যাচাই না করে মূলধারার সংবাদমাধ্যমে ভুয়া খবর প্রচারের একটি দৃষ্টান্ত
বিদেশি ওয়েবসাইটটি কতটা নির্ভরযোগ্য তা যাচাই না করেই সেটির প্রতিবেদনকে খবরের সূত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে
বাংলাদেশের মূলধারার সংবাদমাধ্যমে সোমবার একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে; যাতে দাবি করা হয়েছে, ফ্রান্স জাতীয় ফুটবল দলের খেলোয়াড় পল পগবা ঘোষণা দিয়েছেন তিনি আর ফ্রান্স দলের হয়ে খেলবেন না। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাকরন ইসলাম সংক্রান্ত আপত্তিকর বক্তব্য দিয়েছেন বলেই নাকি তার এমন সিদ্ধান্ত- সেটাও দাবি করা হয় এসব খবরে।
বাংলাদেশি মিডিয়ায় তেমন কয়েকটি প্রতিবেদন দেখুন নিচে--
যমুনা টিভি অনলাইন: ফ্রান্সের হয়ে আর খেলবেন না পগবা!
বাংলানিউজ: ফ্রান্সের জার্সিতে আর খেলবেন না পগবা!
সময় টিভি অনলাইন: ফ্রান্সের জার্সিতে আর খেলবেন না পগবা!
জনকণ্ঠ: ফ্রান্সের জার্সিতে আর খেলবেন না পগবা!
নিউজ টোয়েন্টিফোর: ফ্রান্সের জার্সিতে আর না খেলার সিদ্ধান্ত পগবার
দেশ রুপান্তর: ইসলাম নিয়ে ম্যাখোঁর মন্তব্যে ফ্রান্স দল 'ছাড়লেন' পগবা
বাংলাদেশ প্রতিদিন: প্রেসিডেন্টের ইসলামবিদ্বেষী মন্তব্য, প্রতিবাদে ফ্রান্সের হয়ে ফুটবল খেলাই ছাড়লেন পগবা!
যুগান্তর: ম্যাক্রোঁর ইসলামবিদ্বেষী মন্তব্যে ফ্রান্স দল 'ছাড়লেন' পগবা
বাংলা সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে কী লেখা হয়েছে তার উদাহরণস্বরূপ নিচে বাংলানিউজের প্রতিবেদনের একটি স্ক্রিনশট দেয়া হলো--
দ্য সান এর বরাতে খবর:
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে খবরটি প্রকাশিত হয়েছে ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড দ্য ডেইলি সান এর বরাতে। বেশিরভাগ বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যমে শুধু এই পত্রিকাটির বরাত দেয়া হয়েছে। আবার কেউ কেউ অন্য আরও দুয়েকটি ইংরেজি অনলাইন পোর্টালের বরাতও যুক্ত করেছে।
যেমন জনকণ্ঠের প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, "ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য সানের বরাতে এমন খবরই মিলেছে।"
নিউজ টোয়েন্টিফোর টেলিভিশনের অনলাইন প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, "সোমবার (২৬ অক্টোবর) এমন এক খবর প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক গণমাধ্যম দ্য সান এবং ফুটবলভিত্তিক ক্রীড়ামাধ্যম কিক অফ।"
এসব প্রতিবেদনের বেশিরভাগে খবরটির মূল সূত্র কী তা উল্লেখ করা হয়নি।
খবরটির সত্যমিথ্যার দায় নেয়নি দ্য সান:
বাংলাদেশের মিডিয়ার বেশিরভাগের প্রতিবেদন পড়লে পাঠকের ধারণা হবে যে, খবরটির মূল উৎস দ্য সান। অর্থাৎ, দ্য সান খবরটি তাদের সূত্র থেকে জেনে প্রকাশ করেছে।
কিন্তু বাস্তবে দ্য সান এই খবরের সত্যমিথ্যার দায় নিজেরা নেয়নি। নিজেদের কোনো সূত্রে খবরটির সত্যতা পাওয়ার কোনো তথ্য পত্রিকাটি উল্লেখ করেনি। বরং লিখেছে, পগবা বা ফ্রেঞ্চ ফুটবল ফেডারেশন কারো কাছ থেকে তারা এই খবর সম্পর্কে কোনো বক্তব্য নেয়নি।
বরং www.195sports.com নামে মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক একটি অখ্যাত ওয়েবসাইটের বরাত দিয়ে লিখেছে তারা এই খবর ওই ওয়েবসাইট থেকে পেয়েছে। পাশাপাশি নিজেদের রিপোর্টে ওই ওয়েবসাইটের প্রতিবেদনের লিংকও যুক্ত করে দিয়েছে। পাশাপাশি সান নিজেদের প্রতিবেদনের শিরোনামের নিচে স্পষ্ট অক্ষরে "GOSSIP" বা "গালগল্প" শব্দটি লিখেছে।
www.195sports.com কোনো পেশাদার সংবাদমাধ্যম নয়:
