দুবাই নয় বরং সরকারি সফরে নেদারল্যান্ডসে আছেন ডিবি প্রধান হারুন
বুম বাংলাদেশ দেখেছে, গোয়েন্দা প্রধান ব্যবসায়িক কাজে দুবাই যাননি বরং সরকারি সফরে নেদারল্যান্ডসে যাওয়ার পথে দুবাইয়ে ট্রানজিট নিয়েছেন।
ফেসবুকের একই পেজ থেকে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি করা একই পোস্টের বর্ণনা (ক্যাপশন) একইরকম বজায় রাখা হলেও ছবিটি পরিবর্তন করা হয়েছে। ছবি পরিবর্তন করা পোস্টটির স্ক্রিনশট দেখুন--
এবারে "Abdur Rab Bhuttow" নামের ফেসবুক পেজে আলোচ্য পোস্টটির এডিট হিস্ট্রি দেখুন, গত ১৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৬টা ২১ মিনিটে উক্ত পোস্ট থেকে একটি ছবি রিমুভ করে আরেকটি ছবি যুক্ত করা হয়েছে বলে দেখা যাচ্ছে।
অর্থাৎ ফেসবুক পোস্টে দাবি করা হচ্ছে বিনিয়োগ করতে বা ব্যবসায়ের কাজে বর্তমানে পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে অবস্থান করছেন।
ফ্যাক্ট চেক:
বুম বাংলাদেশ যাচাই করে দেখেছে, পোস্টের দাবিটি সঠিক নয়। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ-ডিএমপি'র গোয়েন্দা শাখার প্রধান ও ডিএমপি'র অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হারুন অর রশীদ ব্যবসায়ের কাজে দুবাই যাননি। বরং তিনি সরকারি সফরে নেদারল্যান্ডসে যাওয়ার পথে দুবাইয়ে ট্রানজিট নিয়েছেন বলে জানিয়েছে, ডিএমপির গোয়েন্দা শাখা।
পাঠকের সুবিধার্থে প্রতিবেদনটি কয়েকটি ধাপে ভাগ করে সাজানো হয়েছে।
ব্যবসায়িক নাকি সরকারি সফর?
আলোচ্য পোস্টে দাবি করা হয়েছে, বিনিয়োগ করতে বা ব্যবসায়ের কাজে গোয়েন্দা প্রধান হারুন দুবাইয়ে অবস্থান করছেন। কি-ওয়ার্ড সার্চ করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ-ডিএমপি পরিচালিত অনলাইন সংবাদ পোর্টাল ডিএমপি নিউজে (dmpnews.org) পুলিশ কর্মকর্তা হারুনের বিদেশ সফর সংক্রান্ত একটি খবর পাওয়া যায়। "নেদারল্যান্ডসে সরকারি সফরে গেছেন ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হারুন অর রশীদ" শিরোনাম আজ (১৭ ফেব্রুয়ারি) প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের আদেশে সরকারি সফরে তিনি গত ১৫ ফেব্রুয়ারি (বুধবার) নেদারল্যান্ডসে গেছেন এবং বর্তমানে তিনি সেখানেই অবস্থান করছেন। তবে এখানে তিনি সরকারি সফরে নেদারল্যান্ডস গেছেন বলা হলেও তাঁর দুবাই যাওয়া সংক্রান্ত কোনো তথ্য এখানে পাওয়া যায়নি। স্ক্রিনশট দেখুন--
এর সুত্র ধরে পুলিশ কর্মকর্তা হারুনের সফর সংক্রান্ত বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য পেতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় থেকে এ বিষয়ে সরকারি আদেশের কপিটি সংগ্রহ করেছে বুম বাংলাদেশ। ২২ জানুয়ারি ২০২৩ জারি করা ওই আদেশে বলা হয়েছে, হারুন অর রশীদ সহ চারজন সরকারি কর্মকর্তা ১৫ ফেব্রুয়ারি কিংবা সম্ভবপর নিকটতম দিন থেকে পরবর্তী ৭ দিন নেদারল্যান্ডসে থাকবেন (সফরের বিষয়টি প্রকাশে অনিচ্ছুক থাকায় তা মুছে দেয়া হয়েছে)। আদেশের "Terms and Conditions" অংশে 'C' তে বলা হয়েছে, "The period of stay including the period to be spent on transit will be treated as on duty." অর্থাৎ ট্রানজিটে ব্যয় হওয়া সময়'সহ এসব কর্মকর্তার পুরো সফরকাল সরকারি কাজ বা দায়িত্বপালনের অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে। সরকারি আদেশের কপিটি দেখুন--
