মার্কিন গবেষণা কি বলেছে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে হিজাব সহায়ক?
মার্কিন একজন লেখিকার নিবন্ধের বক্তব্যকে বিকৃত করে প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে।
"হিজাব করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সহায়তা করে, মার্কিন গবেষণা!" শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে www.nayadigantajobs.com নামে একটি ওয়েবসাইট।
আকাইভ লিংক।
এছাড়া ঢাকাটাইমস, কালের কণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন, সময় টিভি অনলাইন, আমাদের সময় সহ আরও কিছু অনলাইন পোর্টালে একই খবর প্রকাশিত হয়েছে।
উপরিউক্ত সংবাদমাধ্যমগুলোর শিরোনাম ও প্রতিবেদনের ভাষা প্রায় একই রকম। প্রতিটি প্রতিবেদনের একাধিক প্যারা পরস্পরের সাথে হুবহু মিলে যায়।
nayadigantajobs.com এর শিরোনামে বলা হয়েছে, "মার্কিন গবেষণা" এর বরাতে জানানো হয়েছে, "হিজাব করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সহায়তা করে"।
প্রতিবেদনের ভেতরে লেখা হয়েছে--
"যুক্তরাষ্ট্রের নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ধর্ম ও যৌন বিভাগের অন্যতম গবেষক অ্যানা পায়েলা তার গবেষণার বিষয় 'মুসলিম হিজাবি নারী'। অর্থাৎ যেসব মুসলিম নারী হিজাব পরেন তাদের নিয়ে গবেষণা করেন অ্যানা।
এই মার্কিনি নারী গবেষক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পর মাত্র চেহারা ঢাকা শুরু করেছে। সেখানকার স্থানীয় ও ফেডারেল নেতারা তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেছে। কারণ হিজাব করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে।"
খবরের সূত্র হিসেবে প্রতিবেদনের নিচে উল্লেখ করা হয়েছে 'দ্য করনভার্সেশন' এর নাম (মার্কিন এই সংবাদমাধ্যমটির প্রকৃত নাম 'দ্য কনভার্সেশন')।
ফ্যাক্ট চেক:
দ্য কনভার্সেশন গত ১১ এপ্রিল লেখক ও গবেষক Anna Piela এর একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে যার শিরোনাম ছিলো, "Muslim women who cover their faces find greater acceptance among coronavirus masks – 'Nobody is giving me dirty looks".
নিবন্ধে লেখক একাধিক গবেষণা থেকে বিভিন্ন তথ্য উদ্ধৃত করেছেন। কিন্তু তিনি নিবন্ধের কোথাও এমন কোনো গবেষণার কথা উল্লেখ করেন নি যাতে বলা হয়েছে, "হিজাব করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে"।
বরং তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি গবেষণার বরাতে উল্টোটা লিখেছেন--
"The niqab alone is not sufficient protection against influenza-like viruses because it is not airtight. Mosques are warning women who wear the niqab to additionally wear a mask underneath for more effective protection."
অর্থাৎ, ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো কোনো ভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে শুধুমাত্র নিকাব (মুসলিম নারীদের মুখ ঢেকে রাখার পর্দা) যথেষ্ট নয় কারণ এটি (নিকাব) বায়ুপ্রতিরোধক নয়।
এছাড়া গবেষণার বরাত দেয়া ছাড়াও লেখক নিজের বক্তব্য হিসেবে নিবন্ধটির কোথাও এমন কথা লেখেননি যে, "হিজাব করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে"।
প্রকৃতপক্ষে, "হিজাব করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে কিনা"- এই আলোচনাটিই নিবন্ধটির আলোচ্য বিষয় নয়। বরং আলোচনার বিষয়বস্তু হলো, পশ্চিমা সমাজে যেসব মুসলিম নারী নিকাব (মুসলিম নারীদের মুখ ঢেকে রাখার পর্দা) পরে থাকেন তাদেরকে সাধারণ সময়ে নানান হয়রানির মুখে পড়তে হয়। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারিতে সব মানুষ যখন নিজেদের মুখ ঢেকে রাখতে মাস্ক ব্যবহার করছেন, তখন ওইসব মুসলিম নারীরা বেশ স্বচ্ছন্দবোধ করছেন। কারণ, এখন নিকাব দিয়ে মুখ ঢাকার ফলে কেউ আর তাদের প্রতি কটু দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে না। করোনা মহামারির সময়ে কিভাবে নিকাবধারী মুসলিম নারীরা কিভাবে একটি সামাজিক সমস্যা থেকে আপাতত মুক্তি পেয়েছে তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে নিবন্ধটিতে। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে নিকাব বা হিজাব সহায়ক কিনা- তা আলোচনার বিষয় ছিলো না লেখকের কাছে।
নিবন্ধটির একাংশে লেখক লিখেছেন--
"Even some non-Muslims are interested in the niqab as a means of protecting against coronavirus.
