ভ্যাকসিন নিয়ে খুৎবায় ভুয়া ও বিভ্রান্তিকর তথ্য
ভ্যাকসিন নিয়ে কাজী ইব্রাহীমের ভুয়া ও বিভ্রান্তিকর তথ্যনির্ভর বক্তব্যের ভিডিও ফেসবুক-ইউটিউবে ছড়িয়েছে
ফেসবুকে একটি ভিডিও দেখা যাচ্ছে, যেখানে মুফতি কাজী মুহাম্মদ ইব্রাহীম নামে একজন বক্তাকে ভ্যাকসিনের ব্যাপারে বেশ কিছু মন্তব্য করতে শোনা যায়। দেখুন এমন কিছু লিংক এখানে এবং এখানে।
Juwel Sarker নামের আইডি থেকে একটি ভিডিও পোস্ট করা হয় যার শিরোনাম ছিল, "ভ্যাকসিন আবিষ্কারের বিলগেটস ও ইসরালের চক্রান্ত ফাঁশ _ মুফতি কাজী ইব্রাহীম"।
ভিডিওতে মুফতি কাজী ইব্রাহীম ভ্যাকসিন নিয়ে বিভিন্ন তথ্য দিয়েছেন। এসব তথ্য বা দাবিগুলোর মধ্যে আছে, ভ্যাকসিনের মাধ্যমে মাইক্রোচিপ প্রবেশ করানো হবে, অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন-গ্রহীতা অসুস্থ্য হয়ে গেছে, ভারতের ভ্যাকসিন যিনি প্রথম দিয়েছেন তিনিও অসুস্থ্য এবং আরেকদেশে ভ্যাকসিন-গ্রহীতাকে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছেনা। এছাড়া ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টের বরাত দিয়ে বক্তা বলেন, ব্রাজিলে ভ্যাকসিন দেয়ার ফলে নারীদের পুরুষের মত দাড়িগোঁফ হচ্ছে, পুরুষের কন্ঠ নারীতে বদলে যাচ্ছে।
ফেসবুকে ছড়ানো ভিডিওটির স্ক্রিনশট--
ইউটিউবেও একই ভিডিও ছড়িয়েছে। দেখুন এখানে।
ফ্যাক্ট চেক:
বুম বাংলাদেশ উক্ত যাচাই করে দেখে, মুফতী কাজী ইব্রাহিমের ভ্যাকসিন সংক্রান্ত বক্তব্যে একাধিক ভিত্তিহীন এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য আছে। ভিডিওটির প্রথম অংশে (২:১৫ মিনিট থেকে) দাবি করা হয়, ভ্যাকসিনের মাধ্যমে মাইক্রোচিপ প্রবেশ করানো হবে এবং এতে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য বেহাত হয়ে যেতে পারে।
বক্তা তার উক্ত বক্তব্য সমর্থনে কোনো তথ্যসুত্র দেননি। তবে সম্প্রতি বিভিন্ন দেশে একই ধরনের দাবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছিল। এরপর রয়টার্স, বিবিসিসহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের ফ্যাক্ট চেকিংয়ের মাধ্যমে জানিয়েছে, ভ্যাকসিনের সাথে মাইক্রোচিপ প্রবেশ করানোর দাবিটি ভিত্তিহীন। মূলত কিছু তথ্য বিকৃত করে এবং ভিডিও এডিট করে এই দাবি ছড়ানো হয়। দেখুন এএফপির একটি ফ্যাক্টচেক রিপোর্টের স্ক্রিনশট-
কাজী ইব্রাহীম ভিডিওতে (২:৫১ মিনিট) -এ দাবি করেন, "অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন যিনি নিয়েছেন তিনি অসুস্থ্য"। এই দাবিটি বিভ্রান্তিকর।
মূলত গত সেপ্টেম্বরে অক্সফোর্ডের এস্ট্রোজেনেকা ভ্যাকসিনটি হিউম্যান ট্রায়াল পর্বে ৩০ হাজারের বেশি লোককে দেয়া হলে প্রথমে ব্রিটেনে একজন অসুস্থ্য বোধ করেন। এরপর ব্রিটেনে ট্রায়াল স্থগিত করা হয়। পরে আবার শুরু করা হয়। ভ্যাকসিনের ট্রায়ালে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মাত্রা এবং হার মোট রোগীর সংখ্যার তুলনায় খুবই কম হয়ে থাকে। "অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন যিনি নিয়েছেন তিনি অসুস্থ্য" কথাটি বললে কারো কাছে মনে হতে পারে মাত্র একজনকে ভ্যাকসিনটি দেয়া হয়েছিল এবং তিনি অসুস্থ্য হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে অনেক মানুষের মধ্যে একজন অসুস্থ্য হয়েছিলেন।
গ্রহীতার অসুস্থ্যতা মারাত্মক ছিল না এবং এরপরে সেই ট্রায়াল আবার শুরু হয়। এ সংক্রান্ত বিবিসির সেই খবরের স্ক্রিনশট--
ইব্রাহীম আরও বলেন, "ভারতে যিনি প্রথম ভ্যাকসিন গ্রহীতা 'অসুস্থ্য' হয়ে গেছেন।" এটিও বিভ্রান্তিকর তথ্য।