সুতরাং উক্ত আদেশ অনুযায়ী, পুলিশ কর্মকর্তা হারুন যদি নেদারল্যান্ডস যাওয়ার পথে ট্রানজিট হিসেবে দুবাইয়ে অবস্থান করেও থাকেন, সেটাও তাঁর সরকারি সফর বা দায়িত্বপালনের অংশ, এটাকে ব্যক্তিগত বা ব্যবসায়িক সফর বলা যায় না।
মুটিনা গ্রান্ড ডিলাক্স হোটেল কোথায়?
আলোচ্য ফেসবুক পোস্টে দাবি করা হয়, গোয়েন্দা প্রধান হারুন দুবাইয়ের "মুটিনা গ্রান্ড ডিলাক্স হোটেল"-এর ৪১৬ নম্বর রুমে উঠেছেন। কি-ওয়ার্ড ধরে বিভিন্ন সার্চ ইঞ্জিন এবং trip.com, tripadvisor.com, booking.com, agoda.com সহ হোটেল বুকিংয়ের জন্য বিশ্বের জনপ্রিয় অন্তত ১৫ টি প্ল্যাটফর্মে সার্চ করেও দুবাইয়ে "মুটিনা গ্রান্ড ডিলাক্স হোটেল" নামের কোন হোটেল খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমনকি কি-ওয়ার্ড ধরে দুবাই বাদ দিয়ে পুরো পৃথিবীতেও এই নামের কোনো হোটেলের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
ছবি দুটি কোথা থেকে তোলা?
আলোচ্য পোস্টে প্রথমে আপলোড করা ছবিটি দৃশত কোন ভবনের পার্কিং এলাকার ছবি। ছবিটি নিয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চ করে অথবা অন্য কোনো মাধ্যমে এর উৎস কিংবা কোথা থেকে তোলা হয়েছে, তা নিশ্চিত হতে পারেনি বুম বাংলাদেশ।
অন্যদিকে, দ্বিতীয় ছবিটি নিয়েও রিভার্স ইমেজ সার্চ করে কোন কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া যায়নি। তবে ছবিটি পর্যবেক্ষণ করে অনুমান করা যায়, এটি কোন হোটেলের লবি বা লাউঞ্জের ছবি। এই অনুমানের ভিত্তিতে দুবাইয়ের প্রায় অর্ধশতাধিক হোটেলের নাম ধরে সেসব হোটেলের ইন্টারিয়র ডিজাইন ও লবি উল্লেখ করে কি-ওয়ার্ড সার্চ করে আলোচ্য ছবিটির ব্যাকগ্রাউন্ডের সাথে দুবাইয়ের "Hyatt Place" হোটেলের ইন্টারিয়র ও লবির চিত্রের সাথে হুবহু মিল খুঁজে পাওয়া যায়। হোটেল বুকিংয়ের প্ল্যাটফর্ম 'agoda.com' এর "Hyatt Place" হোটেলের লিংকে হোটেলটির লবি, রুম, কিচেন, সুইমিং পুল, জিমনেশিয়াম সহ বিভিন্ন অংশের ৮৩টি ছবি পাওয়া যায়। তন্মধ্যে ৫৭ তম ছবিতে দৃশ্যমান ইন্টারিয়র ও ব্যাকগ্রাউন্ডের সাথে আলোচ্য ফেসবুক ছবিটির ইন্টারিয়র ও ব্যাকগ্রাউন্ডের তুলনামূলক মিল দেখুন--
এবারে "Hyatt Place" হোটেলের একই লিংকের ৬৭ তম ছবিটির ইন্টারিয়র ডিজাইন ও ব্যাকগ্রাউন্ডের সাথে আলোচ্য ছবিটির তুলনা দেখুন--
এদিকে, "Hyatt Place" হোটেলের কি-ওয়ার্ড ধরে সার্চ করে মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী গণমাধ্যম গালফ নিউজের লাইফ-স্টাইল বিভাগে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত প্রতিবেদনে যুক্ত "Hyatt Place" হোটেলটির একটি ছবির সাথেও আলোচ্য ফেসবুক পোস্টের ছবিটির সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। গালফ নিউজের ছবিটির স্ক্রিনশট দেখুন--
কী বলছে ডিএমপি'র গোয়েন্দা শাখা?
