"তেলাপিয়া মাছ থেকে করোনা ভাইরাস ছড়াচ্ছে জানিয়েছে বিশেষজ্ঞ!" এমন শিরোনামে একটি খবর সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছে।
BongExclusive নামে একটি অনলাইন পোর্টালে খবরটি ৫ মার্চ (২০২০) প্রকাশিত হয়। এরপর এটি ফেসবুকে অনেকে শেয়ার করছেন।
খবরটির সত্যতা যাচাই করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, এটি ভুয়া। প্রায় তিন বছর আগে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনকে নকল করে বিকৃত শিরোনামে নতুনভাবে প্রকাশ করা হয়েছে।
BongExclusive এর প্রতিবেদনটির প্রথম তিনটি প্যারা এখানে হুবহু তুলে দেয়া হল--
"তেলাপিয়া মাছ নতুন রোগ ছড়াচ্ছে! সবাইকে সর্তক হওয়ার পরামর্শ – দেশে তেলাপিয়া মাছে একটি বিশেষ ধরনের ভাইরাস আক্রমণ করছে। 'তেলাপিয়া লেক' নামের ওই ভাইরাস দক্ষিণ আমেরিকা থেকে শুরু করে আফ্রিকা-এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) সম্প্রতি এই রোগের ব্যাপারে বিশ্ববাসীকে সাবধান করে বিশেষ সতর্কতা জারি করেছে।
এই ভাইরাস যেসব দেশে ছড়িয়ে পড়ছে, সেখানে তেলাপিয়ায় মড়ক দেখা দিচ্ছে বলে সংস্থাটি তাদের সতর্কবার্তায় উল্লেখ করেছে। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ও মৎস্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ ধরনের ভাইরাসে আক্রান্ত তেলাপিয়া মাছের গায়ে ফোসকা পড়বে,এরা খাবার কম খাবে। এমন কোনো মাছ দেশের কোনো খামারে তাঁরা পাননি। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন,তাঁরা নিয়মিতভাবে বিভিন্ন খামারে মাছের পরীক্ষা করেন। সেখানে এ ধরনের কোনো রোগাক্রান্ত মাছ পাওয়া যায়নি।
তবে কেউ ব্যক্তিগতভাবে ইন্দোনেশিয়া বা থাইল্যান্ড থেকে তেলাপিয়া মাছের পোনা নিয়ে আসছে কি না,তা কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করা উচিত। তবে এফএওর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,বিশ্বের চতুর্থ তেলাপিয়া উৎপাদনকারী দেশও এই ভাইরাসের আক্রমণের শিকার হতে পারে। ইতিমধ্যে এই রোগ ছড়িয়ে পড়েছে এমন দেশ থেকে যাতে অন্য দেশগুলো তেলাপিয়া আমদানি না করে, সে ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আরিফ আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, 'মূলত অল্প জায়গায় বেশি মাছ চাষ করলে ও পরিবেশদূষণ নিয়ন্ত্রণ না করলে এ ধরনের ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ বেশি হয়। আমরা এ ব্যাপারে চাষিদের সচেতন করতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছি।"
পড়ুন এই লিংকে।
প্রথমত খেয়াল করার বিষয় হলো- শিরোনামে তেলাপিয়া মাছ থেকে করোনাভাইরাস ছড়ানোর কথা বলা হলেও প্রতিবেদনের ভেতরে কোথাও 'করোনাভাইরাস' এর কথা নেই। বরং যে ভাইরাসটির কথা বলা হয়েছে সেটির নাম "তেলাপিয়া লেক"। অর্থাৎ শিরোনামে তথ্যবিকৃতি করা হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, প্রতিবেদনের দুটি জায়গাতে প্রথম আলোকে দেয়া বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট দুজন কর্তা ব্যক্তির বক্তব্য রয়েছে। অর্থাৎ, এই প্রতিবেদনটি যে প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে তথ্য/বক্তব্য নিয়ে তৈরি করা তা স্পষ্ট।
এবার দেখা যাক প্রথম আলোকে কবে এই কর্তা ব্যক্তিরা তাদের বক্তব্য দিয়েছেন, এবং প্রথম আলোর মূল প্রতিবেদনে কী রয়েছে?