ভারতে সিরাম ইন্সটিটিউট অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনটি অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে মিলে ভারতে ট্রায়াল করেছে। এতে ১৬০০ ব্যাক্তির উপর পরীক্ষামূলকভাবে ভ্যাকসিনটি দেয়া হয়েছে। তন্মাধ্যে একজন অসুস্থ্য বোধ করেছেন বলে সংবাদমাধ্যমে আসে। কিন্তু সিরাম ইন্সটিটিউট উক্ত ব্যক্তির দাবিকে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করছে না। এছাড়া সিরাম ইন্সটিটিউট উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে ১০০ কোটি টাকার মানহানি মামলা করেছে। খবরের স্ক্রিনশট-
ইব্রাহীমের বক্তব্যে দাবি করা হয় যে, আরেকটি দেশে ভ্যাকসিন যিনি নিয়েছেন তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। যদিও বক্তা কোনো দেশের নাম উল্লেখ করেনি। কিন্তু ভ্যাকসিন গ্রহণে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার কোনো খবর কোথাও পাওয়া যায়নি।
ভিডিওটিতে সর্বশেষ যেই দাবিটি করেন মুফতি ইব্রাহীম তা হল, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট নাকি জানিয়েছেন তার দেশে ভ্যাকসিন গ্রহণের ফলে নারীদের পুরুষের দাঁড়ি-গোঁফ গজাচ্ছে, এবং পুরুষের কন্ঠ নারীর কন্ঠে বদলে যাচ্ছে। এছাড়া লিঙ্গ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি। অর্থাৎ বক্তব্যে মনে হচ্ছে, ব্রাজিলে ভ্যাকসিন গ্রহণে এরুপ ঘটনা ঘটেছে বলে তথ্য দিয়েছেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট।
কিন্তু ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জেইর বলসোনারোর ভ্যাকসিন সংক্রান্ত বক্তব্যটি ভুলভাবে উদ্ধৃত করেছেন ইব্রাহীম। এতে তথ্যের বিকৃতি ঘটেছে।
এএফপির খবরমতে, বলসোনারো ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক কোম্পানির প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন তারা বলবে "'we're not responsible for any side effects.'
বলসোনারো নিজে বলেছেন, "If you turn into a crocodile, it's your problem". অর্থাৎ "আপনি কুমির হয়ে গেলে এটা আপনার সমস্যা। (তার দায় কোম্পানি নেবে না)"।
ভ্যাকসিন বিরোধী বলসোনারো এভাবে আরও বলেছেন, ""If you become superhuman, if a woman starts to grow a beard or if a man starts to speak with an effeminate voice, they will not have anything to do with it," he said, referring to the drug manufacturers." (সূত্র: এএফপি)।
অর্থাৎ, নিজ দেশের জনগণকে ভ্যাকসিনে নিরুৎসাহিত করতে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, "যদি ভ্যাকসিন নেয়ার কারণে আপনি কুমীরেও পরিণত হয়ে যান, বা নারীদের দাঁড়িও গজাতে শুরু করে কিম্বা পুরুষদের কণ্ঠ নারীদের মতোও হয়ে যায়, তাহলেও ভ্যাকসিন কোম্পানির কিছুই করার নেই। এটা আপনার নিজের সমস্যা।"
এই কথা বলার মাধ্যমে বলসোনারো বুঝাননি যে, ইতোমধ্যে কেউ কুমীর হয়ে যাচ্ছে বা গেছে, কিম্বা কোনো নারীর দাঁড়ি গজানো শুরু হয়েছে। বরং তিনি ভবিষ্যতে এমন কিছু ঘটে গেলেও তার দায় প্রস্তুতকারকরা নেবে না বলে অদ্ভুতভাবে ভয় দেখিয়েছেন তিনি। তার এসব বক্তব্যের কোনো ভিত্তি নেই। কোথাও ভ্যাকসিন নেয়ার জন্য কেউ কুমির হয়ে যাওয়ার কোনো অভিযোগ কেউ করেনি বা নারীদের দাঁড়ি গজানোর অভিযোগও করেনি।
কিন্তু কাজী ইব্রাহীম এমনভাবে ব্রাজিল প্রেসিডেন্টের বক্তব্যকে তুলে ধরেছে যেন তিনি বলেছেন এসব ঘটনা ঘটেছে।
অর্থাৎ উক্ত ভিডিওটিতে মুফতি কাজী ইব্রাহিমের বক্তব্যে একাধিক ভিত্তিহীন এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য চিহ্নিত হয়েছে।