যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বিভিন্ন ভুয়া তালিকা প্রচার
ভিসা নীতি অনুযায়ী সম্প্রতি ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের ঘোষণা করলেও কারা নিষেধাজ্ঞা পাচ্ছেন তা প্রকাশ করবে না যুক্তরাষ্ট্র।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের একাধিক আইডি, পেজ ও গ্রুপ থেকে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি প্রয়োগের ঘোষণার পর বাংলাদেশের সরকারি এবং বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তি এবং বিচারবিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের নামের তালিকা পোস্ট করা হচ্ছে। সেসব পোস্টে দাবি করা হচ্ছে, এসব ব্যক্তিদের ওপর যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এরকম কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
পোস্টগুলোতে একই দাবির ওপর ভিন্ন ভিন্ন ব্যাক্তিদের নামের তালিকা পাওয়া যায়।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর 'Voice of Bangla' নামের একটি পেজ থেকে ১০ জন বিরোধী দলীয় নেতাদের নাম উল্লেখ করে দাবি করা হয়, "বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু, স্থায়ী কমিটির সদস্য বাবু গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নিপুণ রায় চৌধুরী, বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির সদস্য শামা ওবায়েদ, ডাকসুর সাবেক ভিপি ও গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর।" নিচে পোস্টটির স্ক্রিনশট দেখুন--
এদিকে একই দিনে অর্থাৎ ২৩ সেপ্টেম্বর 'London Bangla Channel' নামের একটি পেজ থেকে পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের নামের তালিকা পোস্ট করে দাবি করা হয়, "মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়া পুলিশের নামের তালিকা- ড:জাভেদ পাটোয়ারী, ড: হাসান মাহমুদ খন্দকার, শহীদুল হক............... মোঃ শহীদুল্লাহ , প্রলয় কুমার জোয়ার্দার। *ঘরের কথা পরে জানলো কেমনে?" নিচে পোস্টটির স্কিনশট দেখুন--
আবার গত ২২ সেপ্টেম্বর 'Shamsul Alam' নামক একটি আইডি থেকে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতার নাম উল্লেখ করে দাবি করা হয়, “সজিব ওয়াজেদ জয়,তারিক সিদ্দিক, সালমান এফ রহমান, আনিসুল হক, সামসুদ্দিন চৌধুরি মানিক, ইনায়েতুর রহিম, খসরুজ্জামান, রওশন এরশাদ, কাজী ফিরোজ রশিদ, মশিউর রহমান রাঙ্গা, ফখরুল ইমাম, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন.......সহ শত শত।“ পোস্টটির স্ক্রিনশট দেখুন--
ফ্যাক্ট চেক:
বুম বাংলাদেশ যাচাই করে দেখেছে, আলোচ্য পোস্টগুলোর দাবি ভিত্তিহীন। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে, বাংলাদেশে কোন কোন শ্রেণীর ব্যক্তিদের উপর ভিসানীতি প্রয়োগ করা হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে কোন কোন শ্রেণীর উপর প্রয়োগ করা হবে তা উল্লেখ করা হয়েছে, তবে কাদের উপর প্রয়োগ করা হচ্ছে সেসব ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ করা হয়নি। এমনকি ভিসা নীতির আওতায় ভিসা নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ না করার নীতিও নিজ দেশের আইন অনুযায়ী অনুসরণ করছে যুক্তরাষ্ট্র।
বিজ্ঞপিতে কি বলা হয়েছে:
কি-ওয়ার্ড সার্স করে, যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট এর ওয়েবসাইটে গিয়ে Taking Steps to Impose Visa Restrictions on Individuals Involved in Undermining the Democratic Election Process in Bangladesh” শিরোনামে গত ২২ সেপ্টেম্বর একটি বিজ্ঞপ্তি খুঁজে পাওয়া যায়। ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, "ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত থাকা বাংলাদেশি ব্যক্তিদের উপর ভিসা বিধিনিষেধ প্রয়োগের পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর মাঝে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধী দলের সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত আছেন। এই ব্যক্তি এবং তাদের নিকটবর্তী পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারেন। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে প্রমাণিত অন্য ব্যক্তিরাও ভবিষ্যতে এই নীতির অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসার জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারেন। এর মধ্যে বর্তমান এবং প্রাক্তন বাংলাদেশী কর্মকর্তা, বিরোধী ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ এবং নিরাপত্তা পরিষেবার সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন।" নিচে স্ক্রিনশট দেখুন--
