প্রধানমন্ত্রীর উপপ্রেস সচিবকে 'সরিয়ে দেয়া'র ভিত্তিহীন খবর ফেসবুকে
৩ সপ্তাহ আগে পদত্যাগের তথ্য ছড়ানো হলেও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওয়েবসাইট বলছে তিনি এখনও কর্মরত আছেন।
ফেসবুকে Corruption in Media নামের একটি পেইজ থেকে শুক্রবার একটি পোস্ট করা হয়, "প্রধানমন্ত্রীর উপ প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকন কে তার পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে! ১৫ই অক্টোবর পদত্যাগপত্র জমা দেন খোকন।-মিডিয়া উইং,PMO."
দেখুন স্ক্রিনশট--
পোস্টটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
এর কিছুক্ষণ পরে Jawad Nirjhor নামে একটি ফেসবুক পেইজ থেকে একই বক্তব্য পোস্ট করে নিচে লেখা হয়, "Corruption in Media এর টাইমলাইন থেকে...."।
দেখুন নিচের স্ক্রিনশটে--
পোস্টটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
শনিবার ভোরে আরেকটি ফেসবুক প্রোফাইলে পোস্ট করা হয়, "মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারির পদ থেকে আশরাফুল আলম খোকনকে সম্প্রতি অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।" এই পোস্টসহ প্রতিটি পোস্টের সাথে "প্রধানমন্ত্রীর উপপ্রেস সচিব-১" আশরাফুল আলম খোকনের ছবি যুক্ত ছিলো।
পোস্টটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
স্ক্রিনশট দেখুন--
ফ্যাক্ট চেক:
এই ধরনের পোস্ট ফেসবুকে দেখে বুম বাংলাদেশ বিষয়টি যাচাই করে দেখার সিদ্ধান্ত নেয়। এর অংশ হিসেবে প্রথমেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওয়েবসাইটে ভিজিট করে দেখা যায় সেখানে "প্রেস অনুবিভাগ" এর অধীনে আশরাফুল আলম খোকনের নাম এবং পদবী রয়েছে "প্রধানমন্ত্রীর উপপ্রেস সচিব-১, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়"। লিংক এখানে। নিচে দেখুন স্ক্রিনশট--
এরপর বুম বাংলাদেশ যোগাযোগ করে আশরাফুল আলম খোকনের সাথে।
তিনি আদৌ পদত্যাগ করেছেন কিনা বা পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন কিনা তা জানতে চাওয়া হলে জনাব খোকন বলেন, "আমি পদত্যাগ করেছি বলা হচ্ছে, অথচ আমি কিছুই জানি না। ফেসবুকে এসব গুজব ছড়ানো হচ্ছে। আপনি প্রয়োজনে খোঁজখবর নিয়ে দেখতে পারেন বা পিএমও এর ওয়েবসাইটে গিয়েও দেখতে পারেন আমি দায়িত্বে আছি কিনা?"
খোকনকে পদত্যাগের বিষয়ে সাম্প্রতিক কোনো তথ্য তাদের কাছে আছে কিনা জানতে দুটি শীর্ষস্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেলের দুজন বিশেষ প্রতিনিধির সাথে-- যারা প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের খবরাদি সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর রাখেন-- কথা বলেছে বুম বাংলাদেশ। তারা উভয়েই তেমন কোনো খবর তাদের কাছে নেই বলে জানান।
তাদের মধ্যে যমুনা টেলিভিশনের একজন বিশেষ প্রতিনিধি বলেন, "গতকাল থেকে এমন তথ্য ফেসবুকে একটি পেইজে দেখেছি। এরপর সিনিয়র অনেক সাংবাদিকের সাথে এ বিষয়ে কথা হয়েছে। কিন্তু কেউই কিছু জানেন না। ফলে এখন পর্যন্ত বিষয়টি গুজব। কোনো প্রমাণ হাজির না করে এমন দাবি খবর আকারে ফেসবুক ছড়ানো বিভ্রান্তিকর।"
যারা খবরটি প্রথম ছড়িয়েছেন সেই Corruption in Media নামক ফেসবুক পেইজের সাথে ইনবক্সে যোগাযোগ করে তথ্যের উৎস সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে যে জবাবটি দেয়া হয়েছে তা হুবহু তুলে ধরা হলো--
