ভুয়া তথ্য ও ফুটেজ দিয়ে তৈরি ভিডিও দেখা হয়েছে দেড় কোটি বার
'চায়না নিজ ইচ্ছায় করোনা ভাইরাস ছড়িয়েছে' এর পক্ষে প্রমাণ হিসেবে ভুল তথ্য ও ফুটেজ প্রচার করা হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে।
"চায়না নিজ ইচ্ছায় করোনা ভাইরাস ছড়িয়েছে: প্রমাণ দেখুন" এমন দাবি করে একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়েছে "অজানা পৃথিবী" নামে একটি ফেসবুক পেইজে। একই ধরনের আরও ভিডিও পাওয়া গেছে কিছু ইউটিউ চ্যানেল ও ফেসবুকে পেইজে।
অনলাইন থেকে সংগ্রহ করা বেশ কয়েকটি ফুটেজ ব্যবহার করে তৈরি করা ৫ মিনিট ৪৪ সেকেন্ডের ভিডিওটি ১ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ দেখেছেন এবং ৩ লাখ ১০ হাজার জন শেয়ার করেছেন "অজানা পৃথিবী" পেইজটি থেকে।
ভিডিওটির শুরুতে দেয়া ধারাভাষ্যে বলা হয়েছে--
"হয়তো আপনারা এতদিনে জেনে গেছেন, করোনা ভাইরাস বা কভিড-১৯ চীনের তৈরি একটি ভাইরাস। তারা জেনে শুনে পৃথিবীতে ছড়িয়েছে এ ভাইরাস। একমাত্র তাদের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করার জন্য।"
ফ্যাক্ট চেক:
করোনাভাইরাস চীনের ল্যাবে তৈরি করা হয়েছে এবং পরে ইচ্ছা করে ছড়ানো হয়েছে- এমন বক্তব্য কিছু রাজনীতিক ও সংবাদমাধ্যমে করা হলেও এখনও এটি 'ষড়যন্ত্র তত্ত্ব' হিসেবেই রয়েছে। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এই দাবির পক্ষে কোনো অকাট্য প্রমাণ হাজির করেননি।
বরং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, চীনের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীদের অভিমত হলো, ভাইরাসটিকে নিয়ে এখন পর্যন্ত যেসব গবেষণা হয়েছে তাতে এটি কোনো ল্যাবে মানুষের তৈরি তেমনটি প্রতীয়মান হয়নি। এটি যে প্রকৃতি থেকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
"অজানা পৃথিবী" পেইজের ভিডিওতে কয়েকটি ক্লিপ অনলাইন বিভিন্ন সূত্র থেকে নিয়ে সেগুলোকে তাদের দাবির পক্ষে "প্রমাণ" হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
ভিডিওর প্রথমদিকে দেখানো হয় একজন নারীর ফুটেজ; যেখানে দেখা যাচ্ছে ওই নারী একটি ভবনের ভেতরে দেয়ালের দিকে থুথু ফেলছেন এবং তার সাথে রাখা একটি বোতলে থাকা পানিটুকু ফেলে বোতলটি খালি করছেন।
এই নারীর থুথু ফেলার বিষয়টি নিয়ে "অজানা পৃথিবী" পেইজটির ভিডিওতে দাবি করা হয়, নারীটি (করোনা) সংক্রমিত, এবং থুথু ফেলার মাধ্যমে ইচ্ছা করে ভাইরাস ছড়াচ্ছেন। ঘটনাস্থল অস্ট্রেলিয়া বলে দাবি করা হয়। (দৃশ্যটি ভিডিওতে একাধিকবার রিপ্লে করে দেখানোয় মনে হতে পারে তিনি একাধিকবার থুথু ফেলেছেন। প্রকৃতপক্ষে একটি দৃশ্যকে বারবার দেখানো হয়েছে)।
কিন্তু ইন্টারনেটে অন্যান্য বিভিন্ন ফেসবুক পেইজ ও টুইটে একই ভিডিওকে স্পেনের মাদ্রিদে একজন চীনা নারীর থুথু ফেলার ঘটনা বলে দাবি করা হয়েছে। যদিও ওইসব দাবিরও কোনো নির্ভরযোগ্যতা নেই।
