ভ্যাকসিনের অনুমোদন নয়, কোম্পানিকে পেটেন্ট দিয়েছে চীন
চীনে একটি কোম্পানির 'ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেট'র পেটেন্ট দেয়ার খবরকে বাংলাদেশে 'রাশিয়ার মতো ভ্যাকসিনের অনুমোদন' হিসেবে প্রচার
বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দাবি করা হয়েছে যে, রাশিয়ার পর চীন তাদের একটি ভ্যাকসিনকে অনুমোদন দিয়েছে।
নিচে কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম দেখুন--
বাংলাদেশ প্রতিদিন: সুখবর! রাশিয়ার পর এবার ভ্যাকসিন অনুমোদন দিল চীন
সময় টিভি: এবার অনুমোদন পেল চীনা ভ্যাকসিন
বাংলা ট্রিবিউন: এবার করোনা ভ্যাকসিনের অনুমোদন দিলো চীন
কালের কণ্ঠ: সুখবর! করোনার ভ্যাকসিন অনুমোদন চীনের
যুগান্তর: এবার করোনা ভ্যাকসিনের অনুমোদন দিল চীন
জনকণ্ঠ: রাশিয়ার পর এবার করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিনের অনুমোদন দিলো চীন
বাংলানিউজ: এবার করোনার ভ্যাকসিন অনুমোদন দিল চীন
বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিবেদনের প্রথম দুই প্যারায় বলা হয়েছে--
"রাশিয়ার পর এবার করোনা ভ্যাকসিনের অনুমোদিন দিল চীন। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষায় দারুণভাবে সফল হওয়ার পর ভ্যাকসিনটির অনুমোদন দিয়েছে শি জিনপিং প্রশাসন।
দেশটির সেনাবাহিনীর সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ চেন ওয়ের দল এবং স্যানসিনো বায়োলজিকসের তৈরি করেছে এই ভ্যাকসিন। 'এড৫-এনসিওভি' নামের ভ্যাকসিনটি রবিবারই নিবন্ধন করেছে চীন।"
তবে অন্য একটি প্যারায় লেখা হয়েছে--
"টুইট বার্তায় বলা হয়, চীন প্রথম করোনা ভ্যাকসিনের পেটেন্ট অনুমোদন দিয়েছে। পিএলএ (চীনা সেনাবাহিনী) সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ চেন ওয়ের দল তৈরি করেছে ভ্যাকসিনটি। এর আগে দ্বিতীয় পর্যায়ের পরীক্ষায় দেখা গেছে, ভ্যাকসিনটি নিরাপদ এবং প্রতিরোধ ক্ষমতা জাগিয়ে তুলতে সক্ষম।"
বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিবেদনের শুরুতে লেখা হয়েছে-
"প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষায় সফলতা পাওয়ার পর নিজেদের তৈরি একটি ভ্যাকসিনের অনুমোদন দিয়েছে চীন। চায়না গ্লোবাল টেলিভিশন নেটওয়ার্কের (সিজিটিএন) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।"
ট্রিবিউনের প্রতিবেদনের অন্য জায়গায় লেখা হয়েছে--
"সিজিটিএন-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, চীন প্রথম করোনা ভ্যাকসিনের পেটেন্ট অনুমোদন দিয়েছে।"
ফ্যাক্ট চেক:
চীন আসলে তাদের দেশীয় একটি কোম্পানির তৈরি ভ্যাকসিনকে কী ধরেনের অনুমোদন দিয়েছে তা যাচাই করে দেখার চেষ্টা করেছে বুম বাংলাদেশ।
বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যমগুলোর বেশিরভাগই চীনা সংবাদমাধ্যম cgtn.com এর বরাত দিয়েছে। সোমবার cgtn.com এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিলো, "China grants 1st COVID-19 vaccine patent to domestic candidate".
অর্থাৎ, "দেশে তৈরি প্রথম কভিড-১৯ ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেটের মেধাস্বত্ত্বের স্বীকৃতি দিলো চীন"।
প্রথমত, শিরোনামে শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে 'vaccine ...candidate'। 'ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেট' হচ্ছে তৈরির পর্যায়ে থাকা সম্ভাব্য ভ্যাকসিন, যারা কার্যকারিতা এখনও পরীক্ষা নিরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে এবং মানুষের ওপর সাধারণভাবে প্রয়োগের জন্য অনুমোদিত হয়নি। কোনো 'ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেট' সব পরীক্ষার পর্যায় শেষ করার নিরাপদ ও কার্যকর প্রমাণিত হওয়ার পর সেটি সাধারণভাবে মানুষের ওপর প্রয়োগের অনুমদোন পেলেই কেবল সেটি 'ভ্যাকসিন' হয়ে ওঠে।
দ্বিতীয়ত, চীনা সংবাদমাধ্যমের শিরোনামেই বলা হয়েছে, দেশে তৈরি একটি ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেটকে (Ad5-nCoV) প্যাটেন্ট অনুমোদন দেয়া হয়েছে, অর্থাৎ মেধাস্বত্ত্বের স্বীকৃতি দিয়েছে। Ad5-nCoV ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেট যে প্রতিষ্ঠান তৈরি করছে সেটির মালিকানা এই প্যাটেন্ট প্রাপ্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হবে।
প্যাটেন্টের অনুমদোন দিয়েছে চীনের National Intellectual Property Administration.
