগুন দিয়েছে এমন কোনো তথ্য বা অভিযোগ পাওয়ার কথা নাকোচ করে দেন।
অর্থাৎ ভিডিওটি নরসিংদীর পলাশ উপজেলার হলেও এর সাথে সাম্প্রদায়িকতার কোনো সংযোগ নেই। যেমনটি ফেসবুক পোস্টগুলোতে দাবি করা হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত
কিশোরগঞ্জের ভৈরবের চণ্ডিবের হিন্দু বাড়িঘরে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে দাবিটিও বিভ্রান্তিকর।
কী ওয়ার্ড ধরে সার্চ করার পর, সম্প্রচারমাধ্যম আরটিভি'র অনলাইন সংস্করণে গত ২৩ আগস্ট "স্কুলশিক্ষার্থীকে উত্ত্যক্ত করা নিয়ে দুই গ্রামবাসীর সংঘর্ষ, আহত ৩০" শিরোনামে প্রকাশিত একটি খবর খুঁজে পাওয়া যায়। খবরে বলা হয়, "কিশোরগঞ্জের ভৈরবে স্কুল শিক্ষার্থীকে উত্ত্যক্ত করা নিয়ে দুই গ্রামবাসীর মধ্যে ৩ ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। গতকাল (২২ আগস্ট) সোমবার রাত ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত পৌর শহরের চন্ডীবের ও পলতাকান্দা গ্রামের লোকজনের মধ্যে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে উভয়পক্ষের অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছে। এ ছাড়াও প্রতিপক্ষের লোকজন চন্ডীবের গ্রামের পাঁচটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগসহ সাতটি বসতঘর ভাঙচুর ও লুটপাট করেছে। খবর পেয়ে দমকল বাহিনীর সদস্যরা ঘণ্টাব্যাপী চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। একইসঙ্গে পুলিশ রাত ১১টার দিকে পরিস্থিতি সামাল দেয়। এতে প্রায় ২০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।" স্ক্রিনশট দেখুন--
অর্থাৎ সংঘর্ষের ঘটনাটি ঘটছে স্থানীয় দুটি গ্রামের মধ্যে, স্থানীয় একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। সাম্প্রদায়িক কোনো দৃষ্টিকোন থেকে নয়। আবার দৈনিক যুগান্তরের অনলাইন সংস্করণে এই ঘটনা সম্পর্কিত প্রতিবেদনের শুরুতে একটি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের সুত্রপাত বলে বর্ণনা করা হয় এবং শেষে বলা হয় চন্ডিবের এলাকায় একটি প্রেমঘটিত বিষয় নিয়ে ঘটনার সূত্রপাত হয়।
বুম বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই ঘটনা সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে দৈনিক যুগান্তরের ভৈরব প্রতিনিধি আসাদুজ্জামান ফারুকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ক্ষতিগ্রস্ত দোকানিদের মধ্যে হিন্দু এবং মুসলিম উভয় ধর্মাবলম্বী আছে। সংঘর্ষের ঘটনার সাথে সাম্প্রদায়িক কোনো সংযোগ নেই বলেও তিনি জানান।
অর্থাৎ দুটি ভিন্ন ঘটনাকে একসাথে জুড়ে অপ্রাসঙ্গিকভাবে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোন থেকে প্রচার করা হচ্ছে, যা বিভ্রান্তিকর।