একই সার্চে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস এর ওয়েবসাইটে ২২ সেপ্টেম্বর "বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ণ করার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের পদক্ষেপ গ্রহণ" শিরোনামে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র অধিদপ্তর থেকে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। পুরো বিজ্ঞপ্তির স্ক্রিনশট দেখুন--
যদিও ওই বিজ্ঞপ্তিতে কোনো ব্যক্তির নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ফেসবুকে সূত্রহীন দাবি প্রচার:
ফেসবুকে ভিন্ন ভিন্ন পোস্টে আলাদা ব্যক্তিদের নাম প্রচার করে তারা যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা পেয়েছেন বলে দাবি করা পোস্টগুলোতে কোন ধরণের নির্ভরযোগ্য সূত্র ব্যবহার করা হয়নি। যাচাই করে দেখা যায়, Voice of Bangla নামের পেজে "মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার তালিকায় ভিপি নুরসহ বিরোধী শিবিরের ১০ নেতা" শিরোনামে পোস্ট করে। পোস্টটিতে মার্কিন পররাষ্ট্র অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তির প্রতিবেদনের মধ্যে কিছু বেনামী এবং সূত্রহীন তথ্য ব্যবহার করে অতিরিক্ত তথ্য যুক্ত করা হয়েছে। নিচে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র অধিদপ্তরের পাঠানো বিজ্ঞপ্তি (ডানে) এবং ফেসবুকে প্রচার হওয়া পোস্টের (ডানে) মধ্যে পার্থক্য দেখুন--
অন্যদিকে 'London Bangla Channel' নামের পেজ থেকে পুলিশ কর্মকর্তা এবং করে 'Shamsul Alam' নামের আইডি থেকে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতার নাম প্রকাশ করা হলেও সেখানে কোন ধরণের সূত্র উল্লেখ করা নেই।
নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্তদের তালিকা নিয়ে কি বলছে যুক্তরাষ্ট্র:
কি-ওয়ার্ড সার্চ করে আলোচ্য দাবির পক্ষে কোনো ধরণের প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে, যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টে "Taking Steps to Impose Visa Restrictions on Individuals Involved in Undermining the Democratic Election Process in Bangladesh" শিরোনামের একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে কোন কোন শ্রেণীর ব্যক্তিরা কি কারণে বর্তমানে এবং ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা পেতে পারেন তা উল্লেখ করলেও কোনো ব্যক্তির নামের তালিকা প্রকাশ করেনি।
সার্চ করে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা রেকর্ড আইন অনুযায়ী ভিসা নিষেধাজ্ঞা ব্যক্তিদের নামের তালিকা প্রকাশ করা হয়না বলে জানা যায়। "ভিসা নীতির প্রয়োগ নিয়ে ডেইলি স্টারকে যা বললেন ডোনাল্ড লু" শিরোনামে গত ২২ সেপ্টেম্বর দ্যা ডেইলি স্টারের একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, "আমরা শুরু থেকেই বলেছি, এই নীতির আওতায় ভিসা নিষেধাজ্ঞা যাদের দেওয়া হবে, তাদের নাম আমরা প্রকাশ করব না। কাউকে ভিসা না দেওয়াসহ যেকোনো ভিসা রেকর্ড মার্কিন আইন অনুযায়ী গোপনীয় তথ্য।" স্ক্রিনশট দেখুন--
যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু'র বক্তব্য অনুযায়ী এটি স্পষ্ট যে, কাদের উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়া হচ্ছে তা কখনো প্রকাশ করবে না দেশটি।
অর্থাৎ, ভিসা রেকর্ড আইন অনুযায়ী ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় যাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তাদের নাম প্রকাশ করেনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরারাষ্ট্র দফতর।
সুতরাং বাংলাদেশের সরকার দলীয় ও বিরোধী রাজনৈতিক ব্যক্তি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন কর্মকর্তাদের নামের তালিকা প্রকাশ করে তারা যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা পেয়েছেন বলে যে তথ্য প্রচার করা হচ্ছে ফেসবুকে; তা বিভ্রান্তিকর।