"আমাদের সোর্স আমাদেরকে মিস গাইড করেনি বলেই আমরা বিশ্বাস করি।। পদত্যাগের খবর সত্য। ১৫ অক্টোবর। যেহেতু এ ব্যাপারে আমরা বিস্তারিত ভিডিও স্টোরি নিয়ে কাজ করছি, তাই স্ট্যাটাসটি সরিয়ে নেয়া হয়েছে। তবে, আমরা আবারো দাবী করছি, খোকন সাহেবের পিএমও অধ্যায় শেষ। ২০১৯ সালের বিভাগীয় তদন্ত, নগদ কেলেংকারী, পাপিয়া কান্ড সহ অনেকগুলো কারণে আগেই থেকেই বির্তকে ছিলেন খোকন। এমনকি জামাত বিএনপিপন্থী সাংবাদিকদের লালন-পালনের অভিযোগও আছে খোকনের বিরুদ্ধে। আমরা আশা করছি, খোকনের পূদত্যাগ ইস্যুতে রাতের ভিতর পরিপূর্ণ তথ্য দিতে পারবো।"
এরইমধ্যে Corruption in Media নামক ফেসবুক পেইজটি থেকে পোস্টটি প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু একই পেইজের সাথে সংশ্লিষ্ট (একাধিক ভিডিওতে উপস্থাপক হিসেবে দেখা গেছে যাকে) সেই Jawad Nirjhor নামক পেইজে এই রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত (বাংলাদেশ সময় সকাল ১১টা ৪০) পোস্টটি দেখা যাচ্ছিলো।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের তালিকায় ৬ নভেম্বর পর্যন্ত আশরাফুল আলম খোকনের নাম রয়েছে। ১৫ অক্টোবর তিনি পদত্যাগপত্র জমা দিলে বা ওইদিন তাকে 'সরিয়ে দেয়া হলে' এখনো কিভাবে তাকে কর্মকর্তা হিসেবে দেখানো হচ্ছে পিএমও এর ওয়েবসাইটে? আপনাদের দেয়া খবরের সত্যতার পক্ষে প্রমাণ কী?- এমন প্রশ্নের প্রেক্ষিতে বলা ইংরেজিতে উত্তর দেয়া হয়েছে যার অনুবাদ হচ্ছে, "আমি কি আপনার ইমেইল এড্রেসটি পেতে পারি? খোকনের পদত্যাগের বিষয়ে আমরা আপনাকে প্রমাণ পাঠাতে চাই। আমাদের সূত্র আমাদেরকে নিশ্চিত করেছে তারা প্রমাণ পাঠাবে। আর তা আপনাকে পাঠাতে পারতে পারলে আমরা খুশি হবো।"
সিদ্ধান্ত:
বুম বাংলাদেশ নিম্নোক্ত কারণে আলোচ্য খবরটিকে ভিত্তিহনী হিসেবে চিহ্নিত করছে।
প্রথমত, গুরুত্বপূর্ণ খবর প্রকাশের সময় যথাযথ সূত্র ও প্রমাণাদি উপস্থাপন করা হয়নি।
দ্বিতীয়ত, খবরটির পক্ষে কোনো প্রমাণ আছে কিনা তা খবর প্রকাশের আগে প্রকাশকারীরা নিজেরাও দেখেননি। যেহেতু প্রমাণ-ই দেখা হয়নি ফলে সেই প্রমাণাদি যাচাই করে দেখারও সুযোগ তাদের হয়নি। বুম বাংলাদেশ-এর সাথে আলাপে তারা বলেছেন বলেছেন যে, তারা 'বিশ্বাস করেন' তাদের সূত্র তাদেরকে মিসগাইড করেনি। এবং প্রমাণাদি চাওয়ার পর তারা জানিয়েছেন সূত্র তাদেরকে প্রমাণাদি পাঠাবেন। এরপর তা এই প্রতিবেদনের লেখককে পাঠানো হবে।
যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের পক্ষে কোনো প্রমাণ নিজেরা না দেখেই, শুধু সূত্রের ওপর নির্ভর করে প্রকাশ করা হয়েছে সেই তথ্যটির নির্ভরযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ, এবং একই সাথে এভাবে প্রমাণ না দেখে এবং সেই প্রমাণের সঠিকতা না যাচাই করে কোনো তথ্য প্রকাশকারীর নিজেরও নির্ভযোগ্যতা একই প্রক্রিয়ায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
তৃতীয়ত, প্রমাণবিহিনীভাবে যে দাবিটি করা হয়েছে তার বিপক্ষে প্রমাণ হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওয়েবসাইটে বর্তমান কর্মকর্তা হিসেবে আশরাফুল আলম খোকনের নাম থাকা। যে দিনটিতে খোকনের পদত্যাগ বা সরিয়ে দেয়ার খবর পরিবেশন করা হয়েছে তার ৩ সপ্তাহ পর পর্যন্ত আজ ৬ নভেম্বরও খোকনকে নিজেদের কর্মকর্তা হিসেবে বহাল দেখাচ্ছে পিএমও।
চতুর্থত, প্রকাশের পর সেই খবর প্রত্যাহার করে সেটির ভিত্তিকে আরও দুর্বল করেছে প্রকাশকারীরাই।
পঞ্চমত, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের খবরাখবর সম্পর্কে অবগত একাধিক সাংবাদিক বিষয়টি সম্পর্কে কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন। একজন খবরটিকে 'গুজব' বলেও অভিহিত করেছেন।
ষষ্ঠত, খবরের পক্ষে কোনো প্রমাণ (evidence) হাজির না করা পর্যন্ত বুম বাংলাদেশ-এই খবরটিকে ভিত্তিহীন ও গুজব বলে চিহ্নিত করলো।