২০১৭ সালের ৩০ জুন প্রথম আলো একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যার শিরোনাম "তেলাপিয়ার নতুন রোগ, সতর্ক হওয়ার পরামর্শ"।
প্রতিবেদনটি পড়ুন এই লিংকে
BongExclusive এর প্রতিবেদনের সাথে প্রথম আলোর প্রতিবেদনটির প্রায় হুবহু মিলে যায়। কয়েকটি ক্ষেত্রে শুধু কিছু বাক্যকে আগ-পিছ করা হয়েছে, এবং প্যারাগুলো ভেঙে দেয়া হয়েছে।
যেমন প্রথম আলোর প্রতিবেদনের ইন্ট্রো লেখা হয়েছে এভাবে--
"বিভিন্ন দেশে তেলাপিয়া মাছে একটি বিশেষ ধরনের ভাইরাস আক্রমণ করছে। 'তেলাপিয়া লেক' নামের ওই ভাইরাস দক্ষিণ আমেরিকা থেকে শুরু করে আফ্রিকা-এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) সম্প্রতি এই রোগের ব্যাপারে বিশ্ববাসীকে সাবধান করে বিশেষ সতর্কতা জারি করেছে। এই ভাইরাস যেসব দেশে ছড়িয়ে পড়ছে, সেখানে তেলাপিয়ায় মড়ক দেখা দিচ্ছে বলে সংস্থাটি তাদের সতর্কবার্তায় উল্লেখ করেছে।"
BongExclusive এর প্রতিবেদনের ইন্ট্রোর প্রথম বাক্যটি ছাড়া উপরের এই প্যারার সাথে পুরোপুরি মিলে যাচ্ছে (মিলিয়ে পড়ুন)। প্রতিবেদনের বাকিটাও একইরকম।
৩ বছর আগের প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে--
"বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা নিয়মিতভাবে বিভিন্ন খামারে মাছের পরীক্ষা করেন। সেখানে এ ধরনের কোনো রোগাক্রান্ত মাছ পাওয়া যায়নি। তবে কেউ ব্যক্তিগতভাবে ইন্দোনেশিয়া বা থাইল্যান্ড থেকে তেলাপিয়া মাছের পোনা নিয়ে আসছে কি না, তা কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করা উচিত।"
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদের একই বক্তব্য হুবহু আছে BongExclusive এর প্রতিবেদনেও।
অন্য আরেক কর্তা ব্যক্তি বক্তব্যও হুবহু প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে কপি-পেস্ট করা হয়েছে। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে--
"এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আরিফ আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, 'মূলত অল্প জায়গায় বেশি মাছ চাষ করলে ও পরিবেশদূষণ নিয়ন্ত্রণ না করলে এ ধরনের ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ বেশি হয়। আমরা এ ব্যাপারে চাষিদের সচেতন করতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছি।"
প্রথম আলোর প্রতিবেদনে কোথাও 'করোনাভাইরাস' প্রসঙ্গ নেই। অর্থাৎ, এটা স্পষ্ট যে, প্রায় ৩ বছর আগের পুরোনো প্রতিবেদনটি নকল করে প্রকাশ করতে গিয়ে অপ্রাসঙ্গিকভাবে 'করোনাভাইরাস' এর কথা শিরোনামে উল্লেখ করেছে BongExclusive নামক পোর্টালটি।
একই প্রতিবেদন ছড়াচ্ছে ভিন্ন শিরোনামেও!
এদিকে প্রথম আলোর এই একই প্রতিবেদনের তথ্য ও মূল বক্তব্য ঠিক রেখে কিছু প্যারা যোগ-বিয়োগের মাধ্যমে ভিন্ন শিরোনামেও অন্য কয়েকটি অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত হয়েছে গত কয়েকদিনে।
যেমন bd24live নামে একটি পোর্টালে ৫ মার্চ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের শিরোনাম করা হয়েছে, "নতুন 'ভাইরাস' ছড়াচ্ছে তেলাপিয়া, সতর্কতা জারি"।
এই প্রতিবেদনে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ এবং মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আরিফ আজাদের বক্তব্য (প্রথম আলোকে দেয়া) হুবহু কপি করে প্রকাশ করা হলেও তাতে প্রথম আলোর বরাত উল্লেখ করা নেই।
লিংক: https://bit.ly/38t9Wte
তেলাপিয়া মাছে 'তেলাপিয়া লেক' নামক ভাইরাস ৩ বছর আগে ছড়িয়েছে, বর্তমানে নয়। এবং এ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা ওই সময়ে সতর্ক করেছিলেন, বর্তমানে কোনো ধরনের 'সতর্কতা জারি' করা হয়নি।