কবি রাধাপদ সরকারকে পল্লীকবি জসিমউদ্দিন বলে প্রচার
বুম বাংলাদেশ দেখেছে, ভিডিওর ব্যক্তি কুড়িগ্রামের কবি রাধাপদ সরকার, যিনি নিজেকে পল্লীকবি হিসেবে অভিহিত করেন।
সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকের একাধিক আইডি, পেজ ও গ্রুপে একটি ভিডিও শেয়ার করে ভিডিওটিতে পল্লীকবি জসিমউদ্দিন কথা বলছেন বলে দাবি করা হচ্ছে। এরকম কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে ও এখানে।
গত ২২ মার্চ 'Kajol' নামে একটি ফেসবুক পেজ থেকে একটি রিলস ভিডিও পোস্ট করা হয়। ভিডিওটিকে সাদা দাড়ি-গোঁফ আছে এমন এক বৃদ্ধকে কথা বলতে ও কবিতা আবৃত্তি করতে দেখা যায়। ভিডিওটির উপরে লেখা থাকতে দেখা যায়, "পল্লীকবি জসিমউদ্দিনের বিশেষ কিছু কথা নিজের মুখে শুনুন"। পোস্টটির স্ক্রিনশট দেখুন--
ফ্যাক্ট চেক:
বুম বাংলাদেশ যাচাই করে দেখেছে, দাবিটি সঠিক নয়। ভিডিওটিতে দেখানো ব্যক্তি পল্লীকবি জসিমউদ্দিন নন বরং তিনি কুড়িগ্রামের কবি রাধাপদ সরকার এবং তিনি নিজেকে পল্লীকবি হিসেবে অভিহিত করেন।
ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, সাদা দাড়ি-গোঁফ আছে এমন একজন বৃদ্ধ কথা বলছেন এবং কবিতা আবৃত্তি করছেন। প্রথমে তিনি বলেন, "এই দেশ নষ্ট করেছে কারা? যারা কলম ধরা শিখেছে, তারাই দেশকে খাইছে। কথাটা বোঝলেন নাকি আমার? আমি পল্লীকবি, কবিতে বানাই। কিন্তু আমার কবিতে তো কেউ শুনবে না। কারন আমরা গরীব মানুষ, গরীব মানুষের কোনো দাম নেই। তা, এই যুগটা হইল কি জানেন?"। এরপর তাকে একটি কবিতা আবৃত্তি করতে শোনা যায়। কবিতাটি হল--
"কেয়ামতের নমুনা, জানি কিন্তু মানিনা।
গুনাহগার দোযখী হবে সে কথাও তো শুনিনা।
গুন্ডাপান্ডা হারামখোর তারা হইল দোজখ
দিনদুপুরে মানুষ মারে তারা হইল দুনিয়া
কেয়ামতের নমুনা জানি কিন্তু মানিনা
সরকারী চাকরি করে ,বেতন ৫ হাজার
৫০ হাজার টাকা মাসে খরচ দেখি তার
বাকি টাকা কেমনে আসে সে কথা আর বলিনা
কেয়ামতের নমুনা জানি কিন্তু মানিনা
ডিজেল ভেজাল পেট্রোল ভেজাল অক্টেন ভেজাল
ভেজাল পদ্মা মেঘনা যমুনা
অর্থাৎ, কোম্পানি ভেজাল
কেয়ামতের নমুনা জানি কিন্তু মানিনা
ভেবে কয় রাধাপদ সরকার
মানুষ হওয়া কী ছিল দরকার
পশু হওয়া ছিল ভালা
আখেরাতের কাজ করিনা
অর্থাৎ পরকালের কাজ করিনা
কেয়ামতের নমুনা জানি কিন্তু মানিনা"
আবৃত্তি শেষে তিনি আবার বলেন, "কথা বোঝলেন?"
তাঁর আবৃত্তি করা উপরের কবিতার শেষাংশে তাকে বলতে শোনা যায়, "ভেবে কয় রাধাপদ সরকার, মানুষ হওয়া কী ছিল দরকার"। তা থেকে ধারণা করা যায়, তার নাম রাধাপদ সরকার।
এর সূত্র ধরে কি-ওয়ার্ড সার্চ করে 'Md Shahidul Islam' নামের একটি ফেসবুকে একাউন্ট থেকে ২০২১ সালের ২৫ এপ্রিল পোস্টকৃত একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। ভিডিওটি আলোচ্য ভিডিওটির অরিজিনাল ও রঙিন ভার্সন। পোস্টের ক্যাপশনে লেখা হয়, "এর থেকে সত্য হয়তো হয়না। নামঃ রাধাপদ রায়। তাঁর বাড়ী কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার ভিতরবন্দ ইউনিয়নে, গ্রামঃ মাধাইখাল, গোড্ডারারপাড়।…" অর্থাৎ ভিডিওটিতে কবিতা আবৃত্তিকারের নাম রাধাপদ রায় এবং তিনি কুড়িগ্রামের বাসিন্দা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ফেসবুক পোস্টটি দেখুন--
পরবর্তীতে কি-ওয়ার্ড সার্চ করে দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলোর অনলাইন ভার্সনে ২০২৩ সালের ৩ অক্টোবর "কুড়িগ্রামে কবি রাধাপদ রায়ের ওপর হামলা" শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়,"কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলায় পূর্বশত্রুতার জেরে ‘স্বভাবকবি’ খ্যাত রাধাপদ রায়ের (৮০) ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। আহত অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করে নাগেশ্বরী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।" তাঁর ছবি সহ প্রথম আলোর সংবাদের স্ক্রিনশট দেখুন--
কুড়িগ্রামের পল্লীকবি রাধাপদ রায়ের উপর হামলার একই ঘটনায় সংবাদ প্রকাশ করে দৈনিক পত্রিকা কালের কণ্ঠের অনলাইন ভার্সন, অনলাইন পোর্টাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম, ঢাকা পোস্ট, সারাবাংলা ডট নেট, ভোরের কাগজ। এসব প্রতিবেদনে যুক্ত ছবিতে রাধাপদ রায়ের সাদা দাড়ি-গোঁফ, মাথার চুল, চেহারার অবয়ব ও গলায় পরা মালা এবং আলোচ্য ভিডিওটিতে দেখানো ব্যক্তি অর্থাৎ রাধাপদ সরকারের সেসবে মিল রয়েছে।
আরো কি-ওয়ার্ড সার্চ করে অনলাইন পোর্টাল ঢাকা পোস্টে ২০২১ সালের ১৩ অক্টোবর "দুঃখ-কষ্ট ভুলে এখনো গান-কবিতা ফেরি করেন রাধাপদ" শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। এতে বলা হয়, "আঞ্চলিক ভাষায় তার গান ও কবিতাগুলো গ্রামে গ্রামে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। ইতিমধ্যে তার লেখা কবিতা ‘কেয়ামতের আলামত জানি কিন্তু মানি না’। শিরোনামে কবিতাটি এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও ভাইরাল হয়েছে। এখন পর্যন্ত রাধাপদ সরকারের নিজের লেখা আঞ্চলিক ভাষায় শতাধিক গান ও কবিতা রয়েছে।"। এই প্রতিবেদনে তার নাম রাধাপদ সরকার বলেই লেখা হয়েছে। স্ক্রিনশট দেখুন--
ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদনে ঢাকা পোস্টের ভেরিফায়েড ইউটিউব চ্যানেলে আপলোড করা রাধাপদ সরকারকে নিয়ে একটি ভিডিও প্রতিবেদনও যুক্ত করা হয়। এই প্রতিবেদনের ২ মিনিট ২০ সেকেন্ড থেকে বলা হয়, রাধাপদ সরকারের "কেয়ামতের আলামত জানি কিন্তু মানিনা" কবিতাটি সহ অসংখ্য কবিতা ও গান জনপ্রিয় হয়েছে। এ সময় রাধাপদ সরকারকে আলোচ্য কবিতাটি একইভাবে পড়ে শোনাতে দেখা যায়। ইউটিউব ভিডিওটি দেখুন--
এবারে আলোচ্য ভিডিও থেকে নেয়া ফ্রেম (বামে) এবং ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদন থেকে নেয়া একটি ফ্রেমের (ডানে) পাশাপাশি তুলনা দেখুন--
অর্থাৎ আলোচ্য ভিডিওতে দেখানো ব্যক্তি কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার কবি রাধাপদ সরকার।
এছাড়া, ইন্টারনেটে প্রাপ্ত পল্লীকবি জসিমউদ্দিনের ছবি পর্যবেক্ষণ করে আলোচ্য ভিডিওর ব্যক্তির সাথে চেহারার মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। পল্লীকবি জসিমউদ্দীনের কোনো ছবিতে তাঁর মুখে দাড়ি-গোঁফ, মাথায় লম্বা চুল ও গলায় মালা থাকতেও দেখা যায়নি। পল্লীকবি জসিমউদ্দিনের একটি ছবি (বামে) এবং আলোচ্য ভিডিওতে দেখানো কবি রাধাপদ রায়ের ছবি (ডানে) দেখুন পাশাপাশি--
অর্থাৎ আলোচ্য ভিডিওটিতে দেখানো ব্যক্তি পল্লীকবি জসিমউদ্দিন নন বরং তিনি কুড়িগ্রামের চারণ কবি রাধাপদ সরকার বা রাধাপদ রায়। গণমাধ্যমে দুটি নামেই তাকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার ভিতরবন্দ ইউনিয়নের গোদ্ধারের পাড় গ্রামের বাসিন্দা। রাধাপদ স্থানীয়ভাবে পল্লীকবি, স্বভাবকবি ও চারণকবি হিসেবে পরিচিত।
সুতরাং কুড়িগ্রামের কবি রাধাপদ রায়কে পল্লীকবি জসিমউদ্দিন বলে প্রচার করা হচ্ছে ফেসবুকে, যা বিভ্রান্তিকর।