Boom Bangladesh ভিডিওটির মূল সূত্রের সন্ধান পায়নি।
অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ায় সম্প্রতি ভিন্ন একটি ভিডিও ভাইরাল হয় যেটিতে দেখা যায়, এক চীনা নারী সুপারমার্কেটে ফলমূলের উপর থুথু ফেলছেন এবং পরে তাকে পুলিশ গ্রেফতার করছে। ভাইরাল হওয়া সামাজিক মাধ্যমের পোস্টে দাবি করা হয় থুথু ফেলা ওই নারী করোনা আক্রান্ত এবং তিনি ভাইরাস ছড়ানোর জন্য এমনটি করছেন।
যদিও অস্ট্রেলিয়ার মূলধারার সংবাদমাধ্যম পরে জানিয়েছে, ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি ভুয়া। দুটি ভিন্ন ভিন্ন ঘটনার ভিডিও এডিট করে সেটি বানানো। ভিডিওর প্রথম অংশের ঘটনায় যে নারীকে গ্রেফতার করতে দেখা যাচ্ছে সেটা চিহ্নিত করতে সমর্থন হয়েছে সংবাদমাধ্যম। পুলিশ জানিয়েছে, ওই নারীকে গ্রেফতার করার সাথে ফলমূলে থুথু দেয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। সুপারশপে খারাপ আচরণ করার কারণে তাকে প্রথমে বের হয়ে যেতে বলা হয়। কিন্তু তিনি না যাওয়ায় পুলিশ তাকে আটক করে এবং পরে ছেড়ে দেয়।
ভিডিওতে থুথু দেয়া নারীর অংশটি কোথাকার এবং কবেকার তা অবশ্য জানাতে পারেনি অস্ট্রেলিয়ান সংবাদমাধ্যম।
এর বাইরে অস্ট্রেলিয়ায় কোনো চীনা নারীর কোথাও ইচ্ছাকৃত কোথাও থুথু ফেলা সংক্রান্ত কোনো খবর অস্ট্রেলিয়ায়র সংবাদমাধ্যমে পাওয়া যায় না।
"অজানা পৃথিবী" পেইজের ভিডিওর ২ মিনিট ১৫ সেকেন্ডের পর থেকে আরেকজন নারীর ফুটেজ দেখিয়ে বলা হয়েছে, ওই নারী "ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত একটি চাইনিজ ট্যুরিস্ট"। তাকে দেখা যাচ্ছে, রাস্তার পাশে রাখা কোনো দুটি জিনিসের (সেটি ডাস্টবিন কিনা বুঝা যাচ্ছে না) ওপর থুথু ফেলে একটি ভবনের গেটের দিকে যাচ্ছেন। তারপর বন্ধ গেটটি থেকে ফিরে চলে যাচ্ছেন। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আবার থুথু ফেলেছেন কিনা তা ফুটেজে স্পষ্ট বুঝা যায় না। ঘটনাটি ইতালির বলে দাবি করা হয়েছে।
ইন্টারনেটে এই ভিডিওটির মূল উৎস কী তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
তবে যে রাস্তার পাশে ওই নারীকে একটি পাত্রে থুথু ফেলতে দেখা যাচ্ছে সেই রাস্তার পার্শ্ববর্তী দুটি সাইনবোর্ড পুরোপুরি চাইনিজ ভাষায় লেখা দেখা যাচ্ছে। এ থেকে ধারণা করা যায় ভিডিওটি চীনের কোনো এলাকার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অনলাইনে কিছু অনির্ভরযোগ্য সূত্রে এটিকে চীনের উহানের ভিডিও বলেও দাবি করা হয়েছে।
উপরের দুজন নারীর ক্ষেত্রেই "অজানা পৃথিবী"র ভিডিওতে দাবি করা হয়েছে তারা করোনা আক্রান্ত। কিন্তু কিভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, তারা আক্রান্ত সে সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি।
এরপর আরেকজন নারীর ফুটেজ দেখিয়ে দাবি করা হয়েছে, তিনিও করোনা আক্রান্ত এবং ইচ্ছা করে ভাইরাস ছড়াতে তিনি লিফটের বাটনে থুথু লাগাচ্ছিলেন।