cgtn.com এর প্রতিবেদনের কোথাও বলা হয়নি যে, চীন সরকার সাধারণ মানুষের ওপর Ad5-nCoV ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেটকে প্রয়োগ শুরু করার অনুমোদন দিয়েছে।
চীনের আরেকটি সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমস তাদের সংক্রান্ত প্রতিবেদনে জানিয়েছে, Ad5-nCoV এর মেধাস্বত্ত্বের স্বীকৃতি পেয়েছে প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান CanSino. ভ্যাকসিনটি বর্তমানে ফেইজ থ্রি ট্রায়াল শুরুর পথে আছে বলেও জানানো হয় এই প্রতিবেদনে। এই সংবাদমাধ্যমও জানায়নি যে, চীন সরকার রাশিয়ার মতো সাধারণ মানুষের ওপর ভ্যাকসিনটি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে।
রাশিয়ার অনুমোদন কী ধরনের ছিলো?
গত সপ্তাহে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ঘোষণা দেন যে, তার সরকার বিশ্বে প্রথম করোনা ভাইরাস ভ্যাকসিন হিসেবে রাশিয়ায় তৈরি 'স্পুটনিক ভি' ভ্যাকসিনকে মানুষের ওপর সাধারণভাবে ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দিয়েছে।
রাশিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই অনুমোদন দেয়। যদিও রাশিয়ার এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীদের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে।
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে বিভ্রান্তি:
উপরে বাংলাদেশের যেসব সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়েছে সেগুলোর কোনো কোনোটির শিরোনাম ও ইন্ট্রোতে সরাসরি বলা হয়েছে যে, "রাশিয়ার পর এবার ভ্যাকসিন অনুমোদন দিল চীন"। অর্থাৎ, এটা বুঝানো হয়েছে- রাশিয়া যে ধরনের অনুমোদন দিয়েছে 'স্পুটনিক ভি'কে সেই একই ধরনের অনুমোদনও দেয়া হয়েছে চীনের Ad5-nCoV ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেটকে। কিন্তু বাস্তবে তা সত্য নয়। রাশিয়া গণহারে সাধারণ মানুষের ওপর ভ্যাকসিন ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। অন্যদিকে চীন তাদের দেশীয় প্রস্তুতকারক একটি কোম্পানিকে একটি ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেটের মেধাস্বত্বের স্বীকৃতি দিয়েছে।
কোনো কোনো সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে 'এবার' শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে রাশিয়ার ভ্যাকসিনের অনুমোদনের ধরনের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
তবে বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যমগুলোর শিরোনামে ও ইন্ট্রোতে 'ভ্যাকসিনের অনুমোদন' এর তথ্য দেয়া হলেও ভেতরে 'পেটেন্ট অনুমোদন' এর তথ্যও উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বায়োমেডিকেল ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ও ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন বলেন, আমি বাংলাদেশের মিডিয়ায় খবরটি দেখেছি যে, চীন তাদের একটি ভ্যাকসিনের অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক কোনো সংবাদমাধ্যমে এমন খবর পাইনি। প্রকৃতপক্ষে চীনা কোম্পানি CanSino-কে তাদের একটি ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেটের পেটেন্ট দেয়া হয়েছে।
"CanSino এর ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেট Ad5-nCoV বর্তমানে ফেইজ ওয়ান ও টু ট্রায়ালে আছে। এখনও ফেইজ থ্রি শুরুই হয়নি। ওই কোম্পানিকে পেটেন্ট দেয়ার অর্থ হলো, ভ্যাকসিনটি সফল হলে এটা তাদের সম্পদ হিসেবে গণ্য হবে। অন্য কেউ এটি উৎপাদন করতে চাইলে তাদের কাছ থেকে অনুমোদন নিয়ে করতে হবে", বলেন জনাব সরোয়ার।
তিনি আরও বলেন, রাশিয়া যেভাবে 'স্পুটনিক ভি' নামক তাদের একটি প্রতিষ্ঠানের তৈরি ভ্যাকসিনকে গণমানুষের ওপর প্রয়োগের অনুমোদন দিয়েছে, চীন Ad5-nCoV ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেটকে তেমন অনুমোদ দেয়ার কোনো খবর আমি কোথাও পাইনি।