Afrah, from the U.K., told me that her non-Muslim aunt wants to use a niqab now because she finds regular face masks uncomfortable. And Sajida, an American Muslim, spoke of a convert friend whose father – a vehement critic of Islam and believer in anti-Muslim conspiracy theories – now encourages his daughter to wear a niqab to prevent the spread of coronavirus."
এখানে নন-মুসলিম দুইজন ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে যারা করোনার সময়ে মাস্ক ব্যবহারের বদলে নিকাবের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে বলে লেখক জানাচ্ছেন। কিন্তু তাদের এই আকৃষ্টতা তাদের একান্ত নিজস্ব ভাবনা; যাকে "মার্কিন গবেষণা" বা "মার্কিন গবেষকের বক্তব্য" বলার সুযোগ নেই।
বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে অন্যান্য ভুল:
উপরে উল্লিখিত বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যমগুলোর (nayadigantajobs.com ছাড়া) রিপোর্টে দ্য কনভার্সেশনের নিবন্ধের লেখকের নাম লেখা হয়েছে, "আনাবেলা"। প্রকৃতপক্ষে তার নাম হচ্ছে "আনা পিয়েলা" (Anna Piela)।
প্রতিটি সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টে লেখকের পরিচয় দিতে গিয়ে লেখা হয়েছে, "যুক্তরাষ্ট্রের নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ধর্ম ও যৌন বিভাগের অন্যতম গবেষক"।
এখানে "Religious Studies and Gender (Department) এর অনুবাদ করা হয়েছে, "ধর্ম ও যৌন (বিভাগ)"; যা সঠিক নয়। বাংলায় এর সঠিক অনুবাদ হবে "ধর্মীয় অধ্যয়ন ও জেন্ডার (বিভাগ)"। Gender এর বঙ্গানুবাদ "যৌন" নয়, "লিঙ্গ"। কিন্তু বাংলায় Gender Studies-কে "লিঙ্গ অধ্যয়ন" না লিখে "জেন্ডার অধ্যয়ন" লেখা হয়।
প্রতিটি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, "আনাবেলা সংবাদমাধ্যমকে বলেন..."। প্রকৃতপক্ষে Anna Piela সংবাদমাধ্যমকে 'বলেননি' (কোনো সংবাদ প্রতিবেদনে তার মন্তব্য নেয়া হয়নি), তিনি একটি নিবন্ধ 'লিখেছেন'।
লেখিকা বারবার তার লেখায় 'নিকাব' শব্দ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম ও প্রতিবেদনে বারবার 'হিজাব' লেখা হয়েছে। নিকাব আর হিজাবের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। একজন নিকাবী নারী (পর্দার উদ্দেশ্যে মুখমণ্ডল ঢেকে রাখা) অবশ্যই হিজাবী, কিন্তু একজন হিজাবী নারী নিকাবী না-ও হতে পারেন। হিজাবী নারীদের চেয়ে নিকাবী নারীরা পশ্চিমা দেশগুলোতে বেশি হয়রানির শিকার হন, এবং লেখক নিকাবী নারীদের বিষয়টিই তুলে ধরেছেন তার পুরো লেখায়।
নিকাব কি করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সহায়তা করে?
উপরে উল্লিখিত লেখক তার নিবন্ধে নিজের মতামত আকারে বা কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণার বরাতে নিকাব বা হিজাব করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সহায়ক কিনা তা নিয়ে কোনো তথ্য দেননি। তবে আমরা অন্যান্য সূত্র থেকে দেখার চেষ্টা করবো- নিকাব করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সহায়তা করে কিনা?
যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা CDC এর করোনাভাইরাস সংক্রান্ত গাইডলাইনে বলা হয়েছে, "In settings where facemasks are not available, HCP might use homemade masks (e.g., bandana, scarf) for care of patients with COVID-19 as a last resort. However, homemade masks are not considered PPE, since their capability to protect HCP is unknown. Caution should be exercised when considering this option."
অর্থাৎ, স্কার্ফ বা বন্দনার মতো জিনিসকে মাস্ক হিসেবে ব্যবহার করলে তা 'ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম' হিসেবে গণ্য হবে না। কারণ স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা দেয়ার মতো সক্ষমতা এসব জিনিসের আছে কিনা তা পরীক্ষিত নয়। কিন্তু যখন কোনো সুরক্ষা মাস্ক থাকবে না তখন শেষ অবলম্বন এসব জিনিসকে মাস্ক হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
নিকাব যেহেতু স্কাফের মতোই একটি কাপড়, ফলে সেটির ক্ষেত্রেও একই বক্তব্য প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ, এটি করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সহায়তা করে- এমনটি প্রমাণিত নয়।