এই ওয়েবসাইটটির পগবা সংক্রান্ত প্রতিবেদনটিতে গিয়ে দেখা যায় সেখানে কোনো তথ্যসূত্রের উল্লেখ করা হয়নি। শুধু দাবি করা হয়েছে, ম্যাকরনের বক্তব্যের প্রতিবাদে পগবা অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু কবে কোথায় কার কাছে এমন ঘোষণা দিয়েছেন তার কোনো তথ্য নেই।
ওয়েবসাইটটির অন্যান্য কিছু প্রতিবেদন এবং সামাজিক মাধ্যমে তাদের উপস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ওয়েবসাইটটি খুবই অপেশাদারভাবে পরিচালিত হয়। প্রতিদিন কয়েকটি প্রতিবেদন আরবী ভাষায় আপলোড করা হলেও খুব কম সংখ্যক মানুষ ওয়েবসাইটটি ভিজিট করেন। অনলাইন ট্রাফিক মনিটরিং ওয়েবসাইট অ্যালেক্সা-তে মিশরভিত্তিক ওয়েবসাইটটির মিশরীয় র্যাংকিং দেখা যায় নয় হাজারের উর্ধ্বে।
এছাড়া ফেসবুক ও টুইটারে তাদের একাউন্ট থাকলেও প্রতিদিনের সেসব পোস্ট ও টুইটে গড়ে একজন ব্যক্তিও রিয়েকশন দেন না।
যেই রিপোর্টারের নামে রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়েছে www.195sports.com-এ তার ফেসবুক প্রোফাইল পর্যবেক্ষণে এমনটা প্রতীয়মান হয় না যে, তিনি একজন নামকরা স্পোর্টস সাংবাদিক; যিনি সরাসরি পগবার সাথে কথা বলে রিপোর্টটি লিখেছেন। আবার রিপোর্টের মধ্যে কোনো ধরনের সূত্রের উল্লেখ ছাড়াই একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ করাও পেশাদারিত্বের লক্ষণ নয়; যা তার রিপোর্টে ঘটেছে।
এরপর Hussein Faramawy নামক ওই রিপোর্টারের সাথে ফেসবুক মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করে বুম বাংলাদেশ। পগবা ফ্রান্স দল থেকে অবসরে যাচ্ছেন এমন তথ্যের সূত্র কী তার কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, তার সূত্রের ব্যাপারে তিনি কিছু প্রকাশ করবেন না। একাধিকবার অনুরোধের পর তিনি জানান, ফ্রেঞ্চ ফুটবল এসোসিয়েশনের এক কর্তার সাথে তিনি কথা বলে রিপোর্ট করেছেন।
কিন্তু রিপোর্টে তেমন কারো সাথে কথা বলে তথ্য পাওয়া গেছে এমন কথা লেখা নেই কেন- প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তর দেননি। এরপরে ওই ব্যক্তির ইমেইল ঠিকানা চাওয়া হলে তিনি জানান, তার কোম্পানির ম্যানেজমেন্টের সাথে কথা বলে তিনি ইমেইল ঠিকানা দেয়া যায় কিনা জানাবেন।
এদিকে Hussein Faramawy এর ইমেইলের অপেক্ষায় থাকাবস্থায় পল পগবা নিজেই জানান যে, দ্য সান এর প্রতিবেদনে যা বলা হয়েছে তা 'অগ্রহণযোগ্য ভুয়া খবর'।
তিনি তার ইনস্টাগ্রাম ও টুইটারে দ্য সান এর প্রতিবেদনের স্ক্রিনশটের ওপরে "Unacceptable Fake News" শব্দগুলো লাল অক্ষরে লিখে পোস্ট করেছেন। দেখুন তার টুইটের স্ক্রিনশট--
যাচাই করেনি বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম:
দ্য সান তাদের প্রতিবেদনে স্পষ্ট করে জানিয়েছে, এই খবর তারা নিজেদের সূত্র নিশ্চিত হয়ে প্রকাশ করছে না। এবং তাদের মূল সূত্রের ওয়েবসাইটের লিংকও দিয়েছে। ট্যাবলয়েড চরিত্রের একটি সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রে এমন নিজেদের সূত্রে যাচাই ছাড়া "GOSSIP" বা "গালগল্প" হিসেবে যথাযথ ডিসক্লেইমার দেয়া সাপেক্ষে কোনো খবর প্রকাশ করা অপ্রত্যাশিত নয়। কিন্তু বাংলাদেশি যেসব সংবাদমাধ্যম ট্যাবলয়েড চরিত্রের নয়, তারাও একটি বিদেশি ট্যাবলয়েডের দায়দায়িত্ব না নেয়া প্রতিবেদনকে যাচাই বাছাই ছাড়াই প্রকাশ করেছে। এবং মূল যে সূত্রের বরাত দ্য সান দিয়েছে সেটি যে একটি অপেশাদার ওয়েবসাইট, যেটিকে বড় কোনো সংবাদের সূত্র হিসেবে গ্রহণ করা ঝুকিপূর্ণ তার কোনো উল্লেখ বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে ছিলো না। মূল সূত্রটির গ্রহণযোগ্যতা ও পেশাদারিত্বের বিষয়টি যাচাই করে দেখলে এমন ভুয়া খবর ছড়ানো থেকে মুক্ত থাকা সম্ভত হতে পারতো।