চীনের চংকিং অঞ্চলের লি নামের ৪৮ বছর বয়সী ওই নারী একটি ভবনের লিফটে নিজের মুখে থুথু লাগানোর বিষয়টি সত্য। ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশের পর পুলিশ তাকে আটক করে। ওই নারী তখন জানান, অন্য এক নারীর সঙ্গে তার ঝড়ার পর ক্ষোভ মেটাতে ওই বাসার লিফটে দাঁড়িয়ে তিনি এমনটা করেছেন। পুলিশ তার স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর জানায় তিনি করোনা আক্রান্ত ছিলেন না।
আরেকটি ফুটেজ দেখানো হয়েছে যেখানে লিফটে এক ব্যক্তিক কর্তৃক টিস্যুতে থুথু লাগিয়ে লিফটের বাটনে ঘষতে দেখা যাচ্ছে। এসময় লিফটে আরও কয়েকজন ছিলেন।
চীনের এমবিএন টিভি এ ঘটনা নিয়ে রিপোর্ট করেছে। তাতে জানানো হয়, চীনের গুয়াংজি ঝুয়াং অঞ্চলে ওই ব্যক্তি ইচ্ছা করেই এমন কাণ্ড করেছেন। তিনি পুলিশের কাছে জানিয়েছে নিছক মজা করার জন্য তিনি এ কাজ করেন। পরে পুলিশ তার স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর জানায় অভিযুক্ত ব্যক্তি ওইসময় করোনা আক্রান্ত ছিলেন না এবং কোনো করোনা আক্রান্তের সংস্পর্শেও আসেননি। তবে অযাচিত কর্মকাণ্ডের জন্য তাকে ১০ দিনের জন্য বন্দী রাখা হয়।
আরও অসত্য তথ্য:
## ভিডিওটিতে দাবি করা হয়, কানাডা ও স্পেনের প্রধানমন্ত্রীরা করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বা স্পেনিশ প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ কেউই করোনা আক্রান্ত হননি। বরং তাদের উভয়ের স্ত্রীরা আক্রান্ত হয়েছিলেন।
## ভিডিওতে বলা হয়েছে, চীনের বেইজিংয়ে লকডাউন ছিলো না। প্রকৃতপক্ষে এই তথ্যটি অসত্য। বেইজিং প্রায় দুই মাস সময় ধরে লকডাউনে ছিলো।
বেইজিংয়ের লকডাউন নিয়ে ডকুমেন্টারি তৈরি করেছে আল জাজিরা।
## দাবি করা হয়েছে, চীনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক শহর সাংহাইয়েও লকডাউন ছিলো না। বাস্তবে এই শহরটিও প্রায় দুই মাস লকডাউনে ছিলো।
## ভিডিওতে দাবি করা হয়েছে, "আমেরিকার ডলারের তুলনায় চায়নার ইউয়ান শক্তিশালী হতে শুরু করেছে"।
প্রকৃতপক্ষে ঘটেছে এর উল্টোটি। চীনের সংবাদমাধ্যম সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট ফেব্রুয়ারি মাসে জানিয়েছে, চলতি বছরের ওই সময় পর্যন্ত ইউয়ানের দাম ডলারের বিপরীতে কমেছে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। এই পতন দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুরের মুদ্রা এবং ইউরোর তুলনায় কম ছিলো। তবে করোনা ভাইরাসের কারণে সামনের মাসগুলোতে চীনের ইউয়ানের দরপতন আরও বাড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়।
এরপর এপ্রিল মাসের শুরুতে চীনের সংবাদসাধ্যম সিজিটিন জানিয়েছে, ডলারের বিপরীতে গত ছয় মাসের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল অবস্থানে রয়েছে ইউয়ান।