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে যোগাযোগ করা হলে ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার অতিরক্তি উপ পুলিশ কমিশনার মো. জুনায়েদ আলম সরকার বুম বাংলাদেশকে জানান, গোয়েন্দা প্রধান হারুন অর রশীদ সরকারি সফরে বর্তমানে নেদারল্যান্ডসে অবস্থান করছেন। হারুনের দুবাইয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "বাংলাদেশ থেকে নেদারল্যান্ডসে যাওয়ার সরাসরি ফ্লাইট না থাকায়, স্যার ট্রানজিট হিসেবে দুবাইকে বেছে নিয়েছেন।"
এদিকে, নেদারল্যান্ডস সফররত পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশিদের সাথে যোগযোগ করলে তিনি বলেন, সরকারি একটি বিশেষ কাজে বর্তমানে তিনি নেদারল্যান্ডসে আছেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ত্যাগ করে দুবাইয়ে ট্রানজিট নেন এবং ট্রানজিট কিছুটা দীর্ঘ হওয়ায় দুবাইয়ের একটি হোটেলে সময় অতিবাহিত করেন বলেও জানান তিনি। ছবি দুটি তাঁকে পাঠিয়ে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ছবিগুলো নেদারল্যান্ডেসের যাত্রাপথের, প্রথম ছবিটি দুবাই বিমানবন্দরের পার্কিং এলাকা থেকে তাঁর অজ্ঞাতসারে কেউ তুলেছে। আর দ্বিতীয় ছবিটি দুবাইয়ে যেই হোটেলে অবস্থান করেছেন, সেই হোটেলের লবিতে একইভাবে কেউ তুলে থাকতে পারে বলে জানান তিনি। তবে দুবাইয়ের কোন হোটেলে তিনি উঠেছিলেন সরাসরি তা বলতে চাননি। বুম বাংলাদেশের পক্ষ থেকে হোটেলটির নাম "Hyatt Place" কিনা প্রশ্ন করা হলে, কিছুটা অবাক হয়ে "হ্যাঁ সূচক" উত্তর দেন জনাব হারুন।
যদিও প্রথম ছবিটি দুবাই বিমানবন্দরের পার্কিং এলাকা থেকে তোলা হয়েছে, জনাব হারুনের এই দাবি অন্য কোনো মাধ্যম থেকে তা যাচাই করে দেখা সম্ভব হয়নি।
সুতরাং সরকারি সফরে নেদারল্যান্ডসে থাকা ডিএমপির গোয়েন্দা প্রধান হারুন অর রশিদের ছবি পোস্ট করে বিভ্রান্তিকরভাবে দাবি করা হচ্ছে তিনি ব্যবসায়িক কাজে দুবাই অবস্থান করছেন, যা ভিত্তিহীন।
Editor's Note: পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশীদের বক্তব্য সহ প্রয়োজনীয় তথ্য যোগ করে প্রতিবেদনটি আপডেট করা হয়েছে।