না, ইতালির প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেননি
জুসেপ্পে কন্তের নামে ভুল বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক ইত্তেফাকসহ বেশ কিছু অনলাইন পোর্টালে।
বাংলাদেশের দৈনিক ইত্তেফাক ১০ জুলাই একটি খবর প্রকাশ করেছে যার শিরোনাম, "একেকজন বাংলাদেশি একেকটা ভাইরাস বোমা : ইতালির প্রধানমন্ত্রী"।
প্রতিবেদনের আর্কাইভ লিংক।
ইত্তেফাকের খবরটি তাদের ফেসবুক পেইজে পোস্ট করা হলে তা ব্যাপক সাড়া ফেলে।
ফেসবুক পোস্টের আর্কাইভ লিংক।
এরপর একই খবর বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত হয়। সেরকম কয়েকটি পোর্টালে খবরটি দেখুন এখানে, এখানে ও এখানে।
ইত্তেফাকের পুরো প্রতিবেদনটি দেখুন নিচের স্ক্রিনশটে--
ফ্যাক্ট চেক:
ইত্তেফাকের প্রতিবেদনটি বুম বাংলাদেশ এর লক্ষগোচর হওয়ার পর এ বিষয়ে অনুসন্ধান চালানো হয় যে, আদৌ এমন বক্তব্য ইতালির প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন কিনা। অর্থাৎ, "একেকজন বাংলাদেশি একেকটা ভাইরাস বোমা"- এমন বক্তব্য কন্তে নিজে দিয়েছেন কিনা- তা ছিলো আমাদের অনুসন্ধানের বিষয়।
প্রথমে ইত্তেফাকের প্রতিবেদনটি থেকে কিছু কীওয়ার্ড নিয়ে ইংরেজিতে গুগল সার্চ করে দেখা যায় এ ধরনের কোনো বক্তব্য ইতালির প্রধানমন্ত্রী জুসেপ্পে কন্তের নামে কোনো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি।
ইত্তেফাকের প্রতিবেদনের উল্লেখ করা হয়েছে যে, জুসেপ্পে কন্তে স্পেন সফরের সময় চলতি সপ্তাহে একটি স্পেনিশ টিভির সাংবাদিকদেরকে উপরিউক্ত কথাগুলো বলেছেন। ফলে স্পেনিশ ভাষায়ও গুগল সার্চ করা হয় বেশ কিছু কীওয়ার্ড দিয়ে। জুসেপ্পের বক্তব্য সম্বলিত কয়েকটি প্রতিবেদন পাওয়া গেলেও "একেকজন বাংলাদেশি একেকটা ভাইরাস বোমা"- এমন বক্তব্য কোথাও পাওয়া যায়নি।
ইতালিয়ান ভাষাও গুগল সার্চ করা হয় এই বক্তব্যটি জুসেপ্পের নামের সাথে; কিন্তু এবারও ফলাফল শূন্য।
এরপর বুম বাংলাদেশ'র পক্ষ থেকে শনিবার দুপুরে (১১ জুলাই) যোগাযোগ করা হয় দৈনিক ইত্তেফাকের অনলাইন ইনচার্জের সাথে। সংবাদটির সূত্র জানতে চাইলে তিনি জানান পত্রিকাটির ইতালি প্রতিনিধি স্পেনিশ একটি টিভি থেকে আলোচ্য বক্তব্য নিয়ে প্রতিবেদন করেছেন।
ইত্তেফাক অনলাইনের ইনচার্জ জানান, তিনি কিছুক্ষণের মধ্যে প্রতিনিধির সাথে কথা বলে এ সংক্রান্ত খবরের লিংক ও ভিডিও পাঠাচ্ছেন।
এরপর তিনি নিচের স্ক্রিনশটটি পাঠান এবং জানান যে, স্পেনের La Sexta (লা সাক্সতা) টিভির সাথে ইতালির প্রধানমন্ত্রী কথা বলেছেন এবং সেটির ভিত্তিতে প্রতিবেদন করা হয়েছে।
উপরের স্ক্রিনশটে দেখা যাচ্ছে কন্তে লা সাক্সতা'র সাথে কথা বলেছেন। কিন্তু ইত্তেফাকের রিপোর্টে যা বলা হয়েছে তেমন কোনো কথা বলেননি।
উপরের স্ক্রিনশটে যা লেখা রয়েছে তার ইংরেজি অনুবাদ হলো--
"We have been forced to suspend flights from Bangladesh. We also ask for responsibility from other countries. We cannot afford to suffer new waves of viruses due to the carelessness of others." This was said by Prime Minister Giuseppe Conte in an interview with the Spanish broadcaster La Sexta.
দেখুন এই লিংকে।
এরপর বুম বাংলাদেশ লা সাক্সতাকে দেয়া জুসেপ্পে কন্তের সাক্ষাৎকারটি খুঁজে বের করে। দেখুন ভিডিওটি এখানে।
সফটওয়্যারের সহায়তায় ১৯ মিনিট ৮ সেকেন্ডের ভিডিওটি ট্রান্সক্রাইব করা হয় । একইসাথে ইতালি ভাষা জানা একাধিক ব্যক্তিকে ভিডিওটি শোনানো হয়।
কন্তের ট্রান্সক্রাইব করা বক্তব্যের কোথাও ইত্তেফাকের রিপোর্টে তার নামে উল্লিখিত কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ইতালিয়ান ভাষা জানা একজন দুভাষী জানান যে, সাক্ষাৎকার ভিডিওর ৭ মিনিট ২০ সেকেন্ডের পর থেকে লা সাক্সতা টিভির সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে ৮ মিনিট ৪০ সেকেন্ড পর্যন্ত কন্তে যে জবাব দেন তার মধ্যে বাংলাদেশে প্রসঙ্গে কিছু কথা বলেছেন। সাংবাদিকের প্রশ্ন এবং এর জবাবে কন্তের দেয়া বাংলাদেশ সংক্রান্ত বক্তব্য নিচে তুলে ধরা হলো--
সাংবাদিক: ডক্টর, দীর্ঘদিন পর ইউরোপের জন্য ইতালির বর্ডার খোলে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু আপনারা (ইতালি) অন্য কিছু দেশের ক্ষেত্রে চিন্তা করছেন বাধ্যবাধকতা আরোপের, এটা কেন?
কন্তে: বিবেচনায় নিবেন যে, আমাদের পুরো ইতালির বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আসা তথ্য থেকে জটিল প্রক্রিয়ায় কন্টাক্ট ট্রেস করতে হয়। বিদেশ থেকে COVID ১৯ পজেটিভ রোগী আসবে কোনরকম মনিটরিং /চেকআপ ছাড়া এটা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য না। এজন্যই নন-ইইউ দেশ থেকে আসা যাত্রীদের জন্য বাড়তি সর্তকতা নেয়া হয়েছে। একটা উদাহরণ দেই, এই দিনগুলোতে বাংলাদেশ থেকে আসা বিমান যাত্রীদের কোয়ারেন্টিনে রাখা হচ্ছে এবং তাদের ২০ শতাংশ COVID ১৯ পজেটিভ বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এর অর্থ উৎসস্থলে (ঢাকায়) কোন মনিটরিং বা চেকআপ ছিল না। তাই আমরা বাধ্য হয়েছি নিষেধাজ্ঞা দিতে এক সপ্তাহের জন্য। স্বাভাবিকভাবেই আমরা অন্যদের কাছ থেকেও দায়িত্বশীলতা আশা করি। কারো (কোন দেশের) দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কারণে নতুন ওয়েব (করোনার) আসুক তা কোনভাবেই কাম্য নয়।"
লা সাক্সতা'কে দেয়া কন্তের ইন্টারভিউতে "একেকজন বাংলাদেশি একেকটা ভাইরাস বোমা" এমন কোনো বক্তব্য পাওয়া না যাওয়ার বিষয়টি ইত্তেফাক'কে জানানো হলে পত্রিকাটির অনলাইন ইনচার্জ শনিবার সন্ধ্যায় জানান যে, তাদের ইতালি প্রতিনিধি ইত্তেফাকে প্রকাশিত কন্তের বক্তব্যের ভিডিও বা অন্য কোনো প্রমাণ দিতে পারেন নি। এবং সে কারণে ইত্তেফাকের প্রতিবেদনটি তারা ইতোমধ্যে সম্পাদনা করে "একেকজন বাংলাদেশি একেকটা ভাইরাস বোমা" অংশটি বাদ দিয়েছেন।
ইত্তেফাকের নতুন প্রতিবেদনের স্ক্রিনশট-
গেটি ইমেজ এর ছবি ইত্তেফাকের ক্রেডিটে প্রকাশ:
জুসেপ্পে কন্তের ভুয়া বক্তব্য সম্বলিত প্রতিবেদনে ইত্তেফাক যে কন্তের ছবিটি ব্যবহার করেছে তার নিচে ক্যাপশন হিসেবে লেখা রয়েছে-- "ইতালির প্রধানমন্ত্রী জুসেপ্পে কন্তে। ছবি: ইত্তেফাক"।
গুগল ইমেজ সার্চে দেখা যাচ্ছে এই ছবিটি ইত্তেফাকের তোলা নয়। বরং এটি গেটি ইমেজ- এর তোলা ছবি। চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি ফটোগ্রাফার Chris J Ratcliffe লন্ডনে COP26 UN Climate Summit-এ কন্তের বক্তব্যের সময় তুলেছেন। গেটি ইমেজের ওয়েবসাইটে ছবিটি দেখুন এই লিংকে।
বাংলাদেশের ফ্লাইটকে 'ভাইরাল বোমা' বলেছেন ইতালির একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা:
"একেকজন বাংলাদেশি একেকটা ভাইরাস বোমা" এমন বক্তব্য কন্তে না দিলেও গত ৮ জুলাই বুধবার ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য টাইমস এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ইতালির লাজিও অঞ্চলের একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা যার নাম Alessio D'Amato ঢাকা থেকে বাংলাদেশিদের বহন করে নিয়ে যাওয়া একটি ফ্লাইটকে 'ভাইরাল বোম' হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বিমান থেকে নামার পর ওই ফ্লাইটে ২৭৫ জন যাত্রীর মধ্যে ৩৬